নির্ভীক শিশুর সামনে ক্ষমা চাইল জঙ্গিরাও

তখনও শপিং মলের ভিতরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বন্দুকবাজেরা। হঠাৎই, তাদের নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে আধো স্বরে ধমক দিল বছর চারেকের পুঁচকে ছেলেটা।

“তোমরা খুব বাজে। মায়ের পায়ে গুলি করেছ তোমরা। তোমাদের জন্যই কষ্ট পাচ্ছে আমার মা…”

সত্যিই অদ্ভুত সাহস তার। যে জনা দশেক সাহবাব জঙ্গি এই মুহূর্তে ঘুম কেড়ে নিয়েছে গোটা বিশ্বের, যাদের মোকাবিলা করতে রীতিমতো হিমশিম কেনীয় সেনা, শেষ পর্যন্ত তাদেরও মাথা নোয়াতে বাধ্য করল নির্ভীক ওই শিশু। তার সিধেসাপটা অভিযোগে বুঝি অপরাধবোধ জাগে বন্দুকধারী সাহবাব জঙ্গিদের। নাকি মনে পড়ে নিজের পরিবারের কোনও ছোট ছেলের কথা! আদর করে কাছে টেনে নিয়ে ছেলেটিকে তারা বলল, “আমরা খারাপ নই। ক্ষমা করে দাও।”

ওয়েস্টগেট মলে এলিয়টের সঙ্গে অ্যামিনা। ছবি ডেলি মেলের সৌজন্যে।

নেট-সমাজের পাতায় পাতায়, লোকের মুখে মুখে ফিরছে সাহসী সেই ছেলের নাম। এলিয়ট প্রায়র। ছোট্ট ছেলেটির আত্মবিশ্বাসের জোরেই আজ মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফিরেছে তার মা অ্যাম্বার ও দিদি অ্যামেলি।

বাড়ি ফিরে আত্মীয়-পরিজনকে চার চারটে দিন সশস্ত্র জঙ্গিদের হেফাজতে থাকার হাড় হিম করা অভিজ্ঞতার কথা জানালেন অ্যাম্বার। বিস্কুট, দুধ ইত্যাদি ঘরোয়া প্রয়োজনের কিছু জিনিসপত্র কিনতে শনিবার নাইরোবির ওয়েস্টগেট শপিং মলে গিয়েছিলেন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে। মলের উপরের তলায় চলছিল রান্নার প্রতিযোগিতা। কেনাকাটি সেরে ছেলেমেয়েকে নিয়ে সে দিকেই যাচ্ছিলেন তাঁরা। এমন সময় হানা দেয় মুখোশধারীরা। ছেলেমেয়েকে আগলে মাংসের দোকানের শো-কেসের নীচে আশ্রয় নেন অ্যাম্বার। অ্যাম্বার-অ্যামেলি ও এলিয়ট ছাড়াও সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন আরও কুড়ি জন। এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়ছে জঙ্গিরা। তারই একটি এসে লাগে অ্যাম্বারের পায়ে। অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়েও টুঁ শব্দটি করেননি। পাছে জঙ্গিরা টের পেয়ে যায় তাঁদের অস্তিত্ব।

জনা ৭০ নিরীহ মানুষকে খতম করে সোমবার সন্ধ্যায় জঙ্গিরা তখন ঘনঘন ঘোষণা করছে, আর কোনও বাচ্চা থাকলে তারা বেরিয়ে যেতে পারে। ছেলেমেয়েকে বাঁচাতে উঠে দাঁড়ান অ্যাম্বার। মায়ের হাত ধরে সোজা উঠে দাঁড়ায় এলিয়টও। বন্দুকের নলের সামনে একটুও ভয় না পেয়ে জঙ্গিদের সঙ্গে রীতিমতো ঝগড়া জুড়ে দেয় সে। কথোপকথনের মাঝেই জঙ্গিরা জানতে পারে, এলিয়টের মা অ্যাম্বার আদতে ফরাসি বংশোদ্ভূত। এর পরই জঙ্গিদের সুর নরম হয় কিছুটা। অ্যাম্বারকে ইসলাম ধর্মের মাহাত্ম্যের কথা শোনায় তারা। ধর্ম পরিবর্তনের পরামর্শও দেয়।

অ্যাম্বার বললেন, “সে সময় দুষ্কৃতীর যা যা বলছিল, প্রাণ বাঁচাতে অক্ষরে অক্ষরে তাই মানছিলাম। বন্দুকবাজদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার পর এলিয়টকে কোলে নিয়ে, অ্যামিলিকে জাপটে ধরে ছুটতে থাকি। যাওয়ার সময় বন্দুক নামিয়ে এলিয়ট ও অ্যামেলির হাতে চকোলেটও দেয় ওরা।” অ্যাম্বার বলে চললেন, গুলি থেকে বাঁচতে তাঁরা যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেখানেই লুকিয়ে ছিল বছর দশেকের আরও দুই শিশু। তাদের মায়ের নিথর দেহ আগলে রেখে অবিরাম কেঁদে চলেছিল তারা। এলিয়টের উপর মায়া পড়ে যাওয়ায় ওই দুই শিশুকেও রেহাই দেয় দুষ্কৃতীরা। আরও যারা লুকিয়ে ছিল সেখানে? তাদের অবশ্য কোনও খোঁজ দিতে পারেননি অ্যাম্বার।

