গাজীপুরের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের একটি অংশ ধ্বংস করে নিজেদের জন্য একটি ট্রেনিং স্কুল বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করছে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মধ্যে অন্যতম এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন- র্যাব। র্যাবের এই বনাঞ্চল দখলকে অনুমোদন দিতে চলতি মাসের শুরুতে একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সরকার তার বরাদ্দের মধ্যকার ২০ একর জমি বাতিল করেছে।
হঠাৎ করে এই ধরনের ‘উন্নয়নমূলক’ কর্মকাণ্ডের কারণে শুধু যে বনাঞ্চলই ধ্বংসের মুখে পড়েছে তাই নয়, অঞ্চলটির আশপাশের অধিবাসীরা তাদের বর্ষ-পুরোনো বাসস্থানসহ যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সবকিছু নিয়ে হুমকিতে পড়ে গেছেন। কারণ র্যাবের কর্মকর্তারা অনেকটা নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমেই এসব জায়গা থেকে স্থানীয় মানুষজনকে জোর করে সরিয়ে দিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন এবং বনবিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা এই ব্যাপারে কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করে বিস্তারিত কিছুই জানাননি। অন্যদিকে র্যাব কর্মকর্তারা বিষয়টিকে ‘একেবারেই ভিত্তিহীন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে পুরো অভিযোগ অস্বীকার করেন।
গাজীপুর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে পোড়াবাড়ি বাজারের কাছে ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথ- এমন দূরত্বে অবস্থিত পোড়াবাড়ি গ্রামে গিয়ে সোমবার সরেজমিনে দেখা গেছে, সবুজে-শ্যামলে ঢাকা গ্রামটির পরিবেশ অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ। এর ঠিক মাঝখানে রয়েছে বটগাছিয়ার পুকুর নামে খ্যাত একটি পুকুর। পুরো গ্রামটির যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই দেখা যায় অসংখ্য আম, কলা, কাঁঠাল, লিচু, শিশু এবং ইউক্যালিপটাস গাছ।
গত ৫ মার্চ সরকার প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘বন আইন- ১৯২৭’ অনুযায়ী ১৯৫৫ সালের ১৩ এপ্রিল একটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ও ১৯৮৪ সালের ১৫ নভেম্বর পুনরায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে অঞ্চলটিকে ‘সরকার কর্তৃক সংরক্ষিত বনাঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু র্যাবের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করার জন্য একটি স্থায়ী ভবন নির্মাণের উদ্দেশ্যে সরকার এই জমির অধিকারসংক্রান্ত ঘোষণা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।”
বিজ্ঞপ্তি থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, এই অঞ্চলটি ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের আওতাধীন বাউপাড়া বিটের ভেতরে অবস্থিত। ১৯৭৩ সালে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে অঞ্চলটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করেছিল। এই অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ১৯.৯৭ একর জমিকে ‘নন-ক্লাসিফাইড এরিয়া’ বা ‘অশ্রেণীবদ্ধ এলাকা’ হিসেবেও ঘোষিত ছিল।
র্যাব কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে। পুরো অঞ্চলটিকে পিলার দিয়ে আলাদা করে দিয়ে চারটি সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছে র্যাব, যেখানে লেখা আছে “প্রবেশ নিষিদ্ধ, র্যাব ফোর্সের প্রশিক্ষণ স্কুলের জন্য এলাকাটি সংরক্ষিত, নির্দেশক্রমে- র্যাব কর্তৃপক্ষ।” এই অঞ্চলে প্রায় ৫০ বছর ধরে বসবাস করে আসছিলেন এমন ২৭টি ভূমিহীন পরিবারকে উচ্ছেদ করে দিয়েছে র্যাব। একটি বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও বিদ্যালয়টির একটি খেলার মাঠের অর্ধেক অংশও র্যাবের দখলকৃত জমির মধ্যে পড়েছে।
পুরো এলাকাটি ঘুরে দেখা গেছে, সর্বত্রই ধ্বংসের চিহ্ন বিরাজমান। কয়েকটি মাটির তৈরি ঘরের ছাদহীন ভগ্ন ধ্বংসাবশেষ দরিদ্র পরিবারগুলোর প্রতি নির্মমতার চিহ্নকেই প্রকটভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। র্যাব কর্মকর্তাদের ইস্যু করা অত্যন্ত স্বল্প সময়ের নোটিশেই এলাকাটির অধিকাংশ পরিবার এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। তাদের কেউ কেউ পাশ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকার অস্থায়ীভাবে ঘর তৈরি করে সেখানেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
পেশায় মজুর ইউনূস আলী জানান, চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর দেলোয়ার হোসেনকে সঙ্গে করে র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা এলাকাটিতে এসেছিলেন।
ইউনূস বলেন, “তারা আমাদের সবাইকে প্রথমে একটি খোলা জায়গায় নিয়ে এসে একত্রিত করেন এবং তৎক্ষণাৎ এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার আদেশ দেন। তখন আমরা তাদের কাছে কিছু সময় চেয়ে অনুরোধ জানালে তারা আমাদের মাত্র ১৫ দিনের সময় বেঁধে দেন। কিন্তু ১৫ দিন শেষ হওয়ার অনেক আগেই তারা আবারো ফিরে আসেন এবং তৎক্ষণাৎ আমাদের সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করেন।”
ইউনূসের সঙ্গে কথা বলার সময় খুব অল্প সময়ের মধ্যেই একটি চায়ের দোকানের আশপাশে আরো কয়েকজন মানুষের ভিড় জমে যায়। হঠাৎ হতদরিদ্র এই মানুষদের উচ্ছেদ করার বিষয়টি নিয়ে ভিড়ের মধ্যে থাকা সবাই-ই কিছু না কিছু বলতে চাইছিলেন।
পেশায় দর্জি হারুন-উর-রশীদ ভিড়ের মধ্য থেকে বলেন, “একদিন তারা (র্যাব কর্মকর্তা) আমার বাসায় আসে এবং আমার স্ত্রী-সন্তানদের সামনেই আমাকে ধরে পেটায়। এ সময় তারা বারবার আমাকে এই বলে সাবধান করে দিচ্ছিলেন যে যদি অবিলম্বে আমি পরিবার নিয়ে এলাকাটি ত্যাগ না করি তাহলে পরিণতি এর থেকেও খারাপ হবে।”
একই এলাকায় অবস্থিত ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শাহ সূফী ফসি উদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়ে বর্তমানে প্রায় ৬৫০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। বিদ্যালয়টিতে একটি একতলা এবং একটি দ্বিতলসহ মোট দুটি ভবন রয়েছে, আছে একটি খেলার মাঠও। খেলার মাঠটিতে প্রতি ঈদে পাশ্ববর্তী বাওরাইত, উত্তর সাঁত্রা এবং পোড়াবাড়ি গ্রামের ধর্মপ্রাণ মুসলমান জনগণ ঈদের নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে একত্রিত হন। এই অঞ্চলগুলোর মধ্যে এটিই একমাত্র ঈদগাহ ময়দান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বিদ্যালয়টির একতলা ভবনটিসহ এই খেলার মাঠের অর্ধেক অংশ র্যাবের দখলে চলে গেছে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সানাউল্লাহ সরকার বলেন, “র্যাব কর্তৃপক্ষ আমাদের মৌখিকভাবে জানিয়েছিলেন যে বিদ্যালয়ের এই অংশটি স্থায়ীভাবে তারা দখল করছে না। কিন্তু কিছুদিন আগে যখন আমরা আমাদের স্কুলেরই একটি গাছ কাটতে গিয়েছিলাম তখন র্যাব গাছটি কাটতে আমাদের বাধা দেয়। অথচ কয়েক বছর আগে আমরা অর্থাৎ স্কুল কর্তৃপক্ষই গাছটি রোপণ করেছিলাম। এখন আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু চেয়ার-টেবিল বানানোর জন্য আমাদের গাছই আমরা কাটার জন্য ‘অনুমতি’ পাচ্ছি না! এখন তো আমরা এই স্কুলের অস্তিত্ব আদৌ থাকবে কি-না তা নিয়েই প্রশ্নের মুখে পড়ে গেছি।”
র্যাবের দশজন কর্মকর্তা বর্তমানে এই এলাকাটিতে অবস্থিত একটি বাড়িতে বসবাস করছেন। অথচ যার মালিকানায় বাড়িটি রয়েছে সেই ব্যক্তি আবুল কালাম আজাদই বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। আবুল কালাম আজাদ বাংলাদেশ চা বোর্ডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন।
