আজ সোমবার পবিত্র হজ। 'লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নিমাতা লাকা ওয়াল মুলক...' আল্লাহর সামনে নিজেকে সঁপে দেওয়ার আবেগ-অনুভূতি-ভালোবাসা বোঝাতে আরবি ভাষায় পবিত্র এসব ধ্বনির বাংলা অর্থ হলো, 'আমি হাজির, হে আল্লাহ, আমি হাজির। তোমার কোনো শরিক নেই। নিশ্চয়ই সব প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা শুধু তোমারই। সব সাম্রাজ্যও তোমার নিয়ন্ত্রিত।' এ বছর প্রায় ২০ লাখ হজ পালনরত মানুষের এমন নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ এবং আত্মশুদ্ধির আকুল আবেদন নিয়ে পালিত হচ্ছে পবিত্র হজ।
সৌদি আরবে আজ জিলহজ মাসের ৯ তারিখ। পবিত্র মক্কা নগরীর ১১ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত ঐতিহাসিক আরাফাত ময়দানে মিনা থেকে গিয়ে হজযাত্রীরা আজ সমবেত হবেন। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তাঁরা আরাফাতের ময়দানেই অবস্থান করবেন। কেউ পাহাড়ের কাছে, কেউ সুবিধাজনক জায়গায় বসে ইবাদত-বন্দেগি, জিকির-আজকার করবেন। দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ, রহমত প্রাপ্তি ও নিজের গুনাহ মাফের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে কায়মনোবাক্যে ফরিয়াদ জানাবেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা মুসলমানরা। একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হবেন, কুশল বিনিময় করবেন। বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের এক অনুপম দৃশ্যের অবতারণা হবে আজ আরাফাত ময়দানে। সেখানে মসজিদে নামিরা থেকে হজের খুতবা দেবেন সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি। পবিত্র হজের তিন ফরজের মধ্যে আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল। 'হজ' শব্দের আভিধানিক অর্থ 'ইচ্ছা করা'। ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম একটি হলো হজ। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি দেশ থেকে এবার প্রায় ২০ লাখ মুসলমান হজ পালন করছেন। বাংলাদেশ থেকে গিয়েছেন ৯০ হাজার দুজন।
আরাফাতের ময়দান দুই মাইল লম্বা ও দুই মাইল প্রশস্ত এক বিশাল সমতল মাঠ। এর দক্ষিণ পাশে মক্কা হাদা তায়েফ রিং রোড। এই রোডের দক্ষিণ পাশে আবেদি উপত্যকায় মক্কার উম্মুল কুরা ইউনিভার্সিটি। আরাফাতের উত্তরে সাদ পাহাড়। সেখান থেকে আরাফাত সীমান্ত পশ্চিমে আরো এক হাজার মিটার বিস্তৃত। হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণটি এ ময়দানেই দিয়েছিলেন। তখন এক লাখের বেশি সাহাবায়ে কেরাম উপস্থিত ছিলেন বলে বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
হজের বিধিবিধান পালনের অংশ হিসেবে মক্কা থেকে কেউ গাড়িতে, কেউ হেঁটে মিনায় পৌঁছান। আরাফাতের ময়দানে যাওয়ার এক দিন আগে মিনায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা সুন্নত। এই সুন্নত আদায় করতে হজের এক দিন আগে মিনায় যান হাজিরা। এরপর ৯ জিলহজ (বাংলাদেশে ৮ জিলহজ) 'উকুফে আরাফাহ' অর্থাৎ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করেন তাঁরা।
আজ সোমবার আরাফাতের ময়দানে খুতবার পর জোহর ও আসরের নামাজ আদায় করবেন হাজিরা। তাঁরা সূর্যাস্ত পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে পাঁচ কিলোমিটার দূরের মুজদালিফায় গিয়ে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করবেন। রাতে সেখানে অবস্থান করবেন খোলা মাঠে। শয়তানের প্রতিকৃতিতে পাথর নিক্ষেপের জন্য প্রয়োজনীয় পাথর সংগ্রহ করবেন সেখান থেকে।
মুজদালিফায় ফজরের নামাজ আদায় করে হাজিরা মিনায় যাবেন এবং নিজ নিজ তাঁবুতে ফিরবেন। মিনায় বড় শয়তানকে সাতটি পাথর মারার পর পশু কোরবানি দিয়ে মাথার চুল ছেঁটে (ন্যাড়া করে) গোসল করবেন। সেলাইবিহীন দুই টুকরো কাপড় বদলাবেন। এরপর স্বাভাবিক পোশাক পরে মিনা থেকে মক্কায় গিয়ে পবিত্র কাবা শরিফ সাতবার তওয়াফ করবেন। কাবার সামনের দুই পাহাড় সাফা ও মারওয়ায় 'সাঈ' (সাতবার দৌড়াবেন) করবেন। সেখান থেকে তাঁরা আবার মিনায় যাবেন। সেখানে আরো এক বা দুই দিন অবস্থান করে হজের অন্য আনুষঙ্গিক কাজগুলো সম্পন্ন করবেন। মিনার কাজ শেষে আবার মক্কায় বিদায়ী তওয়াফ করার পর যাঁরা মদিনায় যাননি, তাঁরা মদিনায় যাবেন। যাঁরা আগে মদিনায় গেছেন, তাঁরা নিজ নিজ দেশে ফিরবেন।
মিনায় জামারাতের (শয়তানের উদ্দেশ্যে পাথর মারার স্থান) কাছে ও পুরো মিনায় আরবি, ইংরেজি, ফারসি, চীনা ও মালয় ভাষার পাশাপাশি বাংলায়ও নির্দেশনা দেওয়া আছে। হাজিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সৌদি কর্তৃপক্ষ পুলিশ, আধাসামরিক ও সামরিক বাহিনী মোতায়েন করেছে। হাজিরা পথ হারিয়ে ফেললে স্বেচ্ছাসেবক, স্কাউট ও হজকর্মীরা তাঁদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পেঁৗছে দেবেন। মক্কা, মিনা ও আরাফাতের ময়দানে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে সব হাজিকে প্রতিবছরের মতো বিনা মূল্যে খাবার, বিশুদ্ধ পানিসহ সব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান হাজিদের নানা উপহার দিচ্ছে। জামারায় শয়তানের প্রতিকৃতিতে পাথর নিক্ষেপের পর হাজিদের পশু কোরবানির প্রস্তুতি নিতে হয়। তাঁরা আগামীকাল কোরবানি দেবেন। অধিকাংশ হাজি নিজে বা বিশ্বস্ত লোক দিয়ে কোরবানি দেন। অনেকে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে (আইডিবি) কোরবানির পশুর মূল্য জমা দিয়ে তাদের ব্যবস্থাপনায় কোরবানি দেন।
সৌদি সরকারের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের হজ মিশনের নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে বাংলাদেশের হজ পালনকারীদের সার্বিক বিষয় নিয়মিত দেখভাল করা হচ্ছে।
COMMENTS