গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গাজীপুরে প্রধান দু’দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঘর গোছাতে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। ইতোমধ্যেই গাজীপুরের পাঁচটি আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা কর্মীসমর্থক নিয়ে নির্বাচনী এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। দলীয় মনোনয়নের প্রত্যাশায় সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রভাবশালী মহলে ধর্না দিয়ে বেড়াচ্ছেন। দলের ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের পক্ষ থেকে নির্বাচনী এলাকাগুলোতে চলছে কর্মীসভা, শোডাউন, গণসংযোগ, সভা-সমাবেশ এবং লবিং-গ্রুপিং। সম্ভাব্য প্রার্থীদের ছবিসংবলিত নানা রংয়ের ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার আর বিলবোর্ডে জেলার বিভিন্ন সড়ক, মহাসড়ক ও হাটবাজারসহ পুরো এলাকা ছেয়ে গেছে। তারা নির্বাচনে স্থানীয়দের কাছে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়ে এলাকার বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
সে সঙ্গে জনসাধারণের মাঝে শুরু হয়েছে গত নির্বাচনে জয়ী হওয়া এমপিদের সাড়ে চার বছরের নানা কার্যক্রম নিয়েও চুলচেরা বিশ্লেষণ। ফলে নির্বাচনী উত্তাপ জেলার পাঁচটি আসনেই ছড়িয়ে পড়েছে। গাজীপুরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই শক্তিশালী। তবে উভয় দলেই মাঠ পর্যায়ে রয়েছে গ্রুপিং ও কোন্দল। জেলার শীর্ষ নেতারা বলছেন, নির্বাচনের আগেই এগুলো মিটিয়ে ফেলা হবে। তবে পরিস্থিতি যা-ই হোক, সদ্য অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মতো গাজীপুরের ভাসমান ভোটাররাই একটা বড় ফ্যাক্টর।
আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবেখ্যাত গাজীপুরের পাঁচটি সংসদীয় আসনের সবকটিতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হন। বিএনপি প্রার্থীরা তাদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তাই আওয়ামী লীগের এ সাংসদরা আগামী নির্বাচনেও জেলার সবকটি আসনই নিজেদের দখলে রাখতে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। তবে কোন কোন আসনে নতুন মুখের নেতারা প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সেই ঐতিহ্যবাহী দুর্গ ভেঙ্গে তাতে ভাগ বসাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। আওয়ামী লীগের কাছ থেকে সংসদীয় নিজেদের দখলে নিতে বিএনপি নানা কৌশলে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জয়লাভের পর নতুন প্রাণ পেয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে মাঠ গরমের পাশাপাশি প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের সম্ভাব্য প্রার্থীরা ইতোমধ্যেই মাঠে নেমে পড়েছেন। এ নির্বাচনে তাঁরা জাতীয় ইস্যু তুলে ধরার পাশাপাশি গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলের প্রভাব ও কৌশলকে কাজে লাগাতে চাচ্ছেন। তাঁরা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সম্ভাব্য প্রার্থীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজ নিজ এলাকায় গণসংযোগ, আলোচনাসভা, মতবিনিময়, জনসভা, ঈদ পুনর্মিলনীসহ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করে ভোটারদের পাশাপাশি এলাকার সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন।
এদিকে সরকারের মেয়াদ প্রায় শেষ হতে চললেও নির্বাচিত পাঁচ এমপির পরস্পরের মধ্যে খুব একটা মিল দেখা যায়নি। এমনকি পাঁচজন কখনও একমঞ্চেও বসেননি। তাদের নিজেদের মধ্যে দূরত্বের কারণে জেলার উন্নয়নও ব্যাহত হয়েছে। সেই সঙ্গে দলাদলি, প্রতিহিংসা, স্কুল-কলেজের নিয়োগ, ভাগ-বাটোয়ারা, টিআর-কাবিখা, ঠিকাদারি, স্বজনপ্রীতি, নির্বাচনী এলাকায় কম যাতায়াত, তৃণমূল নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়নসহ নানা ইস্যুতে এমপিদের অনেকে বিতর্কিত ও নাজেহাল হয়েছেন। অনুগত নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হয়েও দুর্নাম কুড়িয়েছেন কেউ কেউ। নির্বাচন প্রসঙ্গ এলেই সাধারণ মানুষের মুখে এসব বিষয় উঠে আসছে। এসব কারণে ম্লান হয়ে যাচ্ছে তাদের অনেক উন্নয়ন কর্মকা-। সে সঙ্গে প্রত্যেকটি নির্বাচনী এলাকায় বিএনপি ছাড়াও আওয়ামী লীগের মাঝে অন্তর্কোন্দল রয়েছে। রয়েছে নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব। কাজেই প্রার্থী বাছাইয়ে আওয়ামী লীগের খুব হিসাবনিকাশ করতে হবে এখানে। সাংগঠনিক পরিস্থিতিকেও বিবেচনায় নিতে হবে। তা নাহলে এবারের নির্বাচনে কোন কোন আসনে গণেশ উল্টে যেতে পারে।
