![]() |
কালিয়াকৈরের সোনাতলায় বনের জমিতে আওয়ামী লীগ নেতার বাগানবাড়ি |
'বছর দশেক আগেও আমাদের এখানে ঘন শালবন ছিল। দেখা মিলত বনমোরগ, শজারু, খরগোশ, বেজি, কাঠবিড়ালী, কয়েক প্রজাতির বানর, বুনোশূকর, পাখ-পাখালি, সাপ ও অন্যান্য বন্য প্রাণীর। কিন্তু আস্তে আস্তে বন উজাড় করে এখানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য কলকারখানা। বাতাসে ছড়াচ্ছে কারখানার বিষ। দিন দিন জনবসতিও বাড়ছে। সেই ঘন সবুজ অরণ্য আর নেই। এখন শালবনে হঠাৎ দু-চারটি বিপন্ন বানরের দেখা মেলে- বন্য প্রাণী বলতে এটুকুই।' শ্রীপুরের কেওয়াচালার ক্ষুদ্র জাতির নেতা পিযুষ বর্মণ (৩২) এভাবেই বর্ণনা করছিলেন সহস্র বছরের প্রাচীন ভাওয়ালগড়ের সংরক্ষিত গাজীপুর শালবনের দখলদারির ইতিকথা।
বন রক্ষায় বন বিভাগ কিছু করে না- এমন প্রশ্নের জবাবে পিযুষ বলেন, বনের দখল ঠেকাতে বন বিভাগ শুধু মামলাই করে। কিন্তু এসব মামলা আর শেষ হয় না। সবুজ বনও আর ফিরে আসে না। বনের জমি উদ্ধার হয় না। তাঁর আরো অভিযোগ, আসল দখলদারকে বাঁচিয়ে দিতে ভুয়া আসামির নামে দুর্বল মামলা দায়েরের নজিরও আছে প্রচুর।
রাজধানীর উপকণ্ঠে গাজীপুরের ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পশ্চিম দিকে সরু পিচঢালা পথ ধরে খানিকটা এগোলেই চোখে পড়বে দুই পাশে বনের বুক চিরে গড়ে ওঠা অগণিত তৈরি পোশাক কারখানা, ব্যক্তিমালিকানাধীন নানা শিল্পপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, টিনশেডের শ্রমিক কলোনি, বস্তিসহ অন্যান্য স্থাপনা। এসবের দাপটে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল অনেক আগেই বিলীন হয়েছে। মুমূর্ষু শালবন চাপা পড়তে বসেছে ইট-কাঠ-পাথর আর মামলার স্তূপে। মামলার প্রহসনে এমনকি বনের দখলও পেয়ে যাচ্ছে বৈধতা। গত এক দশকে অন্তত ছয় হাজার মামলা জমেছে জেলার বন আদালতে। এর মধ্যে প্রায় ৫০০ দেওয়ানি মামলা শুধু বন বিভাগের জমি দখলসংক্রান্ত। অন্যগুলো বন দখলের।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এক দশক আগেও এসব জায়গায় দৃশ্যমান অস্তিত্ব ছিল সংরক্ষিত সবুজ শালবনের। প্রথম দফায় গাছ চোরেরা ধীরে ধীরে শালবন কেটে উজাড় করে। পরে সেখানে দিনরাত চলে নানা স্থাপনা নির্মাণের কাজ। রাতারাতি বনের ফাঁকা জমিতে গড়ে ওঠে বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক ইমারত। আবার বনের ভেতরে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি কিনে সেখানে নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে স্থাপনাটি সম্প্রসারণের নামে বনের জমির দখল চলে। দখলকারীদের তালিকায় দেশের অনেক নামকরা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনেতা ও অপরাধ জগতের গডফাদারদের নাম।
জমি দখলের বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট বিট কর্মকর্তা প্রথমে থানায় সাধারণ ডায়রি করেন। অভিযোগের মাত্রা বেশি হলে মামলাও করে বন বিভাগ। অভিযোগ রয়েছে, অনেক মামলায়ই প্রকৃত জবরদখলকারীর পরিবর্তে আসামি হিসেবে দেওয়া হয় অন্য লোকের নাম। এসব মামলায় আসামির নাম, বাবার নাম-ঠিকানাও দেওয়া হয় ভুল। এভাবে ভুল তথ্য দিয়ে শুরুতেই দুর্বল করে ফেলা হয় মামলা; উপরন্তু বনের মামলা চলে বছরের পর বছর। আবার মামলার তদন্ত ও শুনানিকালে তথ্য ভুল থাকায় আসামি খুঁজে পাওয়া যায় না। সব ধরনের বৈধ দলিলপত্র থাকার পরও দুর্বল মামলার কারণে বন বিভাগ হেরে গেছে, এমন ঘটনাও অনেক।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন, দুর্বল বন আইনের পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে মামলাজটের সুযোগে বনের দখলদারিত্ব টিকে থাকছে। নতুন করে আবারও দখল, আবারও মামলাজটের খপ্পরে পড়ছে গাজীপুর শালবন। তাঁদের পরামর্শ, গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোকে বাছাই করে দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। মামলা নিয়ে এমন অরাজক পরিস্থিতির কথা বন কর্তৃপক্ষও স্বীকার করেছে।
