গাজীপুরে বাঙালি সৈন্য ও কর্মকর্তাদের বিদ্রোহের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ শুরু

বাসস: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের সোহরাওয়ার্দী উদ্দ্যানের ঐতিহাসিক ভাষণকে গাজীপুরের ভাওয়াল রাজবাড়ীর সেনাক্যাম্পের ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনা অফিসারেরা স্বাধীনতার চূড়ান্ত সবুজ সংকেত হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।

তারা ১১ মার্চ হতে ১৯ মার্চ পর্যন্ত বেসামরিক তথা আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগও রক্ষা করেছিলেন।

গাজীপুরে ১১ মার্চ থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত স্বাধীনতার প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে তৎকালীন ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকশন কমান্ডার ও ওয়ারেন্ট অফিসার (অবঃ) বীরমুক্তিযোদ্ধা মোকলেছুর রহমান বাসসকে এ কথা জানান।

মোখলেছুর রহমান বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দান ) যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন আমাদের উর্দ্ধতন বাঙালি অফিসারেরা এটাকে চুড়ান্ত স্বাধীনতার গ্রীণ সিগন্যাল হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।

তিনি বলেন , কোম্পানী কমান্ডার ক্যাপ্টেন নূরুজ্জামানের নির্দেশে সুবেদার রাজ্জাক, হাবিলদার মান্নাফ, মঙ্গল মিয়া ও নায়েক মোজাম্মেলসহ আরো ২/৩জন বাঙালি সৈনিক নিয়ে তারা প্রথমে টঙ্গী নতুন বাজারস্থ শামসু মিয়ার বাড়ীতে ডাঃ হারুনুর রশিদ, সবদর আলী মাস্টার, কাজী শাহজাহান, আহসান উল্লাহ মাস্টার, নবীন সরকার, আজিজ কমিশনার, গাজী আব্দুল লতিফ, সানু সরকার প্রমুখের সাথে গোপনে মিটিং করেন এবং আঃ হাকিম মাস্টার এমপি, কাজী মোজাম্মেল হক ও হাসান উদ্দিন সরকারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন।

তিনি বলেন , ওই সময় তারা ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। এ কারণে মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী এবং ক্যাপ্টেন নূরুজ্জামানের গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌছে দেয়া সম্ভব হয়নি।

তিনি বলেন ,এর পরের দিন ১২ মার্চ সন্ধ্যায় জয়দেবপুর উল্কা সিনেমা হলের পিছনে ক্যাপ্টেন নূরুজ্জামান এবং তৎকালীন এমপি শামসুল হক, আজিম উদ্দিন মাস্টার, আব্দুস সাত্তার মিয়া প্রমুখের সাথে মিটিং করা হয়।

তিনি বলেন, স্বাধীনতার আন্দোলন যখন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করছিল, ঠিক সেই সময় খবর আসে বাঙালি সামরিক অফিসার, সৈন্য ও জোয়ানদের নিরস্ত্র করতে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠি গোপন ষড়যন্ত্র শুরু করেছে।

তিনি বলেন, বেসামরিক ব্যক্তিবর্গের সাথে মিটিংয়ের পর থেকে তারা বিদ্রোহের পরিকল্পনা শুরু করেন। তারা বাঙালি সৈন্য হিসেবে পাকবাহিনীর দুরভিসন্ধি আঁচ করতে সক্ষম হন।

তিনি বলেন ,তারই পরিপ্রেক্ষিতে হঠাৎ ১৯ মার্চ শুক্রবার বেলা ১১টায় তার কোম্পানী কমান্ডার মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী তাকে জানান যে, সেদিনই আমাদের অস্ত্র জমা নেয়ার জন্য ঢাকা ক্যান্টমেন্ট হতে বিগ্রেড কমান্ডারসহ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট আসছে।

তিনি বলেন, পাঞ্জাব রেজিমেন্টের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করার লক্ষ্যে মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী তৎক্ষনাৎ একপ্লাটুন সৈন্য সিভিল ড্রেসে অস্ত্র গোলাবারুদ নিয়ে সিভিলিয়ানদের সাথে যোগ দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। রাস্তায় যাতে কোন অবস্থাতে বিগ্রেডিয়ার জাহানজেব আরবাব খানের নেতৃত্বে সৈন্যরা জয়দেবপুর রাজবাড়ীতে পৌঁছতে না পারে সে বিষয়েও নির্দেশ দেয়া হয়।

১১ মার্চ থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত ঘটনার ধারাবাহিক বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন , সে সময় ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট জয়দেবপুর ভাওয়াল রাজবাড়ীর বিশাল দোতালা ভবনের ৩৬০টি রুমে অবস্থান গ্রহণ করে। মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরীর আদেশ মোতাবেক তৎকালীন এম.এন এ শামসুল হক, আ.ক.ম মোজ্জাম্মেল হকের নেতৃত্বোধীন সিভিলিয়ানদের সাথে যোগ দিয়ে জয়দেবপুর চৌরাস্তা হতে জয়দেবপুর বাজার রেল গেইট পর্যন্ত রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়। এতে বেলা ১২টার পর পাক বাহিনীর সাথে তাদের মধ্যে ফায়ারিং শুরু হলে এক মারাত্মক রণক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়।

আমাদের বাঙালি সৈন্যরা বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে ধান গবেষণা কেন্দ্রের পাশে ফাঁকা মাঠ দিয়ে পাক হানাদার বাহিনী জয়দেবপুর সেনা ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হলে আমাদের আক্রমনে অনেক পাক সৈন্য আহত ও নিহত হয়। আমাদেরও অনেকে সেই যুদ্ধে আহত হয়েছিল। মনু খলিফা ও হুরমত নামে দুইজন সিভিল অসীম সাহসিকতার সাথে দুই পাক সৈন্যকে ঝাঁপটিয়ে ধরেন। তখন অন্য পাকসেনারা তাদের গুলি করলে তারা ঘটনাস্থলেই শহীদ হন।

পাক সেনাদলকে তারা সম্পূর্ণভাবে পরাভূত করেন। যার ফলে হানাদার সেনারা আর রাজবাড়ীতে পৌঁছতে পারেনি। ওই দিনই পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। ওই সংকটাবস্থায় ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার মেজর কে.এম শফিউল্লাহর নেতৃত্বে ব্যাটালিয়নের যুদ্ধ পরিকল্পনা ও পরিচালনার কৌশল নির্ণয় করা হয়। সাথে সাথে হেড কোয়াটার কোম্পানীসহ পাঁচটি কোম্পানীকে যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হয়। কোন কোম্পানী কোথায় থাকবে তারও নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।

তিনি বলেন , এতে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিশেষ ক্ষতি করতে পারেনি পাকবাহিনী এবং রাজবাড়ী থেকে অস্ত্র গোলাবারুদ নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল বাঙালি সৈনিকরা।

পরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের গঠিত ৩নং সেক্টরের কমান্ডার হয়েছিলেন জেনারেল শফিউল্লাহ এবং তিনি বাংলাদেশের প্রথম সেনা প্রধানও হয়েছিলেন।

মোখলেছুর রহমান বলেন, ১৯ মার্চের পর হানাদার সেনারা আর নিয়মিতভাবে রাজবাড়ী সেনা ক্যাম্পে অবস্থান করেনি। ২৩ মার্চ মঙ্গলবার সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম হতে বিগ্রেডিয়ার মজুমদার জয়দেবপুর এবং আমাদের ইউনিটে এসে মতবিনিময় করে সান্তনা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, পাক বাহিনী বাঙালি সৈন্যদের ওপর আক্রমন করবে না। আমরা যেন তাদের অস্ত্র জমা রেখে ব্যারাকে ফিরে যাই।

তিনি বলেন, তার কথায় কর্ণপাত না করে মেজর শফিউল্লাহ, মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন নাসিমের পরিকল্পনা ও নির্দেশ অনুযায়ী কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয় । তখন বিগ্রেডিয়ার মজুমদার তৎকালীন কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্ণেল এম এইচ খানকে কনফারেন্সের কথা বলে ঢাকা ক্যান্টেনমেন্ট ১৪ ডিভিশন হেডকোয়াটারে নিয়ে যান। ওই দিন বিকালের মধ্যে ব্যক্তিগত সোর্স মাধ্যমে জানতে পারি কমান্ডিং অফিসার লে. কর্ণেল এম.এইচ খান সেখানে বন্দী অবস্থায় আছেন। পরদিন সকালে ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার হয়ে লে. কর্ণেল রাকিব উদ্দিন আহমেদ তার স্ত্রীকে ক্যান্টমেন্টে আটকিয়ে রেখে তাকে পাঠানো হয়।

