রাজীব সরকারঃ কালিয়াকৈরে অর্ধশতাধিক সংসার চালাতে একমাত্র উপায় মাটির তৈরী ব্যাংক। জীবনের তাগিদে সংসার চালাতে একমাত্র পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে এ মাটির তৈরী ব্যাংক। নারীরাও বসে নেই পুরুষদের পাশাপাশি তারাও তৈরী করছে মাটির ব্যাংক। ওজনে ৫কেজি সবচেয়ে বড় তার একটির পাইকারী দাম ২০ টাকা, দেড় কেজি উজনের মাঝারি আকারের ১০ টাকা ও সবচেয়ে ছোট তার পাইকারী দাম ৪ টাকা বিক্রি করা হয়। ওই গ্রামের পুরুষের পাশাপাশি প্রায় সকল নারীরা ব্যাংক তৈরীর কাজে নিজেকে জরিয়ে নিয়েছে। বসে নেই নারীরাও সংসারে কাজ শেষ করে ব্যাংক তৈরী করছেন তারাও।
গ্রামের সাধারণ মানুষ ব্যাংকে গিয়ে টাকা না রাখতে পারলেও মাটির তৈরি ব্যাংক কিনে নিয়ে ঘরের এক কোনে অথবা খাটের নিচে রেখে তার মধ্যে টাকা পয়সা জমিয়ে রাখেন। এক সময় মাটির ব্যাংকটি ভড়ে গেলে ব্যাংকটি ভেঙ্গে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতেন। সেই মাটির ব্যাংকের প্রচলন এখনো থেমে নেই কেউ শখের বসে কেউবা ঘরের শোভা বৃদ্ধি করার জন্য আবার কেউবা টাকা পয়সা জমানোর জন্য এখনো মাটির তৈরী করা ব্যাংক কিনে নিয়ে যান। এখনো সেই মাটির ব্যাংকের প্রচলন আছে বলেই গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার ঢালজোড়া ইউনিয়নের উল্টাপাড়া গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবারের একমাত্র উপার্জন মাটির তৈরী করা ব্যাংক।
ওই গ্রামের অর্ধশতাধিক পরিবার গত ২৫ বছর ধরে মাটির ব্যাংক তৈরী করে সংসার চালিয়ে আসছে বলে ওই সকল পরিবারের সাথে কথা বলে জানা গেছে।
যে ভাবে শুরু - ওই গ্রামের লোক জনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে ওই গ্রামের রায়মোহনের ছেলে দিনু বন্ধু পাল সাভারের একটি বিদেশি মৃৎশিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করতো। ওই প্রতিষ্ঠানে মাটি দিয়ে ব্যাংক, ফুলদানি, ফুলের টপ, ঝার, বসার মোড়াসহ ঘরে সাজিয়ে রাখার জন্য অনেক রকমের খেলনা তৈরী করা হতো। সেখানে তিনি বেশ কিছু দিন কাজ করে সহজেই ভালো অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তখন তিনি গ্রামের বেকার কয়েক জনকে নিয়ে বিষয়টি পরামর্শ করেন কিভাবে তারা মাটি দিয়ে ব্যাংক তৈরী করার কাজ শুরু করা যায়। গ্রামের বেকার কয়েকজন যুবকের উৎসাহে দিনু বন্ধু পাল ৮ হাজার টাকা ধার দেনা করে একটি হুইল মেশিন (ব্যাংক তৈরীর জন্য মাটি উপযোগী করার যন্ত্র) কিনে এনে দিনু বন্ধু পালের বাড়ির উঠানে বসানো হয়। সেদিন থেকে শুরু হয় ৫/৬ জন যুবককে সাথে নিয়ে দিনু বন্ধু পালের ব্যাংক তৈরীর কাজ। ব্যাংক তৈরী করে বাজারে বিক্রি করে তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন দেখে গ্রামের অনেকেই উৎসাহিত হন। তারা চিন্তা করেন বেকার বসে না থেকে বা অন্যের বাড়িতে দিন মজুরের কাজ না করে ব্যাংক তৈরী করে বাজারে বিক্রি করে ব্যবসা করাই উত্তম। এভাবে বেকার লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় দিনু বন্ধু পালের বাড়িতে ব্যাংক তৈরীর কাজ শেখার জন। আর দিনু বন্ধু পাল কৃপণতা না করে তাদের প্রশিক্ষণ দেন তার সাথে নিজের কাজ ও চলতে থাকে। একাজে শুধু পুরুষরাই করেন না তাদের সাথে সাথে তাদের মা, বাবা ও স্ত্রীও কাজ শুরু করেন। এভাবে দিনে দিনে পুরো গ্রামেই ছড়িয়ে পড়ে মাটির ব্যাংক তৈরীর কাজ।
যে ভাবে তৈরী হয় - ওই গ্রামের পাশের খাল থেকে মাটি তোলে এনে বেশ কয়েক দিন চাপা দিয়ে রাখা হয়। মাটি একটু শুকিয়ে গেলে তা বাড়ির পাশে নির্দিষ্ট একটি জায়গায় রেখে হাত ও পায়ের সাহায্যে আঠালো করা হয়। মাটি আঠালো হলেই তা ব্যাংক তৈরীর উপযোগী হয়ে পড়ে। পরে সেই আঠালো মাটি পা দিয়ে চালিত হুইল মেশিনের উপর নির্দিষ্ট পরিমানে রেখে হাতের মাধ্যমের ডিজাইন করে তৈরি করা হয় মাটির ব্যাংক। মাটির ব্যাংক গুলি সাধারণত কেজি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। সাধারণত ১ পোয়া, হাফ কেজি, ১ কেজি, দেড় কেজি থেকে ৫ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। মেশিনে ব্যাংক তৈরী করা শেষ হয়ে গেলে তা কায়েক দিন পর্যন্ত রোদে শুকাতে হয়। পরে বিশাল আকৃতির চুলার উপর অনেকগুলি ব্যাংক এক সাথে সাজিয়ে আগুনে পুড়তে হয়। পুড়া হয়ে গেলেই ব্যাংকের কাজ শেষ হয়।
বাজার জাত - বিভিন্ন সাইজের ব্যাংকের মূল্যও আলাদা ভাবে করা হয়েছে যেমন- ১ পোয়া সাইজের পাইকারী মূল্য ৪ টাকা, হাফ কেজি সাইজের পাইকারী মূল্য ৬ টাকা, ১ কেজি সাইজের পাইকারী মূল্য সাড়ে ৮ টাকা, দেড় কেজি সাইজের পাইকারী মূল্য ১০ টাকা, ২ কেজি সাইজের মূল্য ১২ টাকা ও ৫ কেজি সাইজের পাইকারী মূল্য ২০ টাকা।
শুরুর প্রথমে তারা নিজেরাই বাজারে বিক্রি করতো। এখন ওই গ্রামের প্রায় সবাই ব্যাংক তৈরী কাজ করেন তাই গ্রামেও গড়ে উঠে মহাজন। মহাজনরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাল ক্রয় করে নিয়ে যান, আবার ঢাকা থেকে মহাজন এসেও বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাল ক্রয় করেন। মহাজন গড়ে উঠায় যেমন সুবিধাও আছে তেমনি অসুবিধাও রয়েছে। মহাজনদের কাছে কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই মাল বিক্রি করা যায়, আর ঝামেলা ছাড়া বিক্রি করতে গিয়ে প্রতিটি ব্যাংকে ৫০ পয়সা কমে বিক্রি করতে হয়। ব্যাংকের বেশি চাহিদা থাকায় অনেক সময়ই মহাজনরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে অগ্রিম টাকা দিয়ে যান যাতে তৈরী মালটা তাকেই দেওয়া হয়। প্রতিটি মাটির ব্যাংকে সাইজ আনুযায়ী ১ টাকা থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত লাভ হয়।
মাটির ব্যাংক তৈরীর কারিগর মন্টুপাল জানান, উল্টাপাড়া গ্রামে প্রায় ২৫ বছর আগে যখন দুই একটি বাড়িতে মাটি দিয়ে ব্যাংক তৈরীর কাজ শুরু হয়। তখন অন্য কোন কাজ না থাকায় তাদের দেখে এবং তাদের নিকট থেকে বিনা বেতনে কাজ করে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। আগে মোটামুটি ভালই সংসার চলতো। এখন ঠিকঠাক সংসার চলে না। সব কিছুর দাম বেশি। ছেলে মেয়েরা স্কুলে লেখাপড়া করে। বড় হয়ে তারা চাকরী করবে। মাটির ব্যাংক তৈরীতে যদি ভাল লাভ থাকতো। তাহলে হয়তো ছেলেমেয়েরা সেটা করতো। আমার সাথে সহযোগীর হাত বাড়িছেন আমার স্ত্রীও।
ওই গ্রামের সন্তুষ পাল বলেন, ছেলে মেয়ে বাদে পরিবারের সবাই এ কাজ করি। অন্য কোন কাজ শিখিনি তাই এটা ছাড়া উপায়ও নেই। বাড়িঘড় ছাড়া অন্য কোন কৃষি জমিজমাও নেই। অনেক আগে গ্রামের সবাই ব্যাংক তৈরীতে ঝুঁকে পড়লে আমি নিজেও কাজ শিখে ফেলি পরে নিজের বাড়ির উঠানে একটি হুইল মেশিন বসিয়ে ব্যাংক তৈরী শুরু করি। ব্যাংক তৈরী করতে গেলেও ১লাখ টাকা পুঁজি লাগে। এতো টাকা পাবো কোথায়। সরকারি ভাবে যদি সহযোগিতা পাওয়া যেত তাহলে অনেক ভাল হতো। সরকার তো অনেক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে যদি আমাদের জন্য কিছু করতো।
ওই এলাকার ব্যাংক তৈরীর প্রথম কারিগর দিনু বন্ধু পাল জানান, ২৫ বছর আগে আমি এ কাজ শুরু করি। এখন এলাকার সবাই মাটির ব্যাংক তৈরী করে। আমি ১৫ বছর ধরে নিজে ব্যাংক তৈরী করি না কারিগর দিয়ে করাই। আমার ৬ জন কারিগর আছে তাদের বেতন দিয়ে কাজ করাই। একেক জনকে মাসে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা বেতন দেই। এলাকায় যারা ব্যাংক তৈরী করে তাদের কাছ থেকে পাইকারী ব্যাংক কিনে ঢাকা, চট্রোগ্রাম, সিলেট বড় পাইকারীর কাছে বিক্রি করি। এতে করে আমার খরচ বাদে বছরে ১লাখ টাকা থাকে। এ টাকা দিয়ে জমিজমাও কিনেছি। তিন মেয়ে বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। মেঝ মেয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে আর ছোট মেয়ে ৫ম শ্রেণীতে। পুঁজি না থাকায় ধার দেনা করে ব্যবসা করছি। সরকারি ভাবে যদি কোন সহযোগীতা পেতাম তাহলে ব্যবসা ভাল করতে পারতাম।
মহাজন দিনু বন্ধু পাল আরো বলেন, গ্রামে অনেক গরীব লোক রয়েছে যাদের পুজি নেই তাই অনেক সময়ই তাদের ঋণ দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। ঋণের বিনিময়ে অতিরিক্ত কোন সুদ দিতে হয় না তবে প্রতিটি ব্যাংকে ৫০ পয়সা দাম কম দেওয়া হয়। এতে করে আমাদেরও লাভ হচ্ছে অপরদিকে যারা ব্যাংক তৈরী করছে তাদেরও পুঁজি না খাটিয়ে ব্যবসা করতে পারছে।
COMMENTS