গ্যাস নিয়ে শুরু হয়েছে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র


রাষ্ট্রীয় সম্পদ প্রাকৃতিক গ্যাস নিয়ে চলছে দেশী-বিদেশী ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র। দেশের শিল্প-কারখানা বিশেষ করে গার্মেন্ট ও টেক্সটাইল খাতকে ধ্বংস করতে গভীর ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে গ্যাসসম্পদ নিয়ে। বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে পর্যাপ্ত গ্যাস থাকার পরও ষড়যন্ত্রকারী এ চক্রটি কিছুদিন পরপর দেশব্যাপী গ্যাসের কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। আর এটা বেশি করা হচ্ছে দেশের শিল্প-কারখানাকেন্দ্রিক এলাকাগুলোতে। বিশেষ করে গাজীপুর, জয়দেবপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম জেলার কিছু কিছু এলাকায় এ সংকট তীব্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস নিয়ে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে বছরে হাজার কোটি টাকার খেলা হচ্ছে।



এই টাকার ভাগবাটোয়ারা হচ্ছে খোদ জ্বালানি মন্ত্রণালয়, পেট্রোবাংলাসহ বিতরণ কোম্পানি তিতাস, বাগরাবাদ, কর্ণফুলী, জালালাবাদ, পশ্চিমাঞ্চল, সুন্দরবনের একটি শক্তিশালী দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের মধ্যে। গ্যাস উৎপাদন কেন্দ্র বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড, বাপেক্স, সিলেট গ্যাসফিল্ডের অনেক রাঘববোয়ালও এ সিন্ডিকেটের সদস্য। যার কারণে প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তিরাও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। শিল্প-কারখানার মালিকরা বলছেন, চলতি মাসে পেট্রোবাংলা কর্তৃপক্ষ গ্যাস উৎপাদন ২ হাজার ৩১০ মিলিয়ন ঘনফুট ছাড়িয়ে যাওয়ার পর মিষ্টি বিতরণ করেছিল। কিন্তু এক সপ্তাহ যেতে না যেতে গ্যাসের তীব্র সংকট হতবাক করে তুলেছে সবাইকে। প্রশ্ন উঠেছে তাহলে এত গ্যাস যাচ্ছে কোথায়?

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি গ্যাস সংকটের আরেকটি কারণ হল ভয়াবহ গ্যাস চুরি। গত কয়েক মাসে রাজধানীসহ সারাদেশে ছেয়ে গেছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ। দালাল ঠিকাদার, তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারী আর একশ্রেণীর অসাধু ব্যক্তি মিলে এ অবৈধ কারবার করছে। তিতাসের দুর্নীতিবাজদের সহযোগিতায় শিল্প-কারখানাগুলোতে ছোট ছোট কমপ্রেসার বসিয়ে অবৈধভাবে গ্যাস টেনে নিচ্ছে। অনুমতি না থাকলেও সিএনজি স্টেশনগুলো যানবাহন ছাড়াও বোতলজাত করে গ্যাস বিক্রি করছে।

সরেজমিন রাজধানী ও আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাসাবাড়ি, শিল্প-কারখানাজুড়ে সর্বত্র তীব্র গ্যাস সংকট। বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে কল-কারখানার চাকা। গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় রোববার দুপুর ১২টার পর থেকে গাজীপুর, কালিয়াকৈর, জয়দেবপুর এলাকার ২শ’ গার্মেন্ট কারখানা ছুটি দিতে হয়েছে। সিএনজি স্টেশন আর রান্নাকর্মেও চরম ভোগান্তি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে গ্যাস সংকটের কারণে যে কোনো সময় এসব এলাকার শিল্প-কারখানার চাকা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ অবস্থা সরকারের শেষ সময়ে এসে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিকেও পেছনে ফেলে দেবে। আর দেশীয় গার্মেন্ট শিল্পের অধিকাংশ অর্ডার চলে যাবে পার্শ্ববর্তী দেশসহ অন্যান্য দেশে। ফলে লাখ লাখ শ্রমিক-কর্মচারী চাকরি হারাবেন। বেকার হবেন। তবে পেট্রোবাংলা কর্তৃপক্ষ বলেছে, এ সংকট সাময়িক। তাদের মতে, কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্রে সংস্কার কাজ চলার কারণে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন কমে গেছে। মাসখানেকের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। বর্তমানে সব মিলিয়ে ১৭১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি পূরণের জন্য এর মধ্যে কয়েকটি এলাকা থেকে গ্যাস রাজধানীতে সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে ঘাটতি থাকলেও গ্রাহকদের ভোগান্তি কমে যাবে।

তবে গ্যাস সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা এ তথ্য মানতে নারাজ। তারা বলেছেন, হঠাৎ করে তৈরি করা এ সংকট কৃত্রিম। এটা দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশের শিল্প-কারখানা বন্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র। তারা বলেছেন, গ্যাসের চাপ বেড়ে যাওয়ায় সরকার যখন বাসাবাড়িতে সংযোগ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে তখন গ্যাসের সংকটের কথা নিছক ষড়যন্ত্র। বর্তমান সরকারের আমলে এ পর্যন্ত সাড়ে ৬শ’ কোটি ঘনফুটেরও বেশি গ্যাস উৎপাদন হয়েছে। পাইপলাইনে আরও বিপুলসংখ্যক গ্যাসের জোগান রয়েছে। কাজেই পর্যাপ্ত গ্যাস থাকার পরও দেশী বিদেশী একটি চক্র গ্যাসের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দেশের শিল্প-কারখানা বন্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের শিল্প-কারখানা বন্ধ করে দিয়ে অন্য দেশে কাজের অর্ডার বাড়ানো।

কারখানা মালিকরা বলছেন, বর্তমানে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অর্ধেকও পাওয়া যাচ্ছে না। এতে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান। আবার অনেক কারখানা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ উৎপাদন করে ধুঁকে ধুঁকে চলছে। এ অবস্থায় শিল্প খাতে নতুন বিনিয়োগ তো হচ্ছেই না বরং বিদ্যমান উৎপাদন বিপর্যয় ঠেকাতেই হিমশিম খাচ্ছেন শিল্পপতিরা।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সারাদেশের ২৩টি গ্যাসক্ষেত্রের ৮৪টি কূপ থেকে গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে ২ হাজার ৩১০ মিলিয়ন ঘনফুট। যদিও এসব কূপের উৎপাদন ক্ষমতা ২ হাজার ৪শ’ মিলিয়ন ঘনফুট। এ হিসাব সরকারের। শিল্প-কারখানার মালিকদের সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা ২৫শ’ মিলিয়ন ঘনফুট। ঘাটতি মাত্র ১৯০ মিলিয়ন ঘনফুট। প্রশ্ন উঠেছে তাহলে দেশব্যাপী গ্যাসের চাপ এভাবে কমে যাওয়ার কারণ কী? তিতাস গ্যাস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী নওশাদ ইসলাম বলেন, তিতাস এলাকায় প্রায় দুই কোটি ঘনফুট গ্যাস কম সরবরাহ করা হচ্ছে। তা সাময়িকভাবে করা হচ্ছে। কিছুদিন পর আবার ঠিক হয়ে যাবে।

আমাদের প্রতিনিধি জানান, তীব্র গ্যাস সংকটের কারণে গাজীপুর ও কালিয়াকৈর এলাকার অধিকাংশ শিল্প-কারখানা রোববার দুপুর ১২টার পর বন্ধ করে দিতে হয়েছে। শিল্প-কারখানার পাশাপাশি চাপ কমে গেছে সাধারণ গৃহস্থালি রান্নাবান্নার চুলা ও সিএনজি স্টেশনে। এ কারণে সিএনজি স্টেশনগুলোতে গাড়ির দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে দিনভর। শিল্প-কারখানার মালিকরা জানিয়েছেন, গাজীপুর জেলা শিল্পসমৃদ্ধ এলাকাগুলোতে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে গত কয়েকদিন ধরে উৎপাদন অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। রোববার সেই চাপ একদম শূন্যতে নেমে আসে। গাজীপুর সদরের ভোগড়া, বাইপাস, বাসন সড়ক, ছয়দানা মালেকের বাড়ি, বোর্ডবাজার, সাইনবোর্ড, টঙ্গী শিল্প এলাকা, কোনাবাড়ী, মৌচাক, সফিপুর, কালিয়াকৈরসহ ওই সব এলাকার বাসিন্দারা জানান, সকাল ১০টা থেকে তিন-চার ঘণ্টা এবং সন্ধ্যার পর থেকে কয়েক ঘণ্টা গ্যাসের চাপ একদম থাকে না। গাজীপুর সদরের একটি পিভিসি পাইপ তৈরির কারখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৭টা পর্যন্ত গ্যাসের কোনো চাপ না থাকায় ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত তাদের জেনারেটর বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ফলে কারখানার শ্রমিকরা বসে থেকে সময় কাটাচ্ছে। কয়েকটি কারখানার মালিকরা জানান, কারখানার জেনারেটর চালাতে যে পরিমাণ চাপ থাকার কথা পরিমাণের তুলনায় তা অনেক কম হওয়ার কারণে জেনারেটর চালানো যাচ্ছে না। গ্যাসের মেইন লাইনে ১৫০ থেকে ২৫০ পিএসআইর মতো চাপ থাকে কিন্তু এ চাপ অনেক সময় ৮-১০ পিএসআইয়ে নেমে আসে। আর এ অবস্থা দিনে অন্তত ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা থাকে।

গ্যাসের চাপ না থাকার কারণে গ্যাসনির্ভর শিল্প-কলকারখানা এবং পোশাক শিল্প মালিকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ঠিকমতো অর্ডার সরবরাহ করতে না পারার কারণে অনেক পোশাক শিল্প মালিক ও পোশাক কারখানার মালিক নতুন করে অর্ডার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শিল্প মালিকরা জানান, গ্যাসের চাপ আগের তুলনায় গত কয়েকদিন অনেক কমে গেছে। গ্যাস সেক্টর নিয়ে দুর্নীতি এবং অনিয়ম আর দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষ গ্যাসের দিকে কোনো নজর দিচ্ছে না। তাদের মতে, বর্তমানে যে পরিমাণ বৈধ কারখানা আছে তার চেয়ে অবৈধ কারখানাগুলোতে গ্যাস সংযোগ দেয়া হচ্ছে বেশি। এসব কারখানায় কি পরিমাণ গ্যাস যাচ্ছে তার কোনো হিসাব নেই বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে। এতে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণেও এ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে বলে তাদের ধারণা।

এ ব্যাপারে গাজীপুর তিতাস গ্যাসের জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী আবদুল ওয়াদুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো তথ্য দিতে অস্বীকার করেন। তিনি তিতাস গ্যাসের প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। তবে অন্য একটি সূত্র জানায়, গাজীপুর এলাকায় কাগজে-কলমে গ্যাসের চাপের কোনো সমস্যা নেই। জানা গেছে স্থানীয় তিতাস গ্যাস অফিস অবৈধ সংযোগগুলোতে গ্যাস দেয়ার কারণে বৈধ সংযোগগুলোতে গ্যাসের সমস্যা হচ্ছে। অবৈধ সংযোগ থেকে প্রতিদিন তাদের কোটি কোটি টাকা আয় হচ্ছে। স্থানীয় তিতাস অফিসের একটি সূত্র জানায়, সঞ্চালন লাইনে সমস্যা এবং গ্যাসফিল্ডে সমস্যা থাকার কারণে কয়েকদিন ধরে অনেক সময় গ্যাসের চাপ কম থাকে।

গ্যাস নেই তো বিদ্যুৎ নেই : গ্যাসের চাপ না থাকার সঙ্গে নতুন যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়েছে বিদ্যুৎ নিয়ে। ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আর শিল্প-কারখানার মালিকদের জেনারেটর দিয়ে কারখানার উৎপাদন সচল রাখতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ অতিরিক্ত গচ্চা দিতে হচ্ছে। প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অনেক স্থানে ৬ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকছে না বলে অভিযোগ করেন শিল্প মালিক ও এলাকার সাধারণ মানুষ। গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির একজন কর্মকর্তা জানান, গাজীপুরে ১৮৫ থেকে ১৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজন। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে ১৫০ থেকে ১৭০ মেগাওয়াট। কড্ডা বিদ্যুৎ কেন্দে উৎপাদন বন্ধ থাকলে অনেক সময় লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বেড়ে যায়। আবার কোনো ফিডারের সংস্কার কাজ করা হলেও বিদ্যুৎ বন্ধ থাকে। গ্রাহকদের অভিযোগ, প্রতিদিন অন্তত ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা করে লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ছেন তারা। অনেকে তাদের কারখানার জেনারেটর ও বাসাবাড়ির আইপিএসও বিদ্যুৎ সরবরাহ করে কভার করতে পারছে না। গ্যাস-বিদ্যুতের এ নাকাল অবস্থা থেকে এ অঞ্চলের শিল্প-কারখানার মালিক ও সাধারণ গ্রাহকরা মুক্তি চান।

গাজীপুর সদরের কোনাবাড়ী, কাশিমপুর কালিয়াকৈর উপজেলার তেলিরচালা, মৌচাক, ভান্নারা, সফিপুর, নিশ্চন্তপুর, চন্দ া পল্লীবিদ্যুৎ, চান্দরা, বাড়ইপাড়া এলাকায় প্রায় ৭ থেকে ৮শ’ শিল্প-কারখানা রয়েছে। গ্যাসের তীব্র সংকটে উৎপাদনমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধের উপক্রম হয়েছে। গ্যাস সংকটের কারণে ডাইং, কম্পোজিট, টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, কটন মিল, স্পিনিং মিলসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কারখানাগুলো সূত্রে জানা যায়, গ্যাসের চাপ না থাকায় কারখানার নিজস্ব জেনারেটরগুলো চালানো যাচ্ছে না। কোনো কোনো কারখানায় জেনারেটর লাইনে গ্যাসের প্রেসার নেই বললেই চলে। উপজেলার বিভিন্ন কারখানার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত গ্যাসের কোনো প্রেসার থাকে না। গ্যাসের প্রেসার কম থাকায় কারখানার একমাত্র ভরসা গ্যাস জেনারেটর বন্ধ হয়ে যায়। ফলে কারখানার বেশির ভাগ মেশিন বন্ধ রেখে কিছু কিছু মেশিন চালু রাখতে হয়। এতে করে কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং সময়মতো কারখানার মাল সরবরাহ করা যাচ্ছে না। গ্যাসের চাপ কম থাকায় কোনো কোনো কারখানায় উৎপাদিত পণ্য ফিনিশিং হয় না। গ্যাসের কারণে জেনারেটরেও সমস্যা দেখা দেয়।

কারখানাগুলো উৎপাদন করতে না পারায় তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। কোনো কোনো কারখানায় ৮ গুণ বেশি মূল্যে ডিজেল দিয়ে জেনারেটর চালাতে হচ্ছে। গ্যাস সংকটের কারণে কোনো কোনো কারখানায় রেশনিং করে মেশিন চালাতে হচ্ছে। ফলে উৎপাদন খরচ ১০ গুণ বেড়ে যাচ্ছে। বায়ারদের চাহিদা অনুপাতে শিপমেন্ট সিডিউল রক্ষার স্বার্থে ডাইং নিটিং গার্মেন্ট ইউনিটে রেশনিং করে মেশিন চালাতে হচ্ছে। সিডিউল পেছাতে গিয়ে নির্ধারিত সময়ে উৎপাদন সামগ্রী ডেলিভারি দেয়া যাচ্ছে না। ফলে শিল্প-কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ার পথে। কালিয়াকৈর উপজেলার বিভিন্ন মিল-কারখানায় গ্যাসের কোনো চাপ নেই। গ্যাস সংকটের কারণে কোনাবাড়ীতে বেশ কিছু কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কোনাবাড়ী এলাকার গ্রিনল্যান্ড নিট গার্মেন্ট, এমএম নিট গার্মেন্ট, মধুমতি নিটিং, কোনাবাড়ী ফ্যাশন লিমিটেড, ডেনিম কারখানা, সফিপুর যমুনা গ্র“পের শামিম স্পিনিং, যমুনা স্পিনিং ও শামিম কম্পোজিট কারখানায় গ্যাসের চাপ না থাকায় রোববার বন্ধ রাখতে হয়েছে। এ কারণে একদিনে শত শত কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে কারখানাগুলোতে। জানা গেছে দিনের বেশির ভাগ সময় গ্যাসের মেইন লাইনে প্রেসার পাওয়া যাচ্ছে না। চন্দ্রা এলাকার এপেক্স হোল্ডিং লিমিটেড, এপেক্স স্পিনিং অ্যান্ড নিটিং মিলস লিঃ, এপেক্স লেঞ্জার লিঃ, এপেক্স ইয়াং ডাইং লিঃ ও এপেক্স টেক্সটাইল প্রিন্টিং মিলস লিমিটেডে একই অবস্থা বিরাজ করছে। এছাড়া পল্লী বিদ্যুৎ এলাকার ইন্টারস্টফ, ডিভাইন টেক্সটাইল, আয়মন টেক্সটাইল, ট্রপিক্যাল কারখানা, চন্দ া এলাকার নুরুল ওয়্যার, নায়গ্রা টেক্সটাইল, মাহমুদ ডেনিমস, ফারইস্ট ফেয়ারট্রেড, নিটএশিয়া, সাদমা ফ্যাশন, করতোয়া স্পিনিং মিল, জমজম স্পিনিং মিল, বাংলাদেশ থাই অ্যালুমিনিয়ামসহ বিভিন্ন কারখানায় গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

ভান্নারা এলাকার ফারুক নিটিং অ্যান্ড ডাইং কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আকবর হোসেন পাঠান ফারুক জানান, ৩ কোটি টাকা দিয়ে ৩ বছর আগে একটি জেনারেটর ক্রয় করেছেন। গ্যাসের সমস্যার কারণে ওই জেনারেটরটি অদ্যাবধি চালু করতে পারিনি। কারখানা চালাতে গিয়ে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এলসি খুলতে পারছেন না। মনের দুঃখে ৭ দিনে একবার কারখানায় যান। তিনি বলেন, আমাদের দেশে টেক্সটাইল হচ্ছে ভারি শিল্প, সরকার বা অন্য কেউ এ সেক্টরে নজর দেয় না। মূল কাপড় উৎপাদন করে টেক্সটাইল। অথচ এই শিল্পের দিকে কারও নজর নেই।

এপেক্স হোল্ডিং কারখানার এজিএম (এডমিন) আবু নছর মোঃ জাহিদ জানান, বর্তমানে গ্যাসের জন্য খুব সমস্যা হচ্ছে। দ্রুত গ্যাসের ব্যবস্থা না হলে শ্রমঘন শিল্প আদৌ টিকে থাকা সম্ভব নয়।

শামিম স্পিনিং মিলের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মোহাম্মদ হোসেন জানান, তীব্র গ্যাস সংকটে কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। দ্রুত গ্যাস সমস্যার সমাধান দরকার বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় রোববার কারখানা ছুটি দিয়ে দেয়া হয়েছে। মেশিনের চাকা না ঘোরায় শ্রমিকরা অলস বসে দিন কাটিয়েছেন।

ট্রপিক্যাল নিটেক্স লিমিটেডের এডমিন ম্যানেজার রুহুল কুদ্দুস জানান, গ্যাসের চাপ কম থাকায় কারখানায় ফিনিশিং সেকশনে সমস্যা হচ্ছে। গ্যাসের কারণে মাঝে মাঝে বন্ধ রাখতে হয়। জেনারেটরেও সমস্যা দেখা দেয়।

নিট এশিয়া লিমিটেডের এডমিন ম্যানেজার নুরুল্লাহ জানান, গ্যাসের চাপ কম থাকায় কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। প্রেসার কম থাকায় মাঝে মাঝেই সমস্যায় পড়তে হয়। কর্তৃপক্ষকে জানালে তারা বলেন, জাতীয় গ্রিড থেকে চাপ কম বিধায় এ সমস্যা হচ্ছে।

এ ব্যাপারে তিতাস গ্যাস কোম্পানির ঢাকা প্রধান কার্যালয়ের ডিজিএম (অপারেশন) রানা আকবর হায়দারী জানান, ন্যাশনাল কন্ট্রোল থেকে মে মাসের ১৮ তারিখ থেকে ১৬৫ থেকে ২০০ মিলিয়ন গ্যাস কম দিচ্ছে। ফলে গাজীপুরে গ্যাস সরবরাহে সমস্যা হচ্ছে। তবে দু-একদিনের ভেতরে এ সমস্যার সমাধান হবে এবং গাজীপুরে প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ করা যাবে। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় শিল্প উদ্যোক্তারাও নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। ঠিকমতো উৎপাদন না হলেও ব্যাংকের ঋণের কিস্তি দিতে হচ্ছে। আর তাতে হিমশিম খাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। খেলাপি ঋণের সংজ্ঞার পরিবর্তন করায় তা আরও সংকটে ফেলে দিয়েছে উদ্যোক্তাদের। স্পেশাল মেনশন অ্যাকাউন্ট (এসএমএ) হয়ে যাচ্ছে অনেক ঋণ হিসাব। মাত্র ৬০ দিনের ব্যবধানে এসএমএ করার বিধানকে উদ্যোক্তারা অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন। অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কটের পাশাপাশি জ্বালানির দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ ও সরবরাহ খরচ বেড়ে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগেও উদ্যোক্তারা ভরসা পাচ্ছেন না। ফলে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। চাপ সৃষ্টি হচ্ছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে। তাই জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধিকে গুরুত্ব দিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।

