উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ৫ম ধাপে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন রোববার। আওয়ামী লীগ থেকে একক প্রার্থী আব্দুল জলিলকে সমর্থন দেয়ার পর থেকেই নয়া যৌবনে ফিরেছে উপজেলা আওয়ামী লীগ। অপর দিকে নির্বাচন সুষ্ঠু হলে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী ১৯দল সমর্থিত প্রার্থী আব্দুল মোতালেব।
আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত এ উপজেলায় আশির দশকের পর থেকে জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের যেকোনো নির্বাচনে এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে আসছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রথমদিকে একাধিক প্রার্থী নিয়ে আওয়ামী লীগের নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে থাকলেও ৮মার্চ নির্বাচনী সহিংসতায় পর চেয়ারম্যান প্রার্থী ইকবাল হোসেন সবুজ কেন্দ্রের নির্দেশে নিজের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নিলে একক প্রার্থী নিয়ে আওয়ামী লীগের দুর্গে নতুন করে ফিরেছে প্রাণের সঞ্চার।
এদিকে, দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ইকবাল হোসেন সবুজ কেন্দ্রের নির্দেশে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও, ব্যালট পেপারে তার প্রতীক থাকায় পাশ ফেলে ভোটের ব্যাবধান কমে যাবে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। আওয়ামী লীগের কট্টরপন্থীরা মনে করছেন যদি এ নির্বাচনে তাদের সমর্থিত প্রার্থীর বিজয় না হয় তাহলে আগামীতে জাতীয় নির্বাচনসহ যেকোনো নির্বাচনে এর মাশুল গুণতে হবে। আর এ কারণেই আওয়ামী লীগ অন্তর্দ্বন্দ্ব, বিভেদ ও সকল প্রকার ব্যক্তি আক্রোশ ভুলে দলের স্বার্থকে বড় করে দেখছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
তবে শ্রীপুর উপজেলা আওয়ামী অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় এখানে দু’ প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি কামাল ফকির।
২৪ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদক স্বাক্ষরিত এক পত্রের মারফতে বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন সবুজকে সমর্থন দেয়। সব ভেদাভেদ ভুলে দলের স্বার্থে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজমত উল্লাহ খান ২৮মার্চ শুক্রবার দিনব্যাপী উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার ২৫টি স্থানে নির্বাচনী পথসভায় বক্তব্য রাখেন। নির্বাচনী মাঠে তার গণসংযোগে প্রাণের সঞ্চার ফিরেছে আওয়ামী লীগের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে।
ওইসব নির্বাচনী পথসভায় তার সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন, কালিয়াকৈর উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রাসেল, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট. শফিকুল ইসলাম বাবুল, যুগ্মসম্পাদক অ্যাডভোকেট. হারিছ উদ্দিন আহমেদ, আব্দুল হাদী শামীম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট. শামসুল আলম প্রধান, সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বুলবুল, জেলা কৃষকলীগ সভাপতি আকবর আলী চৌধুরী, মাওনা ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আমির হামজা, আবু আক্তার হোসেন খান বুলু, গোসিঙ্গা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ ফকির, কাওরাইদ ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম মণ্ডল ও উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি কামাল ফকির প্রমুখ।
এদিকে, ১৯দল মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী আব্দুল মোতালেব (কাপ পিরিচ) তার জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।
তিনি জানান, সুষ্ঠ ভোট হলে তার জয় নিশ্চিত। ভোট কারচুপি করা হলে উপজেলা ভোটাররা তার জবাব দেবে।
আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আব্দুল জলিল ও বিএনপির সমর্থিত প্রার্থী আব্দুল মোতালেবের জনপ্রতিনিধি হিসেবে দক্ষতা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা কোনো অংশেই কম নয় বলে ধারণা তাদের নেতাকর্মীদের। পরপর তিনবার তেলিহাটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান থাকায় আব্দুল জলিল দক্ষতা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে শ্রীপুর উপজেলাকে ঢেলে সাজাবেন বলে মনে করে শ্রীপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিবুল হাসান।
তবে চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী নিয়ে বিএনপি একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও শরিক দল জামায়াতের ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী নিয়ে অনেকটা বেকায়দায় রয়েছে বিএনপি। নির্বাচনে বিএনপি ও শরিক দল জামায়াতের ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী থাকায় ভোট ভাগাভাগি নিয়ে চিন্তায় রয়েছে বিএনপি। চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদটি ভোটের মাধ্যমে বিজয় ছিনিয়ে নিতে পারলেও ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিজয় ছিনিয়ে নিতে পারবেন কিনা তা নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে রয়েছে চরম শঙ্কা ও হতাশা। ভাইস চেয়ারম্যান পদের জন্য নিজ দলের ভোট ভাগাভাগি নিয়েও চরম হতাশায় রয়েছে দলটি। এ পদটির বিজয় নিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বিএনপি নেতাকর্মীদের।
উপজেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা যায়, চেয়ারম্যান পদে কাপ-পিরিচ প্রতীক নিয়ে শ্রীপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আব্দুল মোতালেব, আনারস প্রতীক নিয়ে তেলিহাটি ইউনিয়নের একাধিকবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও শ্রীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আলহাজ আব্দুল জলিল, মোটরসাইকেল প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন সবুজ (নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন) এবং ঘোড়া প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রহ্লাদপুর এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা সামসুদ্দিন খন্দকার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
সরেজমিন শ্রীপুর উপজেলার নির্বাচনী এলাকা ঘুরে সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে নির্বাচনী পরিবেশ সম্বন্ধে নানা তথ্য উপাত্ত পাওয়া গেছে।
বেলদিয়া মধ্যপাড়া গ্রামের জসীম উদ্দিন ও চাঁন মিয়া রাজু বলেন, শ্রীপুরের উপজেলা নির্বাচন থেকে এবার স্বাধীনতা বিরোধী ও তাদের সমর্থকদের শিক্ষা নিতে হবে যে, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির সমর্থকেরা অনেক খেলাধুলার পর তাদের অস্তিত্বের কথা ভুলে না। সকল খেলার ওপরে হল তাদের দল-বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
উপজেলার সর্বত্র গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে যখন আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী ছিল তখন বিএনপির প্রার্থী আব্দুল মোতালেবের (কাপ-পিরিচ) বিজয় অর্জন করার সম্ভানা ছিল। কিন্তু আওয়ালী লীগের একজন প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে গিয়ে অপর প্রার্থীকে সমর্থন দেয়ায় সেই সম্ভাবনা অনিশ্চিত হয়ে গেছে। বিএনপির প্রার্থীকে পরাজিত করতে উপজেলা আওয়ামী লীগের তৃণমূলের ভোটে নির্বাচিত প্রার্থী তেলিহাটি ইউনিয়নের একাধিকবার নির্বাচিত জনপ্রিয় চেয়ারম্যান ও শ্রীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম সদস্য আলহাজ্ব আব্দুল জলিলের (আনারস) পক্ষে জোর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগসহ উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, কৃষকলীগ, আঞ্চলিক শ্রমিকলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ ও ছাত্রলীগসহ অঙ্গসহযোগী সংগঠনের শীর্ষ পর্য়ায় থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
ভাইস চেয়ারম্যান পদে (বৈদ্যুতিক বাল্ব) প্রতীক নিয়ে বিশিষ্ট শিল্পপতি ও সমাজসেবক এস এম আব্দুর রউফ, টিউব ওয়েল প্রতীক নিয়ে শ্রীপুর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম মণ্ডল বুলবুল, তালা প্রতীক নিয়ে শ্রীপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলে ছাত্র সংসদের সাবেক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক আলহাজ ইফতেখারুল ইসলাম সিরাজী রাজীব, উড়োজাহাজ প্রতীক নিয়ে যুবলীগের আবুল হোসেন রিপন, মাইক প্রতীক নিয়ে শ্রীপুর উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মোসলেহ উদ্দিন মৃধা এবং চশমা প্রতীক নিয়ে গাজীপুর সদর উপজেলা জামায়াতের আমির মাওলানা আজহারুল ইসলাম নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
শ্রীপুর উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ৪জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৬জন এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীর মধ্যে লড়াই হবে।
মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে কলস প্রতীক নিয়ে লুৎফুন্নাহার মেজবাহ এবং বৈদ্যুতিক পাখা প্রতীক নিয়ে শ্রীপুর উপজেলা মহিলা দলের সভাপতি শেখ ফরিদা জাহান স্বপ্না নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
শ্রীপুর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আলতাব হোসেন জানান, ৪৬৫.০৪ বর্গ কিলো মিটার আয়তনের এ উপজেলায় মোট ভোটার ২ লাখ ৯৯ হাজার ৩’শ ৯৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৪৮ হাজার ৩’শ ৫৫ জন এবং মহিলা ভোটার ১ লাখ ৫১ হাজার ৩৯ জন।
প্রসঙ্গত, গত ৭ মার্চ শ্রীপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে উপজেলা আওয়ামী লীগের মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী আব্দুল জলিলকে দুপুর ২টার দিকে র্যাব আটক করে নিয়ে যায়। শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়নের সিটপাড়া গ্রামের একটি মসজিদে নামাজ আদায় শেষে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।
জলিল আটকের খবরে শ্রীপুর উপজেলাব্যাপী তার কর্মী সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে, আওয়ামী লীগের দুই প্রার্থীর মধ্যে সমঝোতার উদ্দেশে দলীয় কার্যালয়ে পূর্ব নির্ধারিত সভায় দুই প্রার্থীর সমর্থকেরা জড়ো হতে থাকে। দুই পক্ষের সমর্থকেরা তাদের দলীয় কার্যালয়ে জড়ো হলে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। এসময় অস্ত্রধারীরা গুলি ও লাঠির আঘাতে আহত হন শ্রীপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক আল আমীন শেখ। পরে তিনি ঢাকার এ্যাপেলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
COMMENTS