সহস্রাধিক বনখেকো : বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুরে দুটি বন্য প্রাণী রেঞ্জসহ ছয়টি রেঞ্জের অধীনে কাগজে-কলমে প্রায় ৮৪ হাজার একর বনের জমির রয়েছে। রেঞ্জ ছয়টি হচ্ছে- ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান, কাঁচিঘাটা, কালিয়াকৈর, শ্রীপুর, রাজেন্দ্রপুর ও ভাওয়াল রেঞ্জ। এর মধ্যে প্রায় ৩৯ হাজার একর জমিই গত এক দশকে দখল হয়ে গেছে। সব চেয়ে বেশি দখল হয়েছে শ্রীপুর রেঞ্জে। জমির পরিমাণ প্রায় সাড়ে ছয় হাজার একর। কালিয়াকৈর রেঞ্জে দখল হয়েছে প্রায় চার হাজার একর জমি।
জানা গেছে, ভাওয়াল গড়ের গাজীপুর শালবনের দখলদারের সংখ্যা সহস্রাধিক ছাড়িয়ে যাবে। তবে দখলদারের সংখ্যা ঠিক কত, সে ব্যাপারে বন বিভাগই নিশ্চিত নয়। দখলদার উচ্ছেদে বিভিন্ন তালিকা হলেও শেষ পর্যন্ত কোনো উদ্যোগই সফল হয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বন বিভাগের সবশেষ তালিকা অনুযায়ী দখলদার প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সংখ্যা মাত্র ৭২। তিন বছর আগে করা ওই তালিকা ধরেই এখন পর্যন্ত কোনো জমিই দখলমুক্ত হয়নি। দায়সারা কয়েকটি মামলা ঠুকেই কর্তব্য সেরেছে বন কর্তৃপক্ষ।
আইনেই অনেক ফাঁকফোকর : বন দখলের ক্ষেত্রে বন বিভাগ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ১৯২৭ (সংশোধিত ২০০০) সালের বন আইনের ২৬ ধারার ১-এর 'ক', 'খ' ও 'ঘ' উপধারায় এবং ৬৩ ধারার 'গ' উপধারায় জেলার বন আদালতে মামলা দায়ের করে। এই আইনে বলা হয়েছে, বেআইনিভাবে সরকারি সংরক্ষিত বনভূমিতে অনুপ্রবেশ, গাছ কাটা, বনভূমি ও জোতভূমির আকৃতি বা সীমানা চিহ্ন নষ্ট করে জবরদখলের চেষ্টার শাস্তি সর্বনিম্ন ছয় মাস এবং সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ড অথবা সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড উভয় প্রকার শাস্তি দেওয়া যাবে।
গাজীপুর বন আদালতের সিনিয়র আইনজীবী মোমতাজুল ইসলাম আইনটি বিশ্লেষণ করে কালের কণ্ঠকে বলেন, বন কর্তৃপক্ষ ওই দুর্বল আইনের কারণে বনের দখলবাজি ঠেকাতে পারছে না। আইন অনুযায়ী, একটি মাত্র গাছ কাটার জন্য বা কয়েক শ একর বনভূমি উজাড় করার শাস্তি একই- ছয় মাস থেকে সাত বছরের কারাদণ্ড অথবা অর্থ দণ্ড। এই আইনে গুরুতর অপরাধীকে লঘু শাস্তি দেওয়া সুযোগ রয়েছে। এতে প্রকৃত অপরাধীরা আইনের ফাঁক গলে বারবার অপরাধে উৎসাহী হয়। আবার লঘু অপরাধীকে গুরুতর শাস্তি দিয়ে নানাভাবে হয়রানির সুযোগও এই আইনে রয়েছে।
অভিজ্ঞতার আলোকে অ্যাডভোকেট মোমতাজুল ইসলাম আরো বলেন, বন আইনে কোন ধরনের মামলা কত দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি হবে, সে সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। তাই অনেক সময়ই দেখা যায়, জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে বনের ডালপালা কাটার দায়ে বন মামলায় দরিদ্র মানুষ যেমন বছরের পর বছর ধরে হয়রানির শিকার হচ্ছে, তেমনি মামলাজটের সুযোগে বহু বছর ধরে দখল টিকিয়ে রাখছে সত্যিকারের দখলবাজরা। তাঁর মতে, মূল্যবান বনজ সম্পদ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো সংক্ষিপ্ত সময়ে নিষ্পত্তির বিধান বন আইনে থাকা খুবই দরকার।
