মো. মুজিবুর রহমান: বাঙালি জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির প্রতীক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন আজ। এই মহানায়ক ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বৃটিশ শাসিত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শেখ লুৎফর রহমান, মাতা সাহেরা খাতুন।
তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আদায়ের দাবি আন্দোলন-সংগ্রাম প্রতিনিয়ত প্রবল হতে শুরু করে। স্কুলপড়–য়া ছাত্র শেখ মুজিব একটি সংবর্ধনা প্রদান অনুষ্ঠানের জের ধরে কংগ্রেস ও অন্যান্য পার্টির নেতাদের রোষানলের শিকার হয়ে কারাবরণ করেন। সেই থেকে কারাবরণ শুরু।
রাজনৈতিক ২৩ বছরের মধ্যে ১৪ বছরই কারাগারে ছিলেন তিনি। স্কুলে পড়াকালেই তিনি অত্যন্ত সাহসী ও প্রতিবাদী ছিলেন। প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করার পর কলকাতায় পড়াশুনা করেছেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে আদর্শের সঙ্গে সমন্বিত করে ধাপে ধাপে এগিয়েছেন। চলার পথ যতই বন্ধুর হোক না কেন বাঙালির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু এগিয়ে গেছেন সকল বাধা-প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে সামনের দিকে। এই মহানায়ক সম্পর্কে বর্ণনার কি শেষ আছে? জবাবে বলতে হবে - না, তাঁর সম্পর্কে কথা বা বর্ণনার শেষ নেই। তবু অল্প কথায় যদি বলি, যত দিন এই জনপদে মানুষ থাকবে, ততদিন মানুষের অন্তরের মণিকোঠায় চিরভাস্বর হয়ে থাকবে তাঁর কীর্তি। সেই সঙ্গে বাঙালি জাতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে এই মহানায়কের নাম বাঙালি জাতির প্রতীক হিসেবে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো জ্বলবে।
সকল প্রকার আন্দোলনে অনড় থেকে বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন বাঙালি জাতির মহানায়ক বঙ্গ্বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বারবার মৃত্যুঝুঁকি মাথায় নিয়ে পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি শুধুমাত্র বাংলাদেশের নেতা ছিলেন না। তিনি ছিলেন দক্ষিণ এশিয়াসহ সারবিশ্বের নির্যাতিত ও নিপীড়িত মুক্তিকামী মানুষের নেতা। যারা নির্যাতিত, নিপীড়িত ও মুক্তিকামী তাদের মনের আশার উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসেবে তিনি চি্িহ্নত হয়েছিলেন। ইতিহাসের মহাসড়কে বঙ্গবন্ধু নিজস্ব পথ তৈরি করে এগিয়ে গেছেন। তাঁর রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা শুরু মুসলিম লীগের রাজনীতি দিয়ে । তা সত্ত্বেও ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক বাহক।
সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলিম লীগের সামন্ত মানসিকতা ও শ্রেণি চরিত্র প্রত্যক্ষ করে অনেকের মতো তিনিও অনুধাবন করেন যে পাকিস্তান বাঙালি স্বপ্নপূরণে সমর্থ হবে না। আর যে মুসলিম লীগের পতাকাতলে তিনি নিজেও পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন, সেই মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাই হয়তো বেশিদিন সম্ভবপর হবে না বলে তিনি মনে করেন। এ স্বাধীনতা প্রকৃত স্বাধীনতা নয় তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল এদেশের মানুষের কল্যাণ সাধন এবং স্বাধীন ও মুক্তির লক্ষ্যে তাদের চালিত করা। বঙ্গবন্ধু গঠন করেন ১৯৬২ সালে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতাদের দিয়ে নিউকিয়াস বা স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ। প্রথমে এর সদস্য হন আবদুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহমেদ। পরে যুক্ত হন শেখ ফচলুল হক মণি ও তোফায়েল আহমেদ। ক্রমশ এ সংগঠনটি সারা বাংলায় বিস্তৃত হয়।
১৯৫৬ সালের জুন মাসে বঙ্গ্বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে তিনি শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম. দুর্নীতিদমন বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু বেশিদিন তিনি মন্ত্রী থাকেননি। আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ১৯৫৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয়। সারাদেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। সামরিক শাসন প্রবর্তনের চারদিনের দিন বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬১ সালের শেষে দিকে হাইকোর্টে রিট আবেদনের মাধ্যমে মুক্তিলাভের পর বঙ্গবন্ধু সামরিক শাসন ও আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে গতিবেগ সঞ্চারের লক্ষ্যে গোপনে রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করতে থাকেন।
১৯৬২ সালের প্রথম দিকে জনরিাপত্তা অঅইনে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। চার বছরের সামরিক শাসনের অবসান ঘটলে ১৯৬২ সালের মাঝামাঝি সময়ে কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্তিলাভ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি বাংলাদেশের স্বধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য বিশিষ্ট ছাত্রনেতাদের সমন্বয়ে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা প্রস্তাবের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ঘোষণা করেন । এই বছর থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারা তীব্রতর হয়। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা।
বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষা, দুঃখ-বেদনা, ক্ষোভ-বিক্ষোভ, বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তিনি নিজের চেতনায় ধারণ করেছেন। ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবিতে যখন আন্দোলন গড়ে উঠছে, বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, তখন বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনী সে মামলার নাম দেয় আগতলা ষড়যন্ত্র মামলা। তাঁকে সেই মামলায় দীর্ঘদিন কারাবন্দি রেখে ফাঁসি দেয়ার প্রক্রিয়া করেছিল পাকিস্তানি জান্তা। কিন্তু লক্ষ্য থেকে একটুও বিচ্যুতি করা যায়নি বঙ্গবন্ধুকে।
পর্যায়ক্রমে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মনে সূর্যের আলোর প্রদীপ্ত শিখা প্রজ্বলিত করেছেন, জাতিকে করেছেন আত্মসচেতন, জাগিয়েছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের বোধশক্তি, দিয়েছেন সেøাগান : ‘জয়বাংলা’। ‘জয় বাংলা’ দিয়ে বাঙালি জাতিকে একসূত্রে গেঁথেছিলেন। সেই সঙ্গে বাঙালি জাতিকে একটি চেতনায়, একটি ভাবধারায় ও একটি আকাক্সক্ষায় তিনি ঐক্যবদ্ধ করেছেন। পাকিস্তানি জান্তার সব রকমের ষড়যন্ত্র বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু এ দেশের সর্বশ্রেণীর মানুষের প্রাণের মানুষে পরিণত হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের রায় সেটাই প্রমাণ করে। এই জনরায়ে সমর্থিত হয় স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ও বাঙালির সাংস্কৃতিক অধিকার।
একাত্তরের উত্তাল মার্চে বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন এ জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতা কেউ ঠেকাতে পারবে না এবং কোন পশুশক্তি ও পরাশক্তির কাছে পরাজিত হবে না এ জাতি। এ জন্য মুক্তি ও স্বাধীনতার ডাক দিলেন সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে : “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” উত্তাল ও অগ্নিঝরা মার্চে বঙ্গবন্ধু জাতিকে ঐক্যের বাঁধনে বেঁধেছিলেন, বাঙালির সেই ঐক্য ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র ও মনোবল ছিল।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শুধু অস্ত্রের লড়াই ছিল না, ছিল মনস্তত্তের লড়াই, ছিল অনুভূতির লড়াই। এ লড়াইয়ে জয়ের অমোঘ অস্ত্রটি বঙ্গবন্ধু একাত্তরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তা প্রেরণের মাধ্যমে তাঁর স্বদেশবাসী বাঙালির হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বন্দি হওয়ার আগে তাঁর যে বার্তা সম্প্রচারিত হয়েছিল তার প্রথম বাক্যই ছিল, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাঙালি ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণে সক্ষম হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়ক হিসেবে বাঙালিকে উপহার দিলেন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’- এ জাতীয় সঙ্গীত।
ভাষাভিত্তিক ও জাতীয়তাবোধভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে আত্মশক্তির প্রতীক করে তিনি বিশ্বের মানচিত্রে তুলে ধরেছিলেন। আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষা বাংলায় তিনি জাতিসংঘে ভাষণও দিয়েছেন। জাতিসংঘের সাধারণ সভায় মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দিয়ে তিনি শুধু বাঙালি জাতিকে সম্মানিত করেননি, ভাষা শহীদদের প্রতিও শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।
বাঙালি জাতিসত্তা ও সংস্কৃতি লড়াইয়ের প্রশ্নে কোনো আপস করেনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিুবুর রহমান। কেননা বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শনের পরিব্যাপ্তি ছিল বাঙালি জাতিসত্তায়। বাঙালি জাতিসত্তায় বিশ্বাসী বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে ভীষণ ভালবাসতেন বলেই ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিনে দেশের মাটিতে পা রেখেই সেই ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ছুটে যান লাখ লাখ অপেক্ষমাণ মানুষের সমাবেশে।
ভাষণ দিতে গিয়ে উচ্চারণ করলেন : “আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান, একবার মরে দুইবার মরে না। আমি বলেছিলেম, আমার মৃত্যু এসে থাকে যদি, আমি হাসতে হাসতে যাব। ... তোমাদের কাছে ক্ষমা চ্ইাব না এবং যাওয়ার সময় বলে যাব, জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান। ... আজ আমি বাংলাদেশে ফিরে এসেছি। আমার ভাইদের কাছে, আমার মা’দের কাছে। আমার বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন। বাংলার মানুষ আজ আমার স্বাধীন।” বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্যোক্তা। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিষয়ে বাঙালি জাতিকে গর্ববোধ করতে শিখিয়েছেন।
১২ জানুয়ারি ’৭২ বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে শুরু করলেন নতুন অভিযাত্রা। এক যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা দিলেন সোনার বাংলা গড়ার। রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে আমৃত্যু পর্যন্ত মেহনতি মানুষের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিই তাঁর কাছে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। দেশ পরিচালনার জন্য শাসনতন্ত্র দরকার , সেই নিরিখে চমৎকার একটি শাসনতন্ত্র (সংবিধান) উপহার দিলেন মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে। চারটি মূল স্তম্ভের ওপর এই শাসনতন্ত্র রচিত হলো। এই চার মূলনীতি হচ্ছে- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
গণপরিষদে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর শাসনতন্ত্র পাস করার দিনে প্রদত্ত ভাষণে এই চারটি মূলনীতি মর্মার্থ ব্যাখ্যা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘জাতীয়তাবোধের ভিত্তিতে বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল চরম মরণ- সংগ্রামে। জাতীয়তাবাদ না হলে কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। এই মূলনীতির উপর ভিত্তি করে আমরা এগিয়ে গিয়েছি। আমরা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। ...ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন, সকলের সঙ্গে একটা জিনিস রয়েছে, সেটা হলো অনুভূতি। এই অনুভূতি যদি না থাকে, তাহলে কোনো জাতি বড় হতে পারে না। জাতীয়তাবাদ আসতে পারে না।... জাতীয়তাবাদনির্ভর করে অনুভূতির উপর। আজ বাঙালি জাতি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে; এই সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল যার উপর ভিত্তি করে, এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে যার উপর ভিত্তি করে সেই অনুভূতি আছে বলেই আমি বাঙালি, আমার বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ... আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি।
গণতন্ত্র - সেই গণতন্ত্র যা সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করে থাকে। ... আমরা চাই, শোষিতের গণতন্ত্র এবং শোষিতের গণতন্ত্র অর্থ হলো- আমার দেশে যে গণতন্ত্রের বিধিলিপি আছে তাতে সেসব বন্দোবস্ত করা হয়েছে তাতে এদেশের দুঃখী মানুষ রক্ষা পায়, শোষকরা যাতে রক্ষা পায় তার ব্যবস্থা নাই। সেজন্য আমাদের গণতন্ত্রের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য আছে। ... আমাদের সমাজতন্ত্রের মানে শোষণহীন সমাজ। সমাজতন্ত্র আমরা দুনিয়া থেকে হাওলাত করে আনতে চাই না। সমাজতন্ত্রের মূলকথা হলো শোষণহীন সমাজ। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে সেই দেশের কি আবহাওয়া, কি ধরনের অবস্থা, কি ধরনের মনোভাব, কি ধরনের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে ক্রমশ এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে এবং তা আজকে স্বীকৃত হয়েছে। ... ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারো নাই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দেয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম করবে তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না।’
রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতিতে অসাম্প্রদায়িকতাই গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপের সন্ধান দেয়, সেই পরম সত্যের সন্ধানটি একজন সত্যদ্রষ্টা রাজনীতিবিদ ও রাজনীতির স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে বঙ্গবন্ধুই দিতে পেরেছিলেন এবং এই সত্যটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে বা সংবিধানে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত, শোষণহীন- নিরপেক্ষ আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এদিকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্র সব কিছু পাল্টে দেয়। এর পর শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, ধ্যানÑধারণা বিনাস করার নিরবচ্ছিন্ন তৎপরতা। বঙ্গবন্ধুর প্রণীত শাসনতন্ত্রের চার মূল স্তম্ভের প্রায় সব কিছু উপড়ে ফেলা হয়। ছড়ানো হয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবাষ্প।
শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু রাত-দিন পরিশ্রম করেছেন। তিনি পুঁজিবাদী শোষণের বাধা অতিক্রম করে জনসাধারণের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন করার লক্ষ্যে এদেশের জন্য কাক্সিক্ষত সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ভাবতেন এদেশে সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না, রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় ধর্ম কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করবে না, ধর্ম হবে জনগণের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। কাজ করেছেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য। বঙ্গবন্ধু শিক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করে ৪৪ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। নতুন নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন ও ৫০ হাজারেরও বেশি নতুন শিক্ষক নিয়োগ করেন। তিনি শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী তথা বিজ্ঞানসম্মত, বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষায় উন্নীত করার লক্ষ্যে ড. কুদরত-ই খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। সম্পদের সামাজিকীকরণের লক্ষ্যে জাতিকে উপহার দেন প্রথম পঞ্চমবাষিকী পরিকল্পনা। নিরন্তর চেষ্টা করেছেন দুঃখী মানুষের মুখের হাসি ফোটানোর জন্য। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন ঘিরে রয়েছে মেহনতি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার চিত্রপট। কৃষক-শ্রমিকদের কাজ-কর্মকে খুবই শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখতেন। জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু এক ভাষণে বলেন : “করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশন আমার বাংলার মজদুররা করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ।” বিভিন্ন স্থানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণে প্রমাণ মেলে তিনি এদেশের কৃষকÑশ্রমিকসহ মেহনতি মানুষকে, স্বদেশকে কতোটাই-না ভালবাসতেন। বঙ্গবন্ধুর এই দেশপ্রেম, দেশের মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ, কথা ও কাজের মধ্যে মিল, সত্যনিষ্ঠা, আপসহীন মনোভাব তাঁকে করে তুলেছিল অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে এবং বিশ্বরাজনীতিতে একজন প্রজ্ঞাবান ও বিচক্ষণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে অর্জন করেছিলেন সম্মানজনক অবস্থান।
বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে নিয়ে ভেবেছেন। এই জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিস্মরণীয় অবদান স্বাধীন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কথা তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে ও কর্মে কৈশোর থেকেই স্থান করে নিয়েছিল, এ কারণেই তাঁকে প্রদত্ত ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি (১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি) এদেশের মানুষের ভালবাসার প্রতিদান হিসেবে সার্থক হয়ে উঠেছে।
বঙ্গবন্ধু দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, বাঙালি জীবনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতেন, এসব নিয়ে ভাবতেন। বঙ্গবন্ধু প্রায়ই বলতেন : “সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই।” নব নব চিন্তা, চেতনা ও মূল্যবোধের মাধ্যমে সোনার মানুষ সৃষ্টি হবে; অন্য কোনো উপায়ে সোনার মানুষ সৃষ্টি হবে না-তা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। স্বদেশের কল্যাণে উদ্ভাসিত গণমুখী উন্নয়ন, কৃষক ও শ্রমিকের মঙ্গলাশ্রয়ী উন্নয়ন, বাংলার মাটির সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে জানুয়ারি মাসে গণমুখী জাতীয় ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে সমন্বিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ঘোষণা করে জাতীয় সংসদে বলেন “সুষ্ঠু শাসন কায়েম করতে হবে। যেখানে মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারে। যেখানে মানুষ অনাচার অত্যাচার থেকে বাঁচতে পারে। চেষ্টা নতুন। আজ আমি বলতে চাই – দিজ ইজ আওয়ার সেকেন্ড রেভ্যুল্যাশন, সেকেন্ড রেভ্যুল্যাশন আমাদের।
