মোঃ মুজিবুর রহমানঃ
আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও স্বাধিকারবোধে উদ্দীপ্ত বাঙালির ইতিহাসের অবিস্মরণীয় উজ্জ্বল এক দিন। তেইশ বছর আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার জন্য ধাপে ধাপে জাতিকে প্রস্ত্তত করে তোলেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়। ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে এ দেশের প্রশাসন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশই চলেছে। তাইতো বলতে হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ৭ মার্চ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই ভাষণের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য কখনোই হারাবে না।
আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। বাঙালি জাতীয়তাবোধ ও স্বাধিকারবোধে উদ্দীপ্ত বাঙালির ইতিহাসের অবিস্মরণীয় উজ্জ্বল এক দিন। তেইশ বছর আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার জন্য ধাপে ধাপে জাতিকে প্রস্ত্তত করে তোলেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়। ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে এ দেশের প্রশাসন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশই চলেছে। তাইতো বলতে হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ৭ মার্চ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এই ভাষণের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য কখনোই হারাবে না।
মানব সভ্যতার ইতিহাস পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ। এ ভাষণটি বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠতম ভাষণ। ভাষণটি ছিল খুবই সাজানো ও প্রাণবন্ত। আবার রাষ্ট্রনায়কসুলভ অভিব্যক্তি এতে প্রকাশ পেয়েছে। আজ থেকে ৪৩ বছর আগে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ( বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। কীভাবে লড়াই করতে হবে সে বিষয়ের নির্দেশ ছিল ওই ভাষণে। বিশ্বে এ ভাষণ গুরুত্বপূর্ণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ভাষণ হিসেবে বিধৃত। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের ১৯ নভেম্বর ১৮৬৩ তারিখের প্রদত্ত গেটিসবার্গ ভাষণ গণতন্ত্রের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। তেমনিভাবে ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে এবং নির্যাতিত মানুষের কাছে স্বাধীনতার বীজমন্ত্রতুল্য বলে বিবেচিত হবে। আব্রাহাম লিংকন ভাষণ দিয়েছেন আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে। আর বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত ভাষণ ছিল স্বাধীনতা লাভের পটভূমিতে। আর আব্রাহাম লিংকনের ভাষণের পটভূমি ছিল গণতন্ত্র রক্ষা। এ ভাষণের পরিসর ছিল সীমিত। আর বঙ্গবন্ধুর ভাষণের বিষয়বস্ত্ত ছিল আরও অনেক ব্যাপকতা । বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পটভূমি , পরিস্থিতি ও পরিবেশ ছিল আব্রাহাম লিংকনের ভাষণের চাইতে বেশি সংকটময় ও অগ্নিগর্ভ। আর উল্লেখ করা যায় , আব্রাহাম লিংকনের ভাষণের একটি লিখিত রূপ ছিল। অপরদিকে বঙ্গবন্ধুর ১৯ মিনিটের ভাষণ লিখিত ছিল না। আব্রাহাম লিংকনের ভাষণের সময়সীমা ছিল তিন থেকে চার মিনিট। আব্রাহাম লিংকনের ভাষণের শব্দসংখ্যা ছিল মাত্র ২৭২টি। আর বঙ্গবন্ধুর ভাষণের শব্দসংখ্যা ছিল ১১০৭টি। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, আব্রাহাম লিংকন ভাষণ দিয়েছেন আমেরিকার স্বাধীনতা লাভের অনেক পরে। তখন তিনি ছিলেন ষোলতম আমেরিকার প্রেসিডেন্ট । আর বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়েছেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে ।