জেলার পাঁচটি জাতীয় সংসদের আসনে বড় দলগুলোর মনোনয়ন কারা পেতে পারেন, কার সম্ভাবনা বেশি এ নিয়ে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে পাড়া ও মহল্লায় দলীয় নেতাকর্মীসহ ভোটার ও স্থানীয়দের মধ্যে চলছে আলোচনার ঝড়। শুরু হয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা। ইতোমধ্যে সাধারণ মানুষ ও দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে আলোচনায় বেরিয়ে আসছে কোন দল থেকে কে প্রার্থী হচ্ছেন। কোন আসনে কাকে মনোনয়ন দিলে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, সেই হিসেব মেলাচ্ছেন স্থানীয় ভোটাররা। তাদের মতে বর্তমান সাংসদরাই এবারের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাচ্ছেন, অবস্থাদৃষ্টে এটা অনেকটা নিশ্চিত। যদিও আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের কয়েক নেতা নির্বাচনে অংশ নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে ইতোমধ্যেই বিলবোর্ড, পোস্টারসহ নানাভাবে প্রচার চালাচ্ছেন। অন্যদিকে এককভাবে গণসংযোগ ও প্রচার শুরু করেছেন জাতীয় পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থীরাও।
২০০১ সাল পর্যন্ত গাজীপুর জেলায় জাতীয় সংসদের চারটি আসন ছিল। কিন্তু গত ২০০৮ সালের নির্বাচনে তা পুনর্বিন্যাস করে পাঁচটি আসন করা হয়েছে। এবারের নির্বাচনেও আসনগুলোর সংখ্যা ঠিক রেখে সীমানা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। এ পুনর্বিন্যাস নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে নানা আলোচনা সমালোচনা চলছে। কারণ গাজীপুর-২ আসনের সঙ্গে সাবেক বাসন ইউনিয়নকে টপকে দূরবর্তী এলাকা কাউলতিয়াকে সংযুক্ত করে সীমানা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে।
প্রয়াত সংসদ সদস্য শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের জন্মস্থান গাজীপুর সদরের সাবেক পুবাইল ইউনিয়ন এলাকাটি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে গাজীপুর-২ আসনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু এবার সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাস করে নির্বাচন কমিশন সাবেক পুবাইল ইউনিয়নকে শহরতলীর সংসদীয় আসন গাজীপুর-২ থেকে কেটে ৩৫ কিমি দূরের গাজীপুর-৫ (কালীগঞ্জ) আসনে সংযুক্ত এবং গাজীপুর-২ আসনের সঙ্গে সাবেক বাসন ইউনিয়নকে টপকে জেলা শহর থেকে ৩০ কিমি দূরের গাজীপুর-৩ সংসদীয় আসন থেকে সাবেক কাউলতিয়া ইউনিয়নকে সংযুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। আসন সীমানা বিন্যাসের প্রভাব পড়বে আগামী নির্বাচনে জেলার ফলের ওপর।
গাজীপুর-১ (কালিয়াকৈর ও জিসিসি’র ১ হতে ১৮ নং ওয়ার্ড) ॥ এ আসনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী (বর্তমানে বহিষ্কৃত) চৌধুরী তানবীর আহমেদ সিদ্দিকীকে পরাজিত করে গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা এ্যাডভোকেট আকম মোজাম্মেল হক নির্বাচিত হন। এবারের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের এ এমপি মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদী। তিনি ছাড়াও আসন্ন নির্বাচনে এ আসনের প্রার্থী হিসেবে কালিয়াকৈর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন শিকদার এবং সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলমের (গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী ছিলেন) দলীয় মনোনয়ন চাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্যদিকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় রয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা বিএনপিরসহ সভাপতি, কালিয়াকৈর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হুমায়ুন কবীর, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী সায়েদুল আলম বাবুল, গাজীপুর সদর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ সুরুজ আহমেদ এবং কালিয়াকৈর পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান। তবে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হলে চৌধুরী তানবীর আহমেদ সিদ্দিকীও প্রার্থিতার জন্য দলের মনোনয়ন চাইবেন তাঁর সমর্থকরা দাবি করেন। তাদের মতে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে শীঘ্রই এ নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হতে যাচ্ছে।
এছাড়াও সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পার্টির (এ) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার আব্দুস সালাম ও ইসলামী ঐক্যজোটের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা ফজলুর রহমানের নাম শোনা যাচ্ছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনকালে কালিয়াকৈর উপজেলার সঙ্গে গাজীপুর সদরের বাসন, কোনাবাড়ি ও কাশিমপুর ইউনিয়নকে যুক্ত করে সীমানা নির্ধারণ করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবার আবার কালিয়াকৈর উপজেলার সঙ্গে জিসিসি’র ১ হতে ১৮ নং ওয়ার্ড নিয়ে এ আসনের সীমানা বিন্যাস করা হয়। ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত কালিয়াকৈর ও শ্রীপুর উপজেলা নিয়ে এ আসনের সীমানা নির্ধারণ ছিল। এ আসনে মোট ভোটারের সংখ্যা ৬ লাখ ১৩ হাজার ৮৯০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ৩ লাখ ১২ হাজার ৫৫৪ জন এবং মহিলা ভোটারের সংখ্যা ৩ লাখ ১ হাজার ৩৩৬ জন।
গাজীপুর-২ (জিসিসি’র ১৯ হতে ৩৮ নং, ৪৩ হতে ৫৭ নং ওয়ার্ড এবং গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকা) ॥ এটি জেলা সদরের আসন হিসেবে পরিচিত। আওয়ামী লীগের প্রয়াত সংসদ সদস্য শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের নির্বাচনী আসন এটি। জেলা শহর ও টঙ্গীসহ গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের (জিসিসি) অধিকাংশ এলাকা নিয়ে এ সংসদীয় আসন গঠিত।
জনপ্রিয় সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার ২০০৪ সালের ৭ মে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত তারই জ্যেষ্ঠ পুত্র জাহিদ আহসান রাসেল এ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসছেন। প্রতিবারই তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন স্থানীয় বিএনপির প্রভাবশালী নেতা হাসান উদ্দিন সরকার। বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে রাসেল তাঁর বাবার মতোই এলাকাবাসীর আস্থা ও ভালবাসা অর্জন করতে পেরেছেন বলে স্থানীয়দের অভিমত। আগামী নির্বাচনেও যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি জাহিদ আহসান রাসেল এমপি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। এছাড়াও আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট আজমতউল্লাহ খান। তিনি সদ্য অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দি¦তা করেন।
অন্যদিকে বিএনপির মধ্যকার দীর্ঘ দিনের স্থানীয় বিরোধ মিটিয়ে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অধ্যাপক এমএ মান্নান নির্বাচিত হওয়ায় হাসান উদ্দিন সরকারের পক্ষে এ আসনে দলীয় মনোনয়ন সহজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাসানউদ্দিন সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে জিসিসি নির্বাচনকালে শর্ত পূরণ করায় দলের চেয়ারপার্সন এ আসনের দলীয় প্রার্থী হিসেবে ইতোমধ্যেই হাসানউদ্দিন সরকারকে ‘গ্রীন সিগন্যাল’ দিয়ে রেখেছেন। তবুও গাজীপুর জেলা বিএনপির উপদেষ্টা ও গাজীপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এ্যাডভোকেট ডক্টর মোঃ সহিদ উজ্জামান, কেন্দ্রীয় শ্রমিক দলের যুগ্ম সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি সালাহউদ্দিন সরকার, গাজীপুর সদর বিএনপির সভাপতি নাজিম উদ্দিন আহমেদ এবং টঙ্গী থানা বিএনপির সভাপতি ও গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহেন শাহ আলম সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে এলাকায় আগাম নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন।