এই রেভ্যুল্যাশন-এর অর্থ হচ্ছে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। ... দলমত নির্বিশেষে সকলকে বলবো, দেশকে ভালবাসো, জাতির চারটি প্রিন্সিপলকে ভালবাসো। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সেকুলারিজম। তোমরা আসো, কাজ করো, দরজা খোলা।” এই আহবানকে মষ্টিমেয় মানুষ ভাল চোখে দেখেনি। তারপর জনগণ ও রাষ্ট্রের মঙ্গলচিন্তায় অগ্রসর হয়েছেন এবং থেমে থাকেননি বঙ্গবন্ধু। ঐ একই বছরে কৃষিখাতে মৌলিক সংস্কার আনার জন্য ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেন, “গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ভুল করবেন না। আমি আপনাদের জমি নেব না। পাঁচ বছরের প্ল্যানে বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামের প্রত্যেকটিতে কো-অপারেটিভ করা হবে। এ কো-অপারেটিভে জমির মালিকের জমি থাকবে। বেকার অথচ কর্মক্ষম প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে কো-অপারেটিভে সদস্য হতে পারবে। ...আপনার জমির বর্ধিত ফসলে আপনিও আগের তুলনায় বেশি ভাগ পাবেন, অংশ যাবে কো-অপারেটিভের হাতে, অংশ যাবে গভর্নমেন্টের হাতে।”
স্বাধীনতা লাভের পর মাত্র তিন বছরের কম সময়ে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বগুণ, ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাবের কারণে ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ১৩৬তম সদস্যপদ লাভ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একই বছরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২৯তম অধিবেশনে বাংলা ভাষায় প্রথম বক্তৃতা প্রদান করার গৌরব অর্জন করেন। অবশ্যই এই ভাষণ প্রদান ঐতিহাসিক ঘটনা।
বাংলাদেশকে শোষণমুক্ত একটি রাষ্ট্রে পরিণত করার যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখতেন তা বাস্তবায়নের প্রশ্নে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যদিকে বেশি করে এগিয়ে আসতে হবে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি- যারা এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ও দায়িত্বে রয়েছেন। তাহলেই স্বাধীন বাংলাদেশের নির্মাতা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত আদর্শ বাস্তব রূপ লাভ করতে পারবে, জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণ হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ও ঔদাসীন্যের পরিণতি কি হতে পারে সে বিষয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটু বেশি করে ভাবতে হবে এবং সেভাবেই তাঁকে সামনের পথ এগিয়ে যেতে হবে ।
বঙ্গবন্ধুর জীবন সাধনাই ছিল বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি। এজন্য জেল, জুলুম, হুলিয়া, ফাঁসির কাষ্ঠ পেরিয়ে প্রাণও দিলেন সপরিবারেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে। বাঙালি জাতির ট্র্যাজেডির মহানায়কও তিনি। বীরের জাতির পিতা বীরের মতো মৃত্যুবরণ করেছেন। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এমন আরেকজন মহানায়কের আবির্ভাব ঘটেনি। তাঁর জীবদ্দশায় প্রতিটি মুহূর্ত নিবেদন করে গেছেন বাঙালির জন্য। স্বদেশকে তাঁর জীবনের চেয়ে বেশি মূল্যবান মনে করতেন বলেই তিনি হতে পেরেছেন বাঙালি জাতির মহানায়ক ও সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তাঁর চেতনা জুড়ে ছিল বাংলা ও বাঙালি। বাঙালি জাতিকে বিশ্বের একটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে দেখতে চেয়েছেন বলেই তিনি জাতিকে সেই স্থানে অধিষ্ঠিত করেছেন। তিনি আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছেন। সেই সঙ্গে প্রতিটি বাঙালির কাছে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন। বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে ও তাঁর আদর্শ লালন ও ধারণ করে আজকের প্রজন্ম ও ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তাঁকে সঠিকভাবে তুলে ধরা আমাদের সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য। বাঙালি জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির প্রতীক হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও রাজনৈতিক দর্শন আমদের অনিঃশেষ অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে চিরদিন। সে সঙ্গে মুক্তির পথের সন্ধান দেবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।
৯৪তম জন্মবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুর পবিত্র স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
[লেখক : কলেজ শিক্ষক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক এবং আর্কাইভস ৭১-এর প্রতিষ্ঠাতা]
COMMENTS