তিনি বলেন, “১৯৭৮ সালে আমি এই জমিটি কিনেছিলাম। তাই যখন বন বিভাগ আমার এই জমিকে সরকারি সম্পত্তি হিসেবে দাবি করেছে তখন বাধ্য হয়েই আমি আইনের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। উচ্চ আদালত আমার পক্ষে রায়ও দিয়েছে। এখন আমি দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত জানার অপেক্ষায় আছি।”
সাবেক এই সরকারি কর্মকর্তা দাবি করেন- র্যাব কর্মকর্তারা হঠাৎ করে একদিন তার বাড়িতে এসে বাড়িটি দখলে নেয় কোনোরকম পূর্ব নোটিশ ছাড়াই। তিনি বলেন, “আমার বাড়িতে আমার একটি খামার ছিল যেখানে আমি ২৫টি অস্ট্রেলিয়ান গরু পালতাম। র্যাব কর্মকর্তারা হঠাৎ করে একদিন কোনো নোটিশ ছাড়াই এখানে এসে পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই আমার গরুগুলোকে খুলে দেয় এবং খামার থেকে বের করে দেয়। গরুগুলো সারা গ্রামের এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়ার পরে আমি খুঁজে সারা গ্রাম তন্ন তন্ন করে খুঁজে পেয়েছি মাত্র পাঁচটি গরু।”
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এ টি এম হাবিবুর রহমান বলেন, “আমাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি ও ভবন নির্মাণের জন্য আমাদের কিছু সরকারি জমি দরকার ছিল, আর সরকারই আমাদের সেই জমি দিয়েছে। এখন তারা কেন আমাদের এই জমি দিয়েছে সেটা তাদেরই জিজ্ঞেস করুন।”
র্যাবের দখলকৃত এলাকার অধিবাসীদের হুমকি দিয়ে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে ঘরছাড়া করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমরা এরকম কোনো অভিযোগ পাইনি।”
এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে ফোনে যোগাযোগ করা হলে বন বিভাগের প্রধান বন সংরক্ষণ কর্মকর্তা ইউনূস আলী প্রথমে ‘এলাকাটি কখনোই সংরক্ষিত বনাঞ্চল ছিল না’ এমন দাবি করলেও পরে জানান, ‘জমিটি সরকারের দখলে ছিল।’ এ সময় সরকার প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞপ্তিটি পুরোটা পড়ে শোনানোর পর তিনি অনেকটা আমতা আমতা করেই বলেন, “সরকার র্যা বের কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট বলেই র্যাবকে প্রয়োজনীয় অনুমতি দেয়া হয়েছে।” এরপর এই বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান তিনি।
গাজীপুরের উপ-কমিশনার মো. নুরুল ইসলাম জানান, এই ব্যাপারে তার কিংবা তার কার্যালয়ের তরফ থেকে কিছুই করার নেই। সম্পূর্ণ বিষয়টি তিনি জানতে পেরেছেন নোটিশসংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তির একটি কপি হাতে পাওয়ার পরে।
আইইউসিএন বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ইশতিয়াক উদ্দিন আহমাদ বলেন, “সংরক্ষিত এই বনাঞ্চলের নির্দিষ্টি এই অংশটি এরই মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়েছে। তাই সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পরিমাণও অনেক কমে গেছে। এখন যদি এখানে কোনো স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করা হয় তাহলে তা অবশ্যই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।”
এর আগে গত বছরের শুরুতে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ- বিজিবি কর্তৃপক্ষ কক্সবাজারের রাজারকূল রেঞ্জের ৪০ একর জমি হস্তগত করে এবং বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট অনুমোদন ছাড়াই সেখানে নানা অবকাঠামো নির্মাণের কার্যক্রম শুরু করেছে বিজিবি। অথচ এর মধ্যে ৩৬ একর জমি সংরক্ষিত অঞ্চলের এবং বাকি চার একর জমি বন বিভাগের সুরক্ষিত বনাঞ্চলের আওতাধীন।
এই বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে সাবেক বন ও পরিবেশ মন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানান, সরকার বিশেষ বিবেচনায় সংরক্ষিত অঞ্চলগুলোকে বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ দিচ্ছে।
COMMENTS