এছাড়াও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) কাজী মাহমুদুল হাসান রয়েছেন সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায়।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সদ্য অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জয় পরাজয়ের পর বিভিন্ন দুর্বল দিক চিহ্নিত করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঘর গোছাতে এখন ব্যস্ত। এজন্য প্রতিদিনই সম্ভাব্য প্রার্থীরা কর্মী সভা, গণসংযোগ, সভা-সমাবেশ, রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বিভিন্ন এলাকায় ছুটে যাচ্ছেন।
তবে এ আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাস করায় নির্বাচনী কৌশল নিয়ে প্রধান দু’দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নীতিনির্ধারকদের নতুন করে হিসেব কষতে হচ্ছে। সীমানা পুনর্বিন্যাসের কারণে আওয়ামী লীগ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এ আসনে মোট ভোটার ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৭৭ জন এবং মহিলা ভোটার ৩ লাখ ২৫ হাজার ৯৮৭ জন। এসব ভোটারের সবাই জিসিসি’র ভোটার। জিসিসি’র মোট ভোটার প্রায় সোয়া ১০ লাখ।
গাজীপুর-৩ (শ্রীপুর ও গাজীপুর সদর উপজেলার মির্জাপুর, ভাওয়াল গড় ও পিরুজালী ইউনিয়ন) ॥ আসন বিন্যাসের পর ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা এ্যাডভোকেট রহমত আলী এমপি বিপুল ভোটের ব্যবধানে এ আসন থেকে নির্বাচিত হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জিসিসির বর্তমান মেয়র বিএনপি নেতা অধ্যাপক এমএ মান্নান। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত যে ক’টি নির্বাচনে এ্যাডভোকেট রহমত আলী অংশ নিয়েছেন একবার বাদে (’৮৬ সালের) বাকি সবক’টিতেই তিনি জয়ী হয়েছেন। তাঁর সমর্থকরা দাবি করেন স্কুল-কলেজ নির্মাণ, সড়ক ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ নানা উন্নয়ন কাজ করে নির্বাচনী এলাকাকে ঢেলে সাজিয়েছেন বলেই স্থানীয়রা ভালবাসার স্বীকৃতিস্বরূপ বার বার ভোট দিয়ে ‘দাদা’কে নির্বাচিত করছে। আর তাই এবারের নির্বাচনেও তিনি মনোনয়ন প্রত্যাশী। জেলার এ আসনে আওয়ামী লীগের ভিত্তি বেশ মজবুত হলেও দলে স্থানীয় পর্যায়ে রয়েছে গ্রুপিং ও কোন্দল।
সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকায় এ আসনে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও শ্রীপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসন সবুজ, যুগ্ম সম্পাদক এ্যাডভোকেট হারিছ উদ্দিন আহমেদ, শ্রীপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট শামসুল আলম প্রধানের নাম রয়েছে। এ আসনে বিএনপি হেভিওয়েট প্রার্থীর অভাবে ভুগছে। এখানে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় বিএনপির জেলা যুগ্ম সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন সবুজ, ড্যাবের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ডাঃ এসএম রফিকুল ইসলাম বাচ্চু, শ্রীপুর থানা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান ফকির, স্বেচ্ছাসেবক দলের ডা. সফিকুল ইসলাম, এসএম রুহুল আমীন, রাজাবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান কুতুব উদ্দিনও তাঁর স্ত্রী শ্রীপুর উপজেলা মহিলা দলের সভানেত্রী ফরিদা জাহান স্বপ্না এবং জেলা জাপা’র (এ) সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম এমএ, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কেন্দ্রীয় নেতা প্রিন্সিপাল ইকবাল সিদ্দিকী, ইসলামী ঐক্যজোটের কেন্দ্রীয় কমিটির বহির্বিশ্ব সমন্বয়ক আল্লামা সাইয়্যেদ রফিকুল ইসলাম মাদানী রয়েছেন। ইতোমধ্যেই তাদের পোস্টার ও বিলবোর্ডে পুরো এলাকা ছেয়ে গেছে। গণসংযোগও চালাচ্ছেন তাঁরা।
এ আসনে মোট ৩ লাখ ৮০ হাজার ৭৫৭ ভোটারের মধ্যে ১ লাখ ৭৬ হাজার ২২১ পুরুষ ও ১ লাখ ৭৮ হাজার ৯৪৬ জন মহিলা ভোটার রয়েছেন।
গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) ॥ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমেদের জন্মভূমি এটি। ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাজউদ্দিন আহমদের ছেলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ এ আসন থেকে নির্বাচিত হন। সোহেল তাজের পদত্যাগের পর ওই আসন থেকে তারই বোন সিমিন হোসেন রিমি ২০১২ সালের উপনির্বাচনে নির্বাচিত হন। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে তিনি দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী। আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হলেও এ আসনে দলের মধ্যকার কোন্দল ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। ইতোমধ্যেই দলের এক গ্রুপের নেতাকর্মীরা অন্য গ্রুপের ওপর একাধিকবার হামলা চালিয়েছে।
দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন করায় এ গ্রুপিং দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপিতেও দীর্ঘদিন থেকে বিরাজ করছে অন্তর্কোন্দল ও গ্রুপিং। দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন করায় স্থানীয় নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। যার প্রভাব আগামী নির্বাচনে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে দলের অনেকেই মনে করেন।
এ আসনে রিমি ছাড়াও দশম নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থিতার জন্য কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোতাহার হোসেন মোল্লা, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য এ্যাডভোকেট মোমতাজ উদ্দিন মেহেদী, মাহমুদুল আলম খান বেনু, জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এ্যাডভোকেট আমানত হোসেন খান, শিল্পপতি নাজমুল হাসান চৌধুরী পিন্টু, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান মোল্লার মনোনয়ন চাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন তাজউদ্দিন আহমেদের ভাই আফসার উদ্দিন আহমেদ খান। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে তিনি ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেন।
অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আসম হান্নান শাহ এ আসনে প্রার্থিতার জন্য দলের মনোনয়ন চাইবেন। গত নির্বাচনে তিনি ঢাকা-১৭ আসন থেকে প্রার্থী হয়ে হেরে যান। ওই নির্বাচনে গাজীপুরের এ আসনে কাপাসিয়া উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি জামালউদ্দিন আহমেদকে বিএনপি প্রথমে দলীয় মনোনয়ন দিলেও পরে তা পরিবর্তন করে এমএ মজিদকে মনোনয়ন দেয়া হলে নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। আসম হান্নান শাহ এ আসন থেকে ’৯১ ও ’৯৬ (১৫ ফেব্রুয়ারি’র) সালের নির্বাচনে জয়লাভ করলেও পরবর্তীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের দুটি নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের স্থানীয় প্রার্থীর কাছে হেরে যান। আসন্ন দশম নির্বাচনেও প্রার্থিতার জন্য জামালউদ্দিন আহমেদ, সাবেক সংসদ সদস্য (’৭৯ সালে নির্বাচিত) ডাঃ ছানাউল্লাহ, জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের কেন্দ্রীয় সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের অধ্যাপক ফখরুদ্দিন, উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও রায়েদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানের বিএনপির মনোনয়ন চাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও সিপিবির জেলা কমিটির এ্যাডভোকেট আসাদুল্লাহ বাদল ও জাতীয় পার্টির সামসুদ্দিন খান সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন।
