বিশ্ব টি টুয়েন্টি ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আংশিক দেখেছি। পরে বর্তমান সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত আমাদের প্রিয় মুন্নী দি'র টেলিভিশন এটিএন নিউজে এ বিষয়ে টকশো দেখলাম। সেখানে ক্রীড়া সাংবাদিকরা বিজাতীয় সংস্কৃতির উপস্থাপনা কিংবা বিশাল বাজেট খরচের পরিসংখ্যান নিয়ে সমালোচনা করলেন। সত্যি বলতে কী, এসব বাস্তবতা হিসেবে ধরে নিয়ে ঘুমালাম।
সকালে ফেসবুকে বসে চোখে পড়ল বড়ভাই আশরাফুল আলম খোকন (প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সচিব) সহ অনেক সাংবাদিকের স্ট্যাটাস। এই বিভক্ত রাজনৈতিক সমাজে এখনো আমাদের অনেক বন্ধু, ছোট-বড় ভাই, গণমাধ্যম কর্মী ফেসবুকে কিছু নিরপেক্ষ তথ্য দেন। লেখেন, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। তাদের কয়েকজনের ব্যাখ্যা দেখলাম। এরপর খোকন ভাই'র অত্যন্ত কৌশলী তথ্য বহুল স্ট্যাটাস এবং এর প্রতিক্রিয়া দেখে একটু বেশী খারাপ লাগলো। খোকন ভাইকে উদ্দেশ্য