একাত্তরের ৭ মার্চের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সব মিছিলই এসে থামে রেসকোর্স ময়দানে। ঢাকা শহর ছিল মিছিলের শহর। মিছিল আর মিছিল। বিশাল রেসকোর্স ময়দান রূপ নেয় জনসমুদ্রে। বাঁশের লাঠির সঙ্গে লাখো কণ্ঠের শেস্নাগানে কেঁপে ওঠে সেদিনের জনসমুদ্র এবং ঢাকা শহর। বাতাসে উড়ে সবুজ জমিনে বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল সূর্যের অসংখ্য পতাকা । বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতাকাটা কালো কোট পরে বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু দৃপ্ত পায়ে উঠে এলেন মঞ্চে। শেস্নাগান আর মহুর্মুহু করতালির মধ্যে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানালেন অপেক্ষামাণ জনসমুদ্রকে। তারপর শুরু করলেন তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ। রেসকোর্স ময়দানের এই ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে ডাক দেন, সেই ডাকেই বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি নিতে থাকে। পরে ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী নৃশংস গণহত্যা শুরু করে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। এদিকে গোটা জাতি ছিল প্রস্ত্তত, ৭ মার্চের ভাষণের দিকনিদের্শনা জাতির সামনে স্পষ্ট- যা বঙ্গবন্ধু দিয়েছিল এভাবে, ‘ প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রম্নর মোকাবিলা করতে হবে।... প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্ত্তত থাক।’ ভাষণের যেসব অংশে বঙ্গবন্ধুর আদেশ, নির্দেশ, অনুরোধ ছিল সেগুলো মুক্তিযুদ্ধকালে অগ্নিমন্ত্রের মতো কাজ করেছে। আবার বিশ্ব জনমতের সমর্থন ও কূটনীতির ক্ষেত্রে এই ঐতিহাসিক ভাষণ প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত করেছে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ও সমগ্র বাঙালি জাতির বিশাল ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছিলাম বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্র তখন উত্তাল। সময় তখন ফুরিয়ে যাচ্ছে। বাঙালি যেন আরও কিছু শুনতে চায়। অবশেষে অবিনশ্বর পংক্তিটি বঙ্গবন্ধু উচ্চ করলেন, যা শোনার জন্য বাঙালি জাতি উন্মুখ ছিল, ‘ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তখন বাংলার মাটি ও বাঙালি জাতি একাকার হয়ে গর্জন দিয়ে ওঠে লক্ষ কোটি কামানের মতো। সেদিনের ভাষণে শুধু স্বাধীনতা নয়, মুক্তির কথাও বলেছেন। যার তাৎপর্য আরও গভীর । সাহস, প্রতিজ্ঞা ও স্বদেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতির ঘুরে দাঁড়ানোর একটি দিন ছিল একাত্তরের ৭ মার্চ। বাংলাদেশ নামক দেশটি অবয়ব তৈরির কাজটি করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণে।
রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে নিদের্শনামূলক কাব্যময় বক্তৃতা প্রদান একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষই সম্ভব বিধায় আন্তর্জাতিক সাময়িকী নিউজউইক একাত্তরের ৫ এপ্রিলে প্রকাশিত তাদের প্রচ্ছদ নিবন্ধে ‘রাজনৈতিক কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। এই রাজনৈতিক কবির অমর রচনা হচ্ছে ৭ মার্চের ভাষণ। যা বাঙালির মহাকাব্য। রেসকোর্সের জনসমুদ্র সেদিন মন্ত্রমুগ্ধের মতো আবিষ্ট হয়েছিল সেই বজ্রকণ্ঠে। তাঁর ভাষণের প্রতিটি পংক্তি যেন কালজয়ী কবিতার পংক্তি। এই মহাকাব্য বাঙালি জাতির সংগ্রাম-আন্দোলনের ধারা ও লালিত স্বপ্ন থেকে উৎসারিত। এই মহাকাব্য বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উদ্দীপ্ত ও দীপ্ত করেছিল।
বাঙালির অন্যতম মেধাসম্পদ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি জাতির মাঝে বেঁচে থাকবে । রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় হিসেবে এ ভাষণের আবেদন কোনোদিন শেষ হয়ে যাবে না। ওই ভাষণ আমাদেরকে অনুপ্রেরণা যোগাবে ।
আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে, ওই ভাষণে নিহিত সত্য শিক্ষা যত বেশি গভীরে অনুধাবন করতে শিখবো ততই আমাদের মুক্তির পথ সহজতর হবে। বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশানমূলক এই ঐতিহাসিক ভাষণের শেষ অবিনশ্বর পংক্তিটি বাঙালির কাছে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ঐ মহাকাব্যিক ভাষণ যুগযুগ ধরে বাঙালি জাতিকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় উজ্জীবিত রাখবে বলে বিশ্বাস করি। সেই সঙ্গে বাঙালি জাতি পাবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে অবিনাশী প্রেরণা।
লেখকঃ কলেজ শিক্ষক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, এবং আর্কাইভস ৭১- এর প্রতিষ্ঠাতা
COMMENTS