জঙ্গি হানার দিন ওয়েস্টগেট শপিং মলে যে রান্নার প্রতিযোগিতা চলছিল তার পরিচালকও এ দিন সাহবাবদের বুলেট উপেক্ষা করে বেঁচে ফিরেছেন। নাম, কমল কৌর। কমলের অভিজ্ঞতা অবশ্য অন্য রকম। তিনি জানাচ্ছেন, যে নিষ্পাপ শিশুগুলি মন কেড়ে নিয়েছে নৃশংস জঙ্গিদেরও, তাদের প্রতিই মলে উপস্থিত বড়দের ব্যবহার ছিল পশুর মতো। নিজেদের বাঁচাতে ছোটদের পর পর বসিয়ে, সিঁড়ি বানিয়ে মলের দেওয়াল টপকে পালাচ্ছিল তারা। এক বিদেশি দৈনিকের সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় কমল জানান, “জঙ্গিরা যখন মলে ঢুকল, তখন জনা তিরিশ শিশু প্রতিযোগী নিয়ে অনুষ্ঠান চালাচ্ছিলাম আমি। গোলাগুলির আওয়াজ কানে আসতেই তাদের সকলকে নিয়ে কোণের দিকে চলে যাই। সবাইকে হাঁটু গেড়ে, মাথা নিচু করে থাকতে বলি।” সে দিনের সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল কমলের দুই ছেলেমেয়েও। জঙ্গিদের গুলিতে আক্রান্ত হয় তাঁর মেয়ে। মাথার পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়ায় কোনও ক্রমে রক্ষা পায় তাঁর ছেলে। কেনীয় সেনা যখন ঘিরে ফেলেছে শপিং মল, তখন তাঁদেরই এক জনের হাতে ছেলেমেয়েকে সঁপে দিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দেন কমল।

তবে কমল ও তাঁর ছেলেমেয়ে বেঁচে ফিরলেও শেষ রক্ষা হল না তাঁরই সহকর্মী তথা রেডিও জকি রুহিলা আড়াতিয়ার। আয়ার্ল্যান্ডের এলিফের মতোই সন্তানসম্ভবা ছিলেন তিনিও। বিয়ে হয়েছিল গত বছর জানুয়ারিতে। সোমবার বিকেল পর্যন্তও ফোনে যোগাযোগ রাখছিলেন স্বামীর সঙ্গে। টুইটারে নিজের অভিজ্ঞতার কথাও জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “পাশে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট ছেলেটিকে নির্মম ভাবে খুন করল দুষ্কৃতীরা। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসা রক্তে ভেসে গিয়েছে সারা শরীর।”

মঙ্গলবার রাতে, ওয়েস্টগেট শপিং মলকে অবশেষে জঙ্গিমুক্ত করেছে কেনিয়ার সেনা। মঙ্গলবার সকালেও চারটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গিয়েছিল। আশঙ্কা ছিল, আটকে রয়েছে পণবন্দিরা। তবে এখনও জানা যায়নি ওই পণবন্দিদের ভিতরে এলিয়টের মতো আর কেউ রয়েছে কি না। আর থাকলেও বা কী অবস্থায়?
-এবিপি

COMMENTS





নাম

অর্থ ও বাণিজ্য,237,আন্তর্জাতিক,732,কাপাসিয়া,343,কালিয়াকৈর,418,কালীগঞ্জ,253,খেলা,644,গাজীপুর,3944,চাকরির খবর,34,জয়দেবপুর,1581,জাতীয়,2968,টঙ্গী,912,তথ্যপ্রযুক্তি,512,ধর্ম,196,পরিবেশ,137,প্রতিবেদন,310,বিজ্ঞান,55,বিনোদন,698,ভিডিও,58,ভিন্ন খবর,142,ভ্রমন,115,মুক্তমত,27,রাজধানী,829,রাজনীতি,1057,লাইফস্টাইল,283,শিক্ষাঙ্গন,398,শীর্ষ খবর,10778,শ্রীপুর,482,সাক্ষাৎকার,12,সারাদেশ,649,স্বাস্থ্য,212,
ltr
item
GazipurOnline.com: নির্ভীক শিশুর সামনে ক্ষমা চাইল জঙ্গিরাও
নির্ভীক শিশুর সামনে ক্ষমা চাইল জঙ্গিরাও
http://3.bp.blogspot.com/-ShL9bb0VWzE/UkKezJW0LPI/AAAAAAAABZA/3Bhof2pNfrg/s1600/amina.jpg
http://3.bp.blogspot.com/-ShL9bb0VWzE/UkKezJW0LPI/AAAAAAAABZA/3Bhof2pNfrg/s72-c/amina.jpg
GazipurOnline.com
https://www.gazipuronline.com/2013/09/westgatemall.html
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/2013/09/westgatemall.html
true
13958681640745950
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Read More Reply Cancel reply Delete By প্রচ্ছদ PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share. STEP 2: Click the link you shared to unlock Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy