একটা পত্রিকা থেকে একজন সাংবাদিক আমাকে ফোন করে পঞ্চাশ হওয়ার পর জীবন
কেমন বোধ হচ্ছে জানতে চাইলেন। পঞ্চাশ নিয়েই একটা স্টোরি লিখছেন কাগজে।
নিজেই বললেন, আগে বলা হত, চল্লিশে জীবন শুরু হয়, এখন বলা হয় পঞ্চাশে জীবন
শুরু হয়। আপনিও নিশ্চয়ই তাই মনে করেন? আমি জানি ওপাশ থেকে হ্যাঁ উত্তরের
আশা নিয়ে বসেছিলেন সাংবাদিক। আমার না শুনে বেশ অবাক হলেন। তাঁর চমকানোর
শব্দও যেন ফোনে পাওয়া গেল।
আমি যা বললাম তা হল, পঞ্চাশের পর জীবন শুরু হয়, এ নিতান্তই বয়স হওয়ার ফলে যে একটা চরম হতাশা আসে, সেটার সান্ত্বনা। পঞ্চাশে বরং জীবন শেষ হওয়ার শুরু। মানুষের গড়আয়ু খুব বেশি নয়। অনেক কচ্ছপও আমাদের চেয়ে বেশি বাঁচে। খুব সৌভাগ্যবান হলে আশি বা তার ওপরে বাঁচে মানুষ, তা না হলে পঞ্চাশ থেকেই সাধারণত কঠিন অসুখগুলো ধরতে শুরু করে। হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্যানসার। আমার পরিবারে আছে হাই ব্লাড প্রেশার, ডায়বেটিস, মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশান, কিডনি ফেইলুর, ক্যানসার। আমাকে এর মধ্যেই হাই ব্লাড প্রেশারে ধরেছে, আর সেদিন ডেঙ্গু বয়ে আনলো হাই ব্লাড সুগার। এ দুটোর টেনশন তো আছেই, তার ওপর আছে শরীরের কোথাও আবার ক্যানসার হচ্ছে না তো চুপচাপ?-এই দুশ্চিন্তা।কয়েক মাস আগে আমার ছোটদার প্যানক্রিয়াস ক্যানসার ধরা পড়েছে। ওর ক্যানসার সত্যি বলতে কী ভীষণ ভয় পাইয়ে দিয়েছে আমাকে। মা’র হয়েছিল ক্যানসার, ছোটদা’র হলো, তাহলে কি আমারও হবে ওই রোগ! আমারও জিনে ঘাঁপটি মেরে আছে কোনও মন্সটার? মা বেঁচেছিলেন সাতান্ন বছর বয়স অবধি, বাবা মারা গেলেন সাতষট্টি বছর বয়সে। দাদার একটা ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল ষাটে পা দিয়ে। আমাদের বেঁচে থাকা ওই পঞ্চাশ ষাটের খুব বেশি ওপরে যাবে না। তারপরও ভেবেছিলাম, একবার জেনোম সিকোয়ান্সিং করবো। কোটি টাকার ব্যাপার। জেনোম সিকোয়েন্সিং করবো শুনে এক বন্ধু বললো, মরার হাজার রকম কারণ থাকতে পারে, শুধু কি আর জেনেটিক ডিজিজে লোকে মরে! অ্যাকসিডেন্টে মরছে না মানুষ। তা ঠিক। এত আকাশে আকাশে উড়ি, কবে যে প্লেন ক্রাশ করবে কে জানে! ওই সিকোয়েন্সিংএর উৎসাহ তারপর আর পাইনি। সব ক্যানসারই তো জেনেটিক নয়, আমার মা’র আর ছোটদা’র ক্যানসার জেনেটিক বলে অনেক ডাক্তারই মনে করেন না। মনে না করলেও নিজের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে সেদিন লিভার হাসপাতালে গিয়ে কোলনোস্কপি করে এলাম। কোলন ঠিক আছে। কোলন ঠিক আছে কিন্তু অন্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলো ঠিক আছে কি না কে বলবে, কিন্তু ওই প্রতি অঙ্গের টেস্ট করতে দৌড়োবো, এত উদ্যম আমার নেই। এমনিতে আমি ডাক্তারের কাছে যাওয়ার লোক নই। যত পারা যায়, ডাক্তার এড়িয়ে চলি। সারা বছর কেবল যাবো যাবো করি, যাই না।
নিজে ডাক্তার বলে, সম্ভবত এই হয়, ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে অত
কাঠখড় পোড়াতে ইচ্ছে করে না। অ্যাপোয়েন্টমেন্ট নাও, যাও, টাকা দাও,
লাইনে দাঁড়াও, অপেক্ষা করো। ডাক্তার হওয়ার সুবাদে ওই টাকা দেওয়াটা বা
অপেক্ষা করাটা থেকে বেঁচে যেতাম সবসময়। ওসব আগে কখনও করতে হয়নি। এখনও
করতে ইচ্ছে করে না। আর রোগ দেখতে গিয়ে আমার সঙ্গে এদেশের কোনও ডাক্তার তো
ডাক্তারী ভাষায় কথা বলেন না। আমি বরং ডাক্তারী ভাষায় প্রশ্ন ট্রশ্ন করলে
ডাক্তাররা ভাবেন, আমি সম্ভবত বেজায় শিক্ষিত কোনও রোগী, অথবা ইন্টারনেটে
রোগ শোক সম্পর্কে পড়ে জ্ঞান অর্জন করেছি। নিজে ডাক্তার, এ কথাটা মুখ ফুটে
কাউকে বলি না। আজ কুড়ি বছর ডাক্তারি করি না। অত বছর ডাক্তারি না করলে
নিজেকে ডাক্তার বলতে অস্বস্তি হয়। এদিকে ডাক্তার তো দিয়েই যাচ্ছেন
অ্যাডভাইজ, হাঁটাটা যেন হয়। ওই আধঘন্টা হাঁটার কথা ভাবলেই শরীরে আলসেমির
চাদর জড়াই। এই অঞ্চলে হাঁটতে বড় অনিচ্ছে আমার।
ইউরোপ আমেরিকায় কিন্তু এই অনিচ্ছেটা হয় না। পরিবেশ খুব বড় একটা
ব্যাপার বটে। জীবন যে কোনও সময় ফুরোবে, এই সত্যটা আগের চেয়ে এখন বেশি
ভাবি বলেই, পজিটিভ একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করছি, আমি আগের মতো সময় নষ্ট করি
না। টুয়েনটিজ আর থার্টিজএ গর্দভের মতো সময় প্রচুর নষ্ট করেছি। তখনও এই
বোধোদয়টা হয়নি যে সময় কম জীবনের। জানতাম, কিন্তু সে জ্ঞানটাকে আমি
থিওরিটিক্যাল জ্ঞান বলবো। সত্যিকার বোধোদয় হওয়ার জন্য ওই বয়সে পা দেওয়া
চাই। চল্লিশেও যে খুব হয়েছিল বোধোদয়, তা বলবো না। পঞ্চাশে এসে হঠাৎ যেন
নড়ে চড়ে বসেছি। প্রচুর পড়ছি, লিখছি। আজে বাজে কাজে সময় নষ্ট করি না।
এমনকি রাতের ওই সাত আট ঘণ্টার ঘুমটাকেও অহেতুক আর সময় নষ্ট বলে মনে হয়।
খুব লাইকমাইণ্ডেড এবং ইন্টারেস্টিং লোক না হলে কারও সঙ্গে আড্ডাও আজকাল আর
দিই না। আর কিছুদিন পর ভাবছি একা বেরিয়ে পড়বো পৃথিবীর পথে। যে দেশগুলো
দেখা হয়নি, অথচ দেখার খুব ইচ্ছে, দেখবো। জীবনকে অর্থপূর্ণ যতটা করতে পারি,