এক দেশে দুই নিয়ম : নতুন গ্যাস সংযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে এক দেশে দুই নিয়ম চলছে। বৃহত্তর সিলেটে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কখনোই নতুন গ্যাস সংযোগ প্রদান বন্ধ হয়নি। অন্যদিকে চট্টগ্রামে প্রায় চার বছর ধরে সব ধরনের শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। ঢাকাসহ দেশের কিছু কিছু এলাকায় নতুন সংযোগের অনুমোদন দিলেও অন্য জেলাগুলো এর আওতার বাইরে। গ্যাসের নতুন সংযোগ নিয়ে এই দ্বিমুখী নীতিতে ক্ষুব্ধ সিলেটের বাইরের জনগোষ্ঠী। বিশেষ করে চট্টগ্রামের শিল্প উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা রীতিমতো ক্ষোভে ফুঁসছেন। চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন বারবার সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে আবেদন করেও নতুন গ্যাস সংযোগ পাচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গ্যাস সরবরাহে ঘাটতির কারণেই চট্টগ্রামে নতুন শিল্প ও বাণিজ্যিক সংযোগ দেয়া যাচ্ছে না। বাস্তবে দেখা গেছে এ তথ্য সঠিক নয়। কারণ এসব এলাকায় পর্যাপ্ত গ্যাস থাকলেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে শিল্প-কারখানাগুলোকে বন্ধ করে রাখতে বাধ্য করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বৃহত্তর সিলেটে রেশনিং করে এখনই চট্টগ্রাম ও গাজীপুরের শিল্প-কারখানায় বিপুল পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব। এছাড়া সঞ্চালন লাইন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী কম্প্রেসার স্থাপন করলেও গ্যাসের চাপ বাড়বে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম অঞ্চলে নতুন কূপ খননসহ গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হলেও সুফল আসবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব উদ্যোগ নেয়া হলে বন্দরনগরীসহ দেশের চলমান সংকট অনেকাংশে কমে যেত। কিন্তু সিন্ডিকেট বিদেশী সিন্ডিকেটকে খুশি রাখার জন্য গোপনে আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং করে এটা বাস্তবায়ন করছে না।

COMMENTS





নাম

অর্থ ও বাণিজ্য,237,আন্তর্জাতিক,732,কাপাসিয়া,343,কালিয়াকৈর,418,কালীগঞ্জ,253,খেলা,644,গাজীপুর,3942,চাকরির খবর,34,জয়দেবপুর,1581,জাতীয়,2968,টঙ্গী,912,তথ্যপ্রযুক্তি,512,ধর্ম,196,পরিবেশ,137,প্রতিবেদন,310,বিজ্ঞান,55,বিনোদন,698,ভিডিও,58,ভিন্ন খবর,142,ভ্রমন,115,মুক্তমত,27,রাজধানী,829,রাজনীতি,1057,লাইফস্টাইল,283,শিক্ষাঙ্গন,398,শীর্ষ খবর,10776,শ্রীপুর,481,সাক্ষাৎকার,12,সারাদেশ,649,স্বাস্থ্য,212,
ltr
item
GazipurOnline.com: গ্যাস নিয়ে শুরু হয়েছে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র
গ্যাস নিয়ে শুরু হয়েছে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র
http://2.bp.blogspot.com/-Qju1d_heF9o/Ui5CJPyd3XI/AAAAAAAAA-c/rg5Qjq1bPT8/s400/gas.gif
http://2.bp.blogspot.com/-Qju1d_heF9o/Ui5CJPyd3XI/AAAAAAAAA-c/rg5Qjq1bPT8/s72-c/gas.gif
GazipurOnline.com
https://www.gazipuronline.com/2013/09/gas.html
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/2013/09/gas.html
true
13958681640745950
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Read More Reply Cancel reply Delete By প্রচ্ছদ PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share. STEP 2: Click the link you shared to unlock Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy