![]() |
হরতাল সমর্থকদের দেওয়া আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বিআরটিসির পাঁচটি দোতলা
বাস।
ছবিটি রাজধানীর গাবতলী বিআরটিসি বাস ডিপো থেকে তোলা। ছবি: মনিরুল আলম
|
১৮ দলীয় জোটের ৬০ ঘন্টব্যাপী হরতালে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে ৫ জন নিহত, অগ্নিসংযোগ,ভাংচুর ও সহিংস ঘটনার মধ্য দিয়ে রাজধানীসহ সারাদেশে প্রথম দিন অতিবাহিত হয়েছে।
হরতাল সমর্থকদের হামলায় যশোরের অভয়নগরে এক যুবলীগ নেতা, ফরিদপুরের নগরকান্দার উপজেলায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে এক যুবদল কর্মী, পিরোজপুরের জিয়ানগরে শিবিরের হামলায় এক আওয়ামী লীগ কর্মী, টাঙ্গাইলে শিবিরের হামলায় ছাত্রলীগ নেতা এবং পাবনার ঈশ্বরদীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংঘর্ষে এক জামায়াত কর্মী নিহত হয়েছে।
অগ্নিসংযোগ, সংঘর্ষ, ভাংচুর ও সহিংস ঘটনার মধ্য দিয়ে আজ রাজধানীসহ সারাদেশে ১৮ দলের ৬০ ঘন্টাব্যাপী হরতাল চলছে। এ সময় সারাদেশে অসংখ্য ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
পুলিশ জানায়, হরতালের প্রথম দিনে রাজধানীতে ৮টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ও ৫ট যানবাহন ভাংচুর হয়েছে। রাজধানীতে এ সময় পুলিশ ৪১ জনকে আটক করে। মোবাইল কোট ১১ জনকে ৬ মাস করে সাজা দিয়েছে।
রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে রোববার ভোর থেকে সহিংস ঘটনা ঘটেছে। বিক্ষিপ্তভাবে ভাঙচুর, মিছিল ও ককটেল নিক্ষেপ করেছে হরতাল সমর্থকরা।
মিরপুর-২ এলাকায় প্রশিকা ভবনের সামনে সকাল সাড়ে ছয়টায় হরতালের সমর্থনে শিবিরের একটি মিছিল বের হয়। পুলিশ ধাওয়া দিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।পরে সেখান থেকে ১৩ জনকে আটক করা হয়।
পুলিশের মিরপুর বিভাগীয় উপকমিশনার ইমতিয়াজ আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, আটককৃতদের বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা ছিল। তাদের কাছে পেট্রোল পাওয়া গেছে।
সকাল ছয়টায় তেজগাঁওয়ে চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের গলিতে মিছিল করে যুবদল। রাস্তায় তারা কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে কেউ হতাহত হয়নি। একই সময়ে তেজগাঁও নাবিস্কো মোড়ের উত্তর পাশে ১৫-২০ জনের একটি মিছিল বের করে ছাত্রদল।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগীয় উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার জানান, সেখান থেকে একজনকে আটক করা হয়েছে। সাড়ে সাতটায় শ্যামলীর রিংরোডে কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ হয়। কে বা কারা রাস্তায় এসব ককটেল নিক্ষেপ করে তা কেউ বলতে পারেনি।
সকালে আজিমপুরে দুটি রিকশা ও একটি অটোরিকশায় আগুন দিয়েছে হরতালকারীরা। সেখানে চারটি গাড়ি ভাঙচুর ও তিনটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়। রাজধানীর আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডে সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে দুটি রিকশা ও একটি অটোরিকশায় আগুন দিয়েছে হরতাল সমর্থকরা। এর কিছু পরে নিউমার্কেটের কাছে চারটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। একই সময় রাস্তায় তিনটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
রাজধানীর নর্দ্দা এলাকায় প্রধান সড়কে সকাল সাতটার দিকে হরতাল সমর্থকরা তিনটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। সেখান থেকে পুলিশ কাউকে আটক করতে পারেনি। খিলগাঁওয়ের পল্লীমা সংসদের সামনে সকাল আটটার দিকে যুবদলের ব্যানারে একটি মিছিল বের হয়। মিছিল থেকে তিনটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে।
ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে আটটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে হরতাল সমর্থকরা। ভোর পাঁচটার দিকে ধানমন্ডি আবাহনী মাঠের কোনায় ককটেল নিক্ষেপ করে তারা পালিয়ে যায়।
যাত্রাবাড়ীর ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের অফিসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।ভোর ছয়টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
যাত্রাবাড়ীর ধোলইপাড় এলাকায় সকাল সাড়ে সাতটায় একটি ঝটিকা মিছিল বের করে সেচ্ছাসেবক দল। এ সময় তারা একটি ককটেল বিস্ফোরণ ও বেশ কয়েকটি রিকশা ভাঙচুর করে। ঘটনাস্থলে র্যাব সদস্যরা গেলে মিছিলকারীরা দ্রুত পালিয়ে যায়।
যশোর থেকে বাসসের সংবাদদাতা জানান, রোববার সকালে পিকেটারদের হামলায় জেলার নওয়াপাড়া পৌর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন শিমুল (৩৫) নিহত হয়েছেন। এ সময় তার কয়েকজন সহযোগীও গুরুতর আহত হয়।
রোববার সকাল সাড়ে আটটার দিকে নওয়াপাড়া ফেরিঘাট সংলগ্ন হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল সাড়ে আটটার দিকে যুবলীগ নেতা শিমুল তার সহযোগীদের নিয়ে একটি মাইক্রোবাসে করে নওয়াপাড়ায় অবস্থান করছিলেন। এ সময় হরতালের সমর্থনে বিএনপি-জামায়াতের একটা মিছিল ওই এলাকা অতিক্রম করছিল। শিমুল ও তার সহযোগীরা তাদের মিছিলে বাধা দিলে মিছিলকারীরা শিমুলের মাইক্রোবাসে হামলা চালিয়ে তাদের মারধর করে এবং মাইক্রোবাসে আগুন ধরিয়ে দেয়।
হরতাল সমর্থকরা শিমুলকে তাড়া করে নওয়াপাড়া হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির কাছে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক পিটিয়ে হত্যা করে। এ সময় শিমুলের কয়েকজন সহযোগী গুরুতর আহত হয়। তাদের যশোর মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে, পাবনা সংবাদদাতা জানান, জামায়াতের নেতা-কর্মীরা শনিবার সকালে হরতালের সমর্থনে ঈশ্বরদীর মুলাডুলিতে মিছিল বের করে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা মিছিলে বাধা দেয়। এ নিয়ে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে জামায়াত কর্মী জুলহাস (৪০) নিহত হয়। এ ঘটনায় আরো সাতজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে ।
এদিকে ফরিদপুর থেকে সংবাদদাতা জানান, ফরিদপুরের নগরকান্দার উপজেলায় হরতাল চলাকালে সকাল সোয়া ৮টার দিকে পুলিশের সঙ্গে যুবদলের সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিতে যুবদলের এক কর্মী নিহত হয়েছেন। তার নাম মারুফ শেখ (১৮)। এ সময় আরো দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়। তাদের ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল সোয়া আটটার দিকে বিএনপি’র নেতা- কর্মীরা হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করলে পুলিশ তাদের ধাওয়া করে। এ সময় হরতাল সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের এক পর্যায়ে যুবদল কর্মী মারুফ শেখ গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এ সময় ঘরের জানালা বন্ধ করতে গিয়ে ফাতেমা নামে এক গৃহবধূ গুলিবিদ্ধ হয়।
বাসস সংবাদদাতা জানান, পিরোজপুরের জিয়ানগর চরবলেশ্বর বালিপাড়া গ্রামে রোববার ভোরে শিবিরের হামলায় স্বপন শীল নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী নিহত হয়েছেন। শিবির কর্মীরা তার দুই পায়ের গোড়ালি থেকে রগ কেটে দেয়ায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে স্বপনের মৃত্যু হয় বলে হাসপাতাল সূত্র জানায়।
তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে বেলা ১২টার দিকে সেখানে তার মৃত হয়। নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানায়, ভোরে শিবিরকর্মীরা বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ধারালো অস্ত্র দিযে তাকে কুপিয়ে জখম করে।
টাঙ্গাইল থেকে সংবাদদাতা জানান, জেলার কালিহাতী উপজেলার বেহেলাবাড়ী গ্রামে গতকাল শনিবার শিবিরের হামলায় আহত স্থানীয় ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবুল কালাম (৩৫) আজ রোববার দুুপুরে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা গেছেন।
কালিহাতী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহিরুল ইসলাম ও নিহতের বড়ভাই আবু আলী জানান, শনিবার বিকেলে আবুল কালাম রতনগঞ্জ বাজার থেকে মোটরসাইকেলযোগে বাড়ি ফিরছিলেন। এ সময় তিনি বেহেলাবাড়ী ঘাটপাড় নামকস্থানে পৌঁছলে শিবির কর্মীরা আবুল কালামকে কুপিয়ে আহত করে।
গুরুতর আহত অবস্থায় রাতে তাকে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আজ দুপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেখানে তার মৃত্যু হয়। নিহত আবুল কালাম বেহেলাবাড়ী গ্রামের আলহাজ মোকছেদ আলীর ছেলে।
এদিকে হরতালের শুরুতে রাজধানীর গাবতলী, সাভার-আশুলিয়া ও দনিয়ায় ১২টি বাসে আগুন দিয়েছে হরতালকারীরা ।
শনিবার ভোর ৪টার দিকে গাবতলীতে বিআরটিসি’র ছয়টি দ্বিতল বাসে আগুন লাগিয়ে দেয় দুবৃর্ত্তরা। এতে দুটি বাস সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভোর ৪টার দিকে ডিপোর দেয়াল টপকে কয়েক জন যুবক বাসে আগুন লাগিয়ে পালিয়ে যায়।
ভোর ৬টার দিকে ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকা সাভার-আশুলিয়ার পৃথক স্থানে পাঁচটি গাড়িতে আগুন দেয়া হয়। এসময় পুলিশের সঙ্গে হরতালকারীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে কমপক্ষে ১৫জন আহত হয়। পুলিশ কাউকে আটক করতে পারেনি ।
এদিকে সকাল সোয়া ৮টার দিকে রাজধানীর দনিয়ার ফাহাদ টাওয়ারের সামনে হরতালকারীরা বাপেক্সের একটি স্টাফ বাসে আগুন দেয়। ুতারা সেখানে কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়।
মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, মুন্সীগঞ্জে দফায় দফায় হরতাল সমর্থনকারী, পুলিশ ও হরতাল বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় ৫ পুলিশসহ ২৫জন আহত হয়েছে। আহতদের স্থানীয় ভাবে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
বেলা সাড়ে ১১ টায় গজারিয়া উপজেলা জামালদি বাস স্ট্যান্ডের কাছে হরতার সমর্থন কারীরা পুলিশের উপর হামালা চালায়। এ সময় মিছিল ৩ পুলিশ আহত হয়েছে। এ সময় হরতাল সমর্থনকারীরা পুলিশের গাড়ি ভাংচুর করে। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে এবং আতœরক্ষায় পুলিশ ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এ সময় হোসেন্দি ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাদিম গুলিবিদ্ধ হয়।
এছাড়া সকালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির হরতালের সমর্থনে ও বিপক্ষে মিছিল কারীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় ঢাকা মাওয়া মহাসড়কের সিরাজদিখান উপজেলার নীমতলাতে ২ পুলিশসহ ৫ জন আহত হন। সিরাজদিখান থানার ওসি আবুল বাসার জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রয়ে পুলিশ কয়েক রাউন্ড টিয়ার গ্যাস ও ফাঁকা গুলি করে করে। পরিস্থিতি বর্তমানে থমথমে রয়েছে।
লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জানান, ১৮দলীয় জোটের হরতালের প্রথম দিনে রোববার লক্ষ্মীপুর শহরের বাস টার্মিনাল, আলিয়ামাদ্রাসা, মিয়ার বেড়ী, সদরের দালালবাজার, মান্দারী বাজার, চন্দ্রগঞ্জ বাজার এলাকায় ৩০/৩৫টি ককটেল বিষ্ফোরন ঘটনায় হরতালকারীরা। এ ছাড়া সকালে চরচামিতা, আলীয়ামাদ্রাসা ও দালালবাজার এলাকায় ৫টি অটোরিক্সা ভাঙচুর করে তারা। এসময় এসবস্থানের সড়কে গাছের গুড়ি ও টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করে পিকেটাররা। অন্যদিকে সকালে শহরে পৃথক মিছিল ও সমাবেশ করে বিএনপি এবং জামায়াত-শিবির।
হরতালে জেলার প্রাধান বাস টার্মিনাল থেকে দুরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। অফিস আদালত খোলা রয়েছে তবে উপস্থিতি কম।
লক্ষ্মীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইকবাল হোসেন জানান, অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে শহর ও সদর উপজেলার বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ স্থানে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
১৮ দলীয় জোটের হরতাল চলাকালে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার হাজিরপাড়া বাজার এলাকায় রোববার সকালে প্রায় ৮শতাধিক পত্রিকায় আগুন দিয়েছে হরতালকারীরা। এদিকে রামগঞ্জ উপজেলার আলিপুর নামক স্থানে হরতালকারীদের বাধার মুখে জেলার ৫টি সংবাদপত্র পরিবেশকের পত্রিকা নিয়ে ফিরে গেছে পরিবহন। এতে করে পত্রিকা না পেয়ে বিক্রেতা ও পাঠকদের মধ্যে বিরাজ করছে ক্ষোভ-হতাশা। লক্ষ্মীপুর থানার ওসি ইকবাল হোসেন জানান, পত্রিকায় আগুন দেওয়ার বিষয়টি কেউ তাকে জানায়নি। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেবেন।
- বাসস
COMMENTS