এ আসনের মোট ২ লাখ ২৯ হাজার ৮৮৩ জন ভোটারের মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ১১ হাজার ৬৬৬ জন এবং মহিলা ভোটারের সংখ্যা ১ লাখ ১৮ হাজার ২১৬ জন।
গাজীপুর-৫ (কালীগঞ্জ, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ৩৯ নং হতে ৪২ নং ওয়ার্ড এবং গাজীপুর সদর উপজেলার বাড়িয়া ইউনিয়ন) ॥ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ও বর্তমান সরকারের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকী এমপির পিতা শহীদ ময়েজ উদ্দিন আহমেদের জন্মস্থান এটি। গত নির্বাচনে এ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন চুমকী। এবারও তিনি মনোনয়ন প্রত্যাশী। এ আসনের আরেক হেভিওয়েট প্রার্থী ডাকসুর সাবেক ভিপি আক্তারুজ্জামান। তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে ’৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। তিনিও এ আসন থেকে দলের মনোনয়ন চাইবেন। এছাড়াও প্রার্থিতার জন্য আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ডা. আসফার হোসেন মোল্লার মনোনয়ন চাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্য হেভিওয়েট প্রার্থী বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগাঠনিক সম্পাদক ও জেলা কমিটির সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য একেএম ফজলুল হক মিলন ও জাতীয়তাবাদী যুবদলের ভাইস প্রেসিডেন্ট আলবার্ট পি কস্টা এ আসন থেকে দলের মনোনয়ন চাইবেন। এছাড়াও জাতীয় পার্টির (এরশাদ) অঙ্গ সংগঠন জাতীয় শ্রমিক পার্টির কেন্দ্রীয় সভাপতি আনোয়ারা বেগম, জাতীয় পার্টির (মঞ্জু) সাবেক নেতা আজম খান, জাকের পার্টির মোঃ এখলাস উদ্দিন ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের (চরমোনাই) গাজী আতাউর রহমান সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন।
এ আসনটি আওয়ামী লীগের শক্তিশালী ঘাঁটি হলেও নেতৃত্বের কোন্দলের জেরে দলের প্রভাবশালী দু’নেতার রশি টানাটানির কারণে দলের স্থানীয় ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন করায় এখানকার নেতাকর্মীরা দৃশ্যমান দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিনের এ কোন্দল ক্রমেই বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যেই উভয় গ্রুপের কর্মী সমর্থকদের মাঝে একাধিকবার সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তারা বিভিন্ন সময়ে এলাকায় মহড়াও দিয়েছে। আসন্ন নির্বাচনের আগেই এ কোন্দল না মেটালে নির্বাচনে গণেশ উল্টে যেতে পারে বলে স্থানীয়রা মনে করেন।
একই অবস্থা বিরাজ করছে স্থানীয় বিএনপির মাঝেও। একনায়কতন্ত্র সিস্টেম বাস্তবায়নের জন্য দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের স্থানীয় বিভিন্ন কমিটিতে রাখা হয়নি। প্রতিপক্ষ ভেবে ওইসব নেতাকর্মীদের হয়রানি ও নির্যাতন করা হয়েছে। বিভিন্ন সুযোগসুবিধা দেয়া হয়েছে শুধু স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতার অনুসারীদের। এসব নিয়ে দলের স্থানীয় কর্মীসমর্থকদের মাঝে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ ও কোন্দল বিরাজ করে আসছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ইতোমধ্যেই বিবদমান দু’গ্রুপের কর্মীসমর্থকদের মাঝে একাধিকবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। নেতৃত্বের প্রভাব বিস্তার করতে তারা এলাকায় সশস্ত্র মহড়াও দিয়েছে। সম্প্রতি এক সংঘর্ষের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে স্থানীয় এক সাংবাদিক বিএনপির এক গ্রুপের কর্মীদের হামলার শিকার হন। গুরুতর আহত হয়ে ওই সাংবাদিককে কিছুদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।
এ আসনের মোট ২ লাখ ৬০ হাজার ২৬৮ ভোটারের মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৩১ হাজার ১৫৪ এবং মহিলা ভোটারের সংখ্যা ১ লাখ ২৯ হাজার ১১৬ জন।
প্রতিবেদকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু/নুরুল ইসলাম, গাজীপুর
কার্টেসিঃ দৈনিক জনকন্ঠ
প্রতিবেদকঃ মোস্তাফিজুর রহমান টিটু/নুরুল ইসলাম, গাজীপুর
কার্টেসিঃ দৈনিক জনকন্ঠ
COMMENTS