করবো। জীবনকে যতটা সমৃদ্ধ করতে পারি, করবো।
সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, সাজি কি না আগের চেয়ে বেশি। এরও উত্তর আশা
করেছিলেন, হ্যাঁ বলবো। আমি বললাম, আগেও আমি কখনও বেশি সাজগোজ করিনি, এখনও
না। পঞ্চাশে এসে সাজগোজ বাড়িয়ে দেব কেন, আমি কি অস্বীকার করতে চাইছি যে
আমার পঞ্চাশ? রিংকল বেড়েছে বটে, তবে ভয়ংকর কিছু নয়। আর হলেও ক্ষতিটা কী
শুনি? শরীরই কি আমার সম্পদ যে এর রিংকল টিংকলগুলো লুকিয়ে রেখে কচি খুকি
ভাব দেখাবো? অস্বীকার করি না, গ্রে হেয়ার। এ যে কোত্থেকে এলো জানি না,
সাতান্ন বছর বয়সেও আমার মার একটিও চুল পাকেনি। পঁচাশি বছর বয়সেও আমার
নানির চুল অতি সামান্যই পেকেছে। আমার বাবার চুল আমি চিরকাল মিশমিশে কালোই
দেখেছি। আমার ছোটদার চুল পাকেনি বললেই চলে। তবে দাদার চুল নাকি সেই তার
চল্লিশ বছর বয়সেই পেকে একেবারে পুরো সাদা। আমার চুল পাকার জিনটা আর দাদার
ওই চুল পাকার জিনটা একই জিন, নিশ্চয়ই ইনহেরিট করেছি কোনও আত্মীয় থেকে।
জানি না কার থেকে। এই অকালপক্কতাকে মাঝে মাঝে কালো বা সোনালি করি। একসময়
যখন দাদার মতো পুরো সাদা হয়ে উঠবে সব চুল, তখন ভাবছি অমিতাভ ঘোষের মতো
চুলে আর হাত দেবো না। চুল পাকার সঙ্গে বেশ বুঝি যে বয়সের কোনও সম্পর্ক
নেই। আমাদের পরিবারে বয়স বাড়াবার একটা প্রবণতা আছে। আমার বাবা যে তাঁর
ষাট বছর বয়স থেকে নিজের বয়স আশি বছর বলতে শুরু করেছিলেন, যতদিন বেঁচে
ছিলেন আশিই বলেছেন।
আমার দাদা তো প্লাস বলবেই তার বয়স বলতে গেলে। বত্রিশ প্লাস, ফরটি সিক্স
প্লাস, ফিফটি টু প্লাস। প্লাসটা দিতে হয় না, দরকার নেই, এসব বলেও আমি
লক্ষ করেছি দাদা প্লাসটা কিছুতেই মাইনাস করতে পারে না। দাদার ওই ছোটবেলা
থেকেই মনে হতো, বেশি বয়স হলে সমাজে সম্মানটা একটু বেশি পাওয়া যায়।
সম্মান পাওয়ার জন্য দাদার বরাবরই বড় শখ। সে যুগে বাবারা ছেলেমেয়েদের
বয়স একটু কমিয়ে বলতেন ইস্কুলে। কিন্তু আমার বাবা বলে কথা, বয়স সবারই এক
দু বছর বাড়িয়ে দিয়েছিলেন মাধ্যমিক পরীক্ষার দরখাস্তে। অল্প বয়সে বিয়ে
করেছিলেন, অল্প বয়স বলে বিয়েটা যদি আবার না দেওয়া হয়, নিজের বয়স কয়েক
বছর বাড়িয়ে বলেছিলেন, সেই যে বয়স বাড়াতে শুরু করেছিলেন, বয়স বাড়ানোর
রোগটা বাবার আর যায়নি। নিজের তো বাড়িয়েছিলেন, নিজের ছেলেমেয়েদের বয়সও
বাড়িয়েছিলেন। ইস্কুলে কিন্তু আমাকে পাঁচ বছর বয়স হলে পাঠাননি। তিন বছর
বয়স হতেই চ্যাংদোলা করে ক্লাস থ্রিতে নিয়ে বসিয়ে দিয়েছিলেন। আমারও ফট
করে বয়স বলে দেওয়ার স্বভাব আছে। তবে দাদার মতো ওই প্লাসটা বলি না আমি। ওই
যে লোকে বলে, মেয়েরা বয়স বলে না, কথাটা তো ঠিক নয়। বরং আমার পরিবারের
বাইরের পুরুষদের আমি কখনও বয়স বলতে শুনিনি, কখনও বললেও দু’তিন বছর কমিয়ে
বলেছে। আসলে পঞ্চাশ হলেও পঞ্চাশ যে হয়েছে, এটা শরীরে মোটেও অনুভব করি না,
সে কারণেই সম্ভবত বিশ্বাস হয় না যে পঞ্চাশ হয়েছে।
মেয়েরা যত বয়স বাড়ে তত সাহসী হয়, ছেলেরা যত বয়স বাড়ে তত ভীরু হয়।
মেয়েরা যৌবনে সাতপাঁচ ভাবে, এগোবে কী এগোবে না ভাবে, ছেলেরা ডেয়ারিং
যৌবনে, যত যৌবন ফুরোতে থাকে, তত একশ একটা দ্বিধা আর ভয় আর সাত পাঁচ ভাবার
মধ্যে খাবি খেতে থাকে। টুয়েনটিজএ সেক্স নিয়ে বড় সংকোচ ছিল আমার,
থার্টিজেও ছিল। চল্লিশের পর থেকে সেই সংকোচটা ধীরে ধীরে দূর হয়েছে। হরমোন
টরমোন ফুরিয়ে গেলে কী রকম অনুভব করবো জানি না। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে
সঙ্গে আর যা কিছু বাড়ে, সেগুলো তো দুদ্দাড় উপভোগ করে যাবো, যেমন অভিজ্ঞতা
বাড়া, বুদ্ধি বাড়া, বিচক্ষণতা বাড়া, ব্ল্যাক এণ্ড হোয়াইটে না দেখাটা
বাড়া, কমপ্লেক্সিটি বোঝার ক্ষমতা বাড়া, জীবন সম্পর্কে জ্ঞানটা বাড়া।
চূড়ান্ত ভালো দিকটা এখন হাতের মুঠোয়। তবে সঙ্গে নিগেটিভ যে জিনিসটা
আছে, সে হলো আমি সাভান্ত নই, মনে রাখার ক্ষমতা আগের চেয়ে কম। ভুলে
যাওয়াটা আগের চেয়ে, লক্ষ্য করেছি বেশি। পনেরো বছর বয়সে, মনে আছে, একটা
সিনেমা দেখে এসে আমাদের এক প্রতিবেশির কাছে পুরো সিনেমাটা বর্ণনা করেছিলাম,
প্রতিটা সংলাপ, প্রতিটা অ্যাকশন, হুবুহু। আর এখন একটা সিনেমা দেখার
মাসখানেক পর দেখা যায় নামটাই ভুলে গেছি সিনেমার। অনেক সময় এমন হয়, কোনও
সিনেমা দেখছি, কিছুটা দেখার পর বুঝি যে এ আমি আগে দেখেছি। আর, মানুষের নাম
ধাম ভুলে যাওয়ার বাতিক আমার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। নির্বাসিত জীবনে
শত শত মানুষের সঙ্গে শত শত শহরে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, পরে যখন ওদের
সঙ্গে আবার কোথাও দেখা হয়, ওরা সব হেসে এগিয়ে এসে বলে আমাদের দেখা
হয়েছিল আগে। বড় অপ্রতিভ বোধ করি। ভুলে যাই বলে মাঝে মাঝে আশংকা হয় আমার
বুঝি আলজাইমার রোগটা না হয়েই যাবে না।
আমার পরিবারে কারও আলজাইমার ছিল না বা নেই। বন্ধুরা সান্ত্বনা দিয়ে
বলে, আমার আসলে এত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে যে সবাইকে মনে রাখাটা সম্ভব
নয়। কেউ কেউ বলে, আমার সিলেকটিভ আলজাইমার, মনে রাখার যেটা সেটা ঠিকই মনে
রাখছি, ভুলে যাওয়ার গুলো ভুলে যাচ্ছি।
সাংবাদিক এবার জিজ্ঞেস করলেন, আমি মোবাইলের নতুন নতুন টেকনোলজি ব্যবহার
করি কি না। পঞ্চাশে মানুষের জীবন শুরু হয়, আধুনিক টেকনোলজি ব্যবহার করে
রীতিমত নার্ড বা টেকি বনে যায়। বললাম, আমি খুবই কমই মোবাইল ফোন ব্যবহার
করি। অত টেকি নই। কিন্তু মাল্টিটাস্কিং খুব চলে। চব্বিশ ঘন্টা কমপিউটার
ব্যবহার করি। হয় ডেস্কটপ, নয় ল্যাপটপ, নয় আইপ্যাড, নয়তো আই ফোন। কিছু
না কিছু হাতে থাকেই। সেই নব্বই সাল থেকে কমপিউটারে লিখছি, আমার বইগুলো সব
আমারই কম্পোজ করা। লেখালেখির জন্য যতটা টেকি হওয়ার প্রয়োজন, ততটাই আমি।
তবে খেলাখেলির জন্য যতটা দরকার, ততটা নই। সোশাল নেটওয়ার্ক ইউজ করি।
টুইটারে প্রচণ্ড উপস্থিতি আমার। ফেসবুকে অতটা না হলেও আছে। আসলে ফেসবুকে
লোকে আমার নামে এত ফেইক অ্যাকাউণ্ট খুলে রেখেছে যে ফেসবুকে যেতেই রাগ হয়।
ব্লগ লিখি, ইংরেজিতে, বাংলায়।
একটা ওয়েবসাইট আছে, আপডেট করাটা কম হয়। কমপিউটারে মূলত লেখা পড়ার
কাজটাই করি। তবে ইন্টারনেটকে, সত্যি কথা বলি, লাইফ সাপোর্ট বলে মনে হয়।
বইয়ের লাইব্রেরিকেও যেমন মনে হয়। ঘর ভর্তি বই থাকবে না, দরকার হলে একটা
বই উঠিয়ে নিতে পারবো না, ভাবলেই বুকে ব্যথা হতে থাকে। বেশ আছি কিনা। বেশ
আছি। ঘরে অসম্ভব বুদ্ধিমতি একটা বেড়াল। মাঝে মাঝে বুদ্ধিদীপ্ত কিছু
মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, কথা টথা হয়। কলকাতা থেকে বছরে দু’বার বন্ধুরা এসে
ক’দিন করে কাটিয়ে যায়। বিদেশের বিদ্বৎজনের সঙ্গে কনফারেন্সে, সেমিনারে
মত বিনিময় হয়। মৌলবাদী, নারীবিদ্বেষী, ছোটমনের হিংসুক লোকেরা শত্রুতা করে
ঠিক, তবে বড় মানুষের কাছে সম্মান প্রচুর পাই। বেশ আছি। বয়স হচ্ছে, এ
নিয়ে দুঃখ করে তো লাভ নেই। আমি যেমন বিশ্বাস করি না পঞ্চাশে জীবনের শুরু,
এও বিশ্বাস করি না পঞ্চাশেই জীবনের শেষ। তবে কোনও বয়সই মন্দ নয়।
আমরা ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে যাচ্ছি, এই জীবনের পরে আর কোনও জীবন নেই,
জীবন একটাই, আর চাইলেও কোনওদিন জীবন ফেরত পাবো না বলেই বয়স হয়ে যাওয়া
বয়সগুলোকে মেনে নেওয়া এবং বয়সগুলোকে সে যে বয়সই হোক না কেন সেলেব্রেট
করা উচিত। এই উচিত কাজটি বা ভালো কাজটিই যথাসম্ভব করতে চেষ্টা করি। ধীরে
ধীরে অসুখ বিসুখ হবে, অথবা হঠাৎ করেই, মরে টরে যাবো, এ হচ্ছে অপ্রিয় সত্য।
কিন্তু প্রিয় সত্যও তো আছে। জন্মেছিলাম বলে, কিছুকাল বেঁচেছিলাম বলে এই
মহাবিশ্বকে জানতে পারছি, কোথায় জন্মেছিলাম, কেন, চারদিকে এত সহস্র কোটি
গ্রহ নক্ষত্র, ওরা কোত্থেকে এলো, কী করে এই বিশাল বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে এত
কিছুর মেলা, এত কিছুরই বা খেলা কেন, কী করে আবর্তিত হচ্ছে, কী করে প্রাণের
সৃষ্টি, কেন বিবর্তন, কী করে মানুষ আর তার ইতিহাস এগোলো! না জন্মালে এসব
জানা থেকে, এসব দেখা থেকে, এসব বোঝা থেকে, এসবের রহস্য আর রস আস্বাদন থেকে
তো বঞ্চিত হতাম। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু কবিতার মতো সুন্দর। সত্যের
চেয়ে সুন্দর আর কিছু নেই। ছোটবেলা থেকে মিথ্যে একেবারে সইতে পারিনি।
সত্যের মধ্যেই দেখেছি অগাধ সৌন্দর্য। জীবন যতক্ষণ, ততক্ষণ জীবনটাকে যাপন
করবো, জীবনের উৎসব করবো। বেঁচে থাকার মতো চমৎকার আর কী আছে! তবে বেঁচে আছির
চেয়ে কী করে বেঁচে আছি, সেটা বড় ব্যাপার। অন্ধত্ব, কুসংস্কার, হিংসে,
ঘৃণার মধ্যে বেঁচে থাকাটাকে আমি খুব ভালোভাবে বেঁচে থাকা বলি না।
কোয়াইলিটি লাইফ বলি না। কেউ কেউ নিজের জন্য শুধু ষ্ফূর্তি আর শুধু আনন্দ
করাটাতেই ভেবে নেয় বেঁচে থাকার সার্থকতা, কেউ মনে করে কাড়ি কাড়ি টাকা
উপার্জন করাটাই সব, কেউ আবার ভাবে অন্যের জন্য ভালো কিছু করলে জীবন
অর্থপূর্ণ হয়। কেউ কেউ পরিবারের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে জীবনে
সার্থকতা আনে। এই মহাবিশ্বের কিছু যায় আসে না আমাদের ছোট ছোট জীবনের ছোট
ছোট সার্থকতায় বা ব্যর্থতায়।
তবে আমরা ভেবে তৃপ্তি পাই যে আমরা সার্থক। পথ চলায় এই তৃপ্তিরও হয়তো
প্রয়োজন আছে। এ আমাদের চলায় প্রাণ দেয়, চলার গতিতে ছন্দ দেয়। কখনও
ভাবিনি পঞ্চাশ হবো। একসময় কুড়ি বা তিরিশ হওয়াকেই সবচেয়ে বয়স হয়ে
যাওয়া বলে ভাবতাম। এখন পঞ্চাশে এসে মনেই হয় না যে বয়স হয়েছে। আবার মাঝে
মাঝে মনে হয়, যেন হাজার বছর ধরে বেঁচে আছি। বয়স চুলে হয় না, ত্বকে হয়
না, বয়স মনে হয়। আমার এখনও মনের বয়স একুশ। একুশ! একটু ক্লিশে হয়ে গেল
না! হলো না, কারণ একুশ বলতে একুশ বছর বয়সী শরীরও বোঝাইনি, ভুল করা আর
হোঁচট খাওয়ার বয়সও বোঝাইনি, একুশ বলতে চারদিকের অসংখ্য অজানাকে জানার
ব্যাকুলতা, আর অদম্য আগ্রহের বয়সটাকে বুঝিয়েছি।
COMMENTS