অ্যাডভোকেট মোমতাজুল ইসলাম মনে করেন, গাজীপুর শালবন দখলমুক্ত করতে তথা বন রক্ষায় দ্রুত একটি কার্যকর নীতিমালা গ্রহণ করা জরুরি। এ জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে গাজীপুরে যেটুকু সবুজ বন এখনো আছে, তাও একসময় দখলবাজিতে নিঃশেষ হয়ে যাবে। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সরকারের উচিত হবে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া। নইলে বছরের পর বছর ধরে মামলা-মোকদ্দমার ফাঁদে বনের দখল চলতেই থাকবে।
বন বিভাগের প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুস আলীও স্বীকার করেন, বন মামলায় গাজীপুর শালবনে সৃষ্ট বিবিধ অরাজক পরিস্থিতির কথা। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা বনের জমি পুনরুদ্ধারের জন্য নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। বেশ কিছু ব্যক্তি ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমাও করা হয়েছে। এসব মামলার রায় পেলেই বনের জমি দখলে নেওয়া সম্ভব। তবে মামলাগুলো বছরের পর বছর ধরে চলে বলে রাতারাতি বনভূমি পুনরুদ্ধার করা যায় না।'
ইউনুস আলী আরো বলেন, বছরের পর বছর ধরে হাজার হাজার মামলা চালাতে গিয়ে বন বিভাগকে প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে; কিন্তু সে অনুপাতে বনের জমি যথেষ্ট পরিমাণে দখলমুক্ত হচ্ছে না। বরং নতুন নতুন দখলদার ঘাঁটি গাড়ছে। বন বিভাগ আবারও নতুন করে মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়ছে।
প্রধান বন সংরক্ষক আশঙ্কা প্রকাশ করেন, বহু বছর ধরে প্রভাবশালী দখলদাররা বিস্তীর্ণ ভাওয়াল গড়ের শালবনের ভেতর ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে যত্রতত্র কলকারখানা, রিসোর্ট, বেসরকারি পিকনিক স্পট, শুটিং স্পট, বাগানবাড়ি ইত্যাদি নির্মাণ করে চলেছে। এতে বনের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশ বিঘি্নত হচ্ছে। বনভূমিও বেদখল হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী এক-দেড় দশকে ভাওয়াল গড় পুরোপুরি বাণিজ্যিক শিল্পাঞ্চলে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সীমিতসংখ্যক রক্ষী ও দুর্বল আইন দিয়ে সর্বত্র বন রক্ষা করা সম্ভব নয়।
ইউনুস আলী জানান, সম্প্রতি গাজীপুর বনের দখলকে কেন্দ্র করে ১০-১৫ বছর ধরে চলতে থাকা ছয় সহস্রাধিক মামলার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো যাচাই-বাছায়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বন বিভাগ এসব মামলা দ্রুত বিচার আদালতে নিষ্পত্তির জন্য শিগগিরই আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠাবে। এরই মধ্যে ওই মন্ত্রণালয়ে শুধু বনের মামলা নিষ্পত্তি করার জন্য বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
প্রধান বন সংরক্ষক আশাবাদ প্রকাশ করে বলেন, গাজীপুরসহ বড় বন রয়েছে এমন কয়েকটি জেলায় প্রস্তাবিত স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হলে খুব দ্রুত মামলাজট কমে আসবে। তবে এ জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি আইন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। একা বন বিভাগের পক্ষে প্রভাবশালীদের কবল থেকে বনের জমি উদ্ধার করা আদৌ সম্ভব নয়।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রকৃত দখলদারকে বাদ দিয়ে অন্য ব্যক্তিদের অভিযুক্ত করে দুর্বল মামলা সাজানোর কথাও স্বীকার করেন ইউনুস আলী। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'এ রকম কিছু ঘটনা আমাদের নজরে এসেছে। আমরা এর সঙ্গে জড়িত অসাধু বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করাসহ নানা বিভাগীয় শাস্তি নিয়েছি। ঢালাওভাবে বন বিভাগকে দোষারোপ করা ঠিক হবে না।'
সূত্রঃ বিপ্লব রহমান, কালের কণ্ঠ
COMMENTS