গণব্রডব্যান্ড ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ সম্ভব নয়। ডিজিটাল বাংলাদেশে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের পরেই ব্রডব্যান্ড হবে জনগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার। এই অধিকার পূরণের অন্যতম ধাপ প্রযুক্তিপ্রেমী মানুষের কাঙ্খিত তৃতীয় প্রজন্মের মোবাইল ইন্টারনেট সেবা থ্রিজি। তথ্য স্থানান্তরে অবাধ স্বাধীনতা নিয়ে দেশের মানুষের সবকিছুই বদলে দেবে এ প্রযুক্তি। গত পাঁচ বছরের জল্পনা-কল্পনা শেষে গত রোববার রাজধানীর এক হোটেলে আয়োজিত নিলামের মাধ্যমে সুচনা হলো থ্রিজির। বাংলাদেশের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ট্রান্সপোর্টের একমাত্র সমাধান এটি।
থ্রিজি প্রযুক্তি: আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন সংস্থা বা আইটিইউ-এর সংজ্ঞানুসারে, কোনো তারের সংযোগ ছাড়াই মোবাইল পরিবেশের মাধ্যমে কোনো বড় এলাকাজুড়ে যে ওয়্যারলেস ভয়েস টেলিফোন, মোবাইল ইন্টারনেট অ্যাকসেস, ভিডিও কল এবং মোবাইলে টিভি দেখাসহ বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন সেবা দেয়া হয় তাকে থ্রিজি ইন্টারনেট সেবা বলে। এক কথায় থ্রিজিকে মোবাইল ভিডিওকল ও মোবাইল ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ট্রান্সপোর্টার নেটওয়ার্কও বলা যেতে পারে।
থ্রিজি প্রযুক্তির সুবিধা : দ্রুতগতিতে তথ্য পরিবহন করাটাই থ্রিজির কাজ। থ্রিজি প্রযুক্তি কার্যকর থাকলে একটি সাধারণ থ্রিজি সমর্থিত মোবাইল হ্যান্ডসেটের মাধ্যমে ভয়েস সুবিধার পাশাপাশি ব্যবহারকারী ভৌগোলিকভাবে যে অবস্থানেই থাকুক না কেন উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন। এর আওতায় শহর হোক আর গ্রামেরই হোক একজন মানুষ সবসময় সবখানে বসে সারাবিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সব ধরনের তথ্য অতি সহজেই আদান-প্রদান করতে পারেন। থ্রিজি প্রযুক্তির মাধ্যমে অনায়াসে টিভি দেখা, খেলা দেখা, ভিডিও ক্লিপস আদান-প্রদান সবই সম্ভব। একজন ব্যবহারকারী থ্রিজি সাপোর্টেড মোবাইল সেটের সাহায্যে ভিডিও কনফারেন্স করতে পারেন। বিনোদনের ক্ষেত্রে এটি অদ্বিতীয়। ভিডিও, টেলিফোন, পাওয়ারফুল ক্যামেরা, ইমেজ এডিটিং, ব্লগিং, ভিডিও কল, মুভি ট্রান্সফার সবই সম্ভব।
দেশে দেশে থ্রিজি সেবা : ১৯৭৯ সালে জাপানে ১জি প্রথম প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক স্থাপনের মাধ্যমে জেনারেশন প্রযুক্তির যাত্রা শুরু। এরপর ২০০১ সালের মে মাসে জাপান সরকার প্রথম সে দেশে এই ২.৫/২.৭৫ জি মোবাইল নেটওয়ার্ক আপগ্রেড করে থ্রিজি মোবাইল নেটওয়ার্ক স্থাপন করার অনুমতি দেয়। পরবর্তী দুই তিন বছরের মধ্যেই ধনী দেশগুলোর সরকারের কাছ থেকে মোবাইল অপারেটরেরা তাদের নেটওয়ার্ক আপগ্রেড করার অনুমতি লাভ করে যা ২০০৬ থেকে ২০০৭ সালে এসে ৩ দশমিক ৫ জি বা ইউনিভার্সাল মোবাইল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম হাই স্পিড ডাউনলিংক প্যাকেট এ্যাক্সেস এ আপগ্রেড করে। শুধু যে ধনী দেশেগুলোতেই মোবাইল নেটওয়ার্কে এই আপগ্রেডেশন হচ্ছে তাই নয় থ্রিজিতে আপগ্রেডেশনের এই অনুমোদন আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোসহ তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের সরকার ২০০৮ সালের মধ্যে দিয়ে দিয়েছে। গত ২০০৬ সালের জুনে শ্রীলঙ্কা, ২০০৮ সালের ৯ জুলাই বার্মা বা মিয়ানমার, ৬ মে ভুটান, একইমাসে পাকিস্তান ও নেপাল, ফেব্রুয়ারিতে মালদ্বীপ এবং ২০০৯ সালের অক্টোবরে ভারত সরকার তাদের দেশের মোবাইল ইন্টারনেট সেবার থ্রিজিতে আপগ্রেডেশনের অনুমোদন দেয়।
বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় থ্রিজি সেবা : আমাদের দেশে সাশ্রয়ী দামের অনেক স্মার্টফোনেই থ্রিজি ব্যবহারের সুবিধা রয়েছে। তবে দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো ফিচার ফোন ব্যবহার করছে। বিটিআরসির সম্প্রতি দেয়া এক তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে জুন মাস পর্যন্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি ৫০ লাখ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্রাহক গ্রামীণফোনের। প্রায় চার কোটি ৩৯ লাখ ৬৭ হাজার গ্রাহক রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। এরপর দুই কোটি ৭০ লাখ ৭৬ হাজার গ্রাহক নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলালিংক। এছাড়া দুই কোটি ২৮ লাখ ৯৭ হাজার রবি, ৭৮ লাখ ২১ হাজার এয়ারটেল, ১৯ লাখ আট হাজার টেলিটক এবং ১৩ লাখ ৮৩ হাজার সিটিসেল গ্রাহক রয়েছে।
বিটিআরসির তথ্য মতে, দেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় তিন কোটি ৫৬ লাখ ৩১ হাজার ২৬৯। এর মধ্যে মোবাইল ফোনে তিন কোটি ৩৯ লাখ চার হাজার গ্রাহক ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। পাঁচ অপারেটরে থ্রিজির সুবিধা যুক্ত হওয়ায় মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যাও এখন দ্রুত বাড়বে।
দেশের মোবাইল কোন জেনারেশনের: থ্রিজি হচ্ছে এই মোবাইল নেটওয়ার্কের থার্ড জেনারেশন মোবাইল টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশে আমরা ২০১০ সালেও যে ধরনের মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছি একে অন্তত দশ বছর আগের ২ দশমিক ৫জি/ (জিপিআরএস) বা ২ দশমিক ৭৫ জি নেটওয়ার্ক দাবি করা হয়। সহজে নেটওয়র্কের এই আপগ্রেডেশনকে এভাবে দেখা যায়, শুরুতে ২জি, ২ দশমিক ৫জি, ২ দশমিক ৭৫জি।
একই লাইসেন্সে দেশের থ্রিজি ও ফোরজি সেবা : থ্রিজির জন্য বরাদ্দ তরঙ্গের আওতায় ফোরজিরও লাইসেন্স পাচ্ছেন মোবাইল অপারেটররা। থ্রিজি তরঙ্গ বরাদ্দের লাইসেন্স নিয়ে চতুর্থ প্রজন্মের (ফোরজি) সেবা দিতে পারবে প্রতিষ্ঠানগুলো। ফোরজির জন্য আলাদা লাইসেন্স নিতে হবে না। ফোরজি চালু হলে থ্রিজির চেয়ে আরও দ্রুতগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সেবা পাওয়া যাবে।
অক্টোবরেই থেকেই চালু হচ্ছে থ্রিজি: অক্টোবরের শুরুতেই ঢাকা ও চট্টগ্রামের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় তৃতীয় প্রজন্মের মোবাইল প্রযুক্তি (থ্রিজি) সেবা চালুর ঘোষণা দিয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন। অক্টোবরের শুরুতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের কিছু এলাকায় থ্রিজি সেবা চালু করার পর নভেম্বরে ঢাকা জেলার অন্যান্য অংশ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে যাবে গ্রামীণফোন। পাশাপাশি ডিসেম্বরের মধ্যে সাত বিভাগীয় শহরেই গ্রামীণফোনের থ্রিজি সেবা চালু করা সম্ভব হবে বলে জানান গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিবেক সুদ। একইসঙ্গে আগামী বছর মার্চের মধ্যে সারাদেশে থ্রিজি সেবা দেয়া যাবে বলে তিনি জানান। একইসঙ্গে শিগগিরই অন্য তিন অপারেটর বাংলালিংক, রবি ও এয়ারটেল দেশে থ্রিজি সেবা নিয়ে আসবে।
দেশে প্রথম থ্রিজি চালু করে টেলিটক: বাংলাদেশে প্রথম পরীক্ষামূলক থ্রিজি নেটওয়ার্কের যাত্রা শুরু করে রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিযোগাযোগ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান টেলিটক। গত বছরের ১৪ অক্টোবর এক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে টেলিটকের থ্রিজি সেবার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে পরীক্ষামূলক কয়েকটি বিভাগীয় শহরে চালু করা হয় থ্রিজি সেবা। এ সেবা জেলা শহরে সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ৪ কোটি ডলারের একটি মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে টেলিটক। প্রাথমিকভাবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ ৬টি শহরে থ্রিজি সেবা চালুর পর এবার রাজশাহী, বরিশাল ও খুলনাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে মোবাইল ফোনে থ্রিজি সেবা চালু করছে টেলিটক।
থ্রিজি সেবার খরচ: এদিকে এখন পর্যন্ত থ্রিজি সেবার প্যাকেজের কোন মূল্য ঘোষণা করেনি মোবাইল অপারেটরগুলো। এ নিয়ে অপারেটরগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে আগে থেকেই। খরচের বিষয়টি এখনই প্রকাশ করতে চাইছে না কোনো অপারেটর। তবে টেলিটকের এক কর্মকর্তার মতে, টেলিটক অনেক সাশ্রয়ী ডেটা প্যাকেজ দিচ্ছে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও থ্রিজি সেবার ক্ষেত্রে আরও সাশ্রয়ী ডেটা প্যাকেজ দেয়া উচিত। কম খরচে থ্রিজির উন্নত সেবা দিতে পারলে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার চেয়ে বাজার বাড়বে দ্রুত।
- এনামুল হক মনি
COMMENTS