তিনি বলেন , বাঙালি অফিসার এবং সৈনিকগণ তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মেজর শফিউল্লাহ, মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী, এ এসএম. নাসিম, ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমান, ক্যাপ্টেন এজাজ আহমেদ চৌধুরী, লে: জিএম হেলাল মোর্শেদ খান, লে: সৈয়দ মোঃ ইব্রাহীম, লে. আবদুল মান্নান ও মেজর নূরুল ইসলাম শিশুর নেতৃত্বে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কার্যক্রম অব্যাহত রাখে।

তিনি বলেন , সির্ভিলিয়ানদের মধ্যে শামসুল হক, আব্দুল হাকিম মাস্টার, আ.ক.ম মোজাম্মেল হক, মোঃ হাবিবুল্লাহ, আজিম উদ্দিন মাস্টার, আব্দুস সাত্তার মিয়া, শ্রমিক নেতা আব্দুল মোতালেব, শহীদুল্লাহ বাচ্চু, কাজী মোজাম্মেল হক, সর্বদর আলী মাস্টার, আহসান উল্লাহ মাস্টার, শেখ আবুল হোসেন, নজরুল ইসলাম, হাসান উদ্দিন সরকার, ডাক্তার সাঈদ, নবীন সরকার, গাজী আব্দুল লতিফ, আজমত উল্লা খান, কাজী শাহজাহান, আব্দুল মান্নান পাঠান, কাজী আলিম উদ্দিন বুদ্দিন, আব্দুর রউফ নয়ন, টঙ্গীর শামসু মিয়ার পুত্র শেখ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ আরো অনেকে আমাদেরকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেন।

তিনি আরো বলেন, পাকবাহিনীর মত দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে বাংলার বীরমুক্তি বাহিনী, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, জনতা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিলাম।

COMMENTS





নাম

অর্থ ও বাণিজ্য,235,আন্তর্জাতিক,731,কাপাসিয়া,342,কালিয়াকৈর,417,কালীগঞ্জ,253,খেলা,644,গাজীপুর,3936,চাকরির খবর,33,জয়দেবপুর,1581,জাতীয়,2958,টঙ্গী,911,তথ্যপ্রযুক্তি,512,ধর্ম,196,পরিবেশ,136,প্রতিবেদন,310,বিজ্ঞান,55,বিনোদন,697,ভিডিও,58,ভিন্ন খবর,142,ভ্রমন,115,মুক্তমত,27,রাজধানী,829,রাজনীতি,1055,লাইফস্টাইল,283,শিক্ষাঙ্গন,398,শীর্ষ খবর,10757,শ্রীপুর,481,সাক্ষাৎকার,12,সারাদেশ,649,স্বাস্থ্য,212,
ltr
item
GazipurOnline.com: গাজীপুরে বাঙালি সৈন্য ও কর্মকর্তাদের বিদ্রোহের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ শুরু
গাজীপুরে বাঙালি সৈন্য ও কর্মকর্তাদের বিদ্রোহের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ শুরু
http://1.bp.blogspot.com/-fV-TQPqMT-M/UyHmQe8eONI/AAAAAAAAF-Y/oAa2rHsAR2k/s1600/muktijuddho.jpg
http://1.bp.blogspot.com/-fV-TQPqMT-M/UyHmQe8eONI/AAAAAAAAF-Y/oAa2rHsAR2k/s72-c/muktijuddho.jpg
GazipurOnline.com
https://www.gazipuronline.com/2014/03/muktijuddho.html
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/2014/03/muktijuddho.html
true
13958681640745950
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Read More Reply Cancel reply Delete By প্রচ্ছদ PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share. STEP 2: Click the link you shared to unlock Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy