চলতি বছরের জুনের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সিপিবি ধর্ম নিরপেক্ষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব দল এবং ব্যক্তির প্রতি বিকল্প বাম রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার আহ্বান জানায়। কিন্তু দু’মাসের অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত সে আহ্বানে তেমন কোনো সাড়া পায়নি দলটি।
সম্প্রতি দেশের পাঁচটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফল বিচার করে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির যে চিত্র পাওয়া গেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে দুই জোটের বাইরে তৃতীয় শক্তি গড়ার সিদ্ধান্ত নেয় সিপিবি। বাম বিকল্প শক্তি গড়ে তুলতে সিপিবি যে বক্তব্য প্রদান করেছিল তাতে বলা হয়, জনগণের একটি বড় অংশ ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। সরকার ও সরকারি দলের নানা অপকর্ম, ব্যর্থতা ইত্যাদির ফলে আওয়ামী লীগের জনসমর্থনে ভাটার টান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসনের প্রতি জনগণের বিতৃষ্ণা এর চেয়ে কম ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে কার্যকর, দৃশ্যমান কোনো সৎ, স্বচ্ছ ভাবমূর্তিসম্পন্ন শক্তির অনুপস্থিতিতে তারা নিরুপায় হয়ে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট প্রার্থীদের ভোট দিয়েছে। এই পরিস্থিতি যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একই ফলাফল প্রতিফলিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে দেশের ওপর সাম্প্রদায়িক জঙ্গি শক্তির নিয়ন্ত্রণ বাড়বে এবং দেশ একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে।
এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি থেকে মুক্ত ও তার বাইরে থাকা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, সৎ, স্বচ্ছ ভাবমূর্তিসম্পন্ন, দেশপ্রেমিক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, বামপন্থি শক্তির একটি সম্মিলিত নতুন শক্তি বলয়ের পক্ষেই এই বিপদ মোকাবিলা সম্ভব। এক্ষেত্রে সিপিবির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, সৎ, স্বচ্ছ ভাবমূর্তিসম্পন্ন ব্যক্তির প্রতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি বিকল্প রাজনৈতিক বলয় ও আন্দোলন গড়ার লক্ষ্যে আলোচনা শুরু ও বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানানো হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিপিবির একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, সিপিবি-বাসদ ঐক্যকে আরো শক্তিশালী করতে পূর্বে বাম মোর্চাকে নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য করার যে প্রক্রিয়া ছিল এটি তারই বর্ধিত রূপ। তিনি বলেন, এই প্রক্রিয়ায় সিপিবি শুধু বাম রাজনৈতিক দলই নয় দেশকে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির হাত থেকে বাঁচাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, সৎ, স্বচ্ছ ভাবমূর্তিসম্পন্ন, দেশপ্রেমিক ব্যক্তিকে প্রধান্য দিচ্ছে।
দলীয় একটি সূত্র জানায় জুলাই মাসের ১৭ তারিখে সিপিবি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, প্রগতিশীল, বামপন্থি শক্তির একটি সম্মিলিত নতুন বলয় গড়ে তোলার ঘোষণা দেয়। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত ব্যক্তি পর্যায়ে চার-পাঁচজন এবং দল পর্যায়ে বিচ্ছিন্ন দুয়েকটি দল ছাড়া তেমন কেউ সাড়া দেয়নি। আর যেসব দল এবং ব্যক্তি এই বলয়ে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য যোগাযোগ করেছিলেন তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি সিপিবি।
এই বলয়ে সম্পৃক্ত হতে এ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলের মধ্যে একমাত্র গণফোরাম আর ব্যক্তি পর্যায়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ এবং প্রকৌশলী শেখ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ছাড়া উল্লেখযোগ্য তেমন কেউ এখনো এ বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। এমনকি বাম মোর্চার অন্তর্গত এবং বাম মোর্চার বাইরের কোনো বামপন্থি দলও এখন পর্যন্ত সিপিবির সঙ্গে বাম বিকল্প বলয় গড়ে তুলতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি।
সিপিবির এমন আহ্বানের প্রেক্ষিতে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ডা. ফয়জুল হাকিম বলেন, সিপিবির সঙ্গে বাম বিকল্প শক্তি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। কারণ সিপিবি ক্ষমতাসীন আওয়ামী জোটের আশীর্বাদপুষ্ট দল। স্বাধীনতার পর থেকেই তারা নানাভাবে আওয়ামী লীগের বন্ধুদল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের নেতৃত্বে এই বলয় গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
বাম বিকল্প বলয় প্রসঙ্গে বাম মোর্চার সমন্বয়ক জোনয়েদ সাকি বলেন, দ্বিদলীয় বৃত্তের বাইরে বাম বিকল্প গড়ে তোলা সময়ের দাবি। কিন্তু সেটা যদি প্রধান দুই দলের কোনো একটিকে বিশেষ সুবিধা প্রদানের জন্য হয় সেক্ষেত্রে বাম মোর্চার দ্বিমত রয়েছে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে সিপিবি-বাসদ ঐক্যের সঙ্গে আলোচনা চলছে। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে এই বলয় গড়ে উঠবে, এর লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি কী হবে সেগুলো আগে নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সাকি বলেন, বাম মোর্চাও অচিরেই দেশের একটি বিকল্প প্লাটফর্ম গড়ে তোলার ঘোষণা দেবে। তবে সিপিবি-বাসদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। ঐকমত্য হলে বৃহত্তর শক্তি গড়ে তোলা সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ বলেন, বৃহত্তর বাম বিকল্প শক্তি গড়ে তুলতে আমরা এখনো তেমন সাড়া পাইনি একথা ঠিক। তবে আগামী মাসে সিপিবির পক্ষ থেকে দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। এর মধ্যে বিভাগীয় ও বড় জেলা শহরে সমাবেশ, লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি। এছাড়া দলীয় পর্যায়েও যোগাযোগ বাড়ানো হবে।
- রাশেদ রাব্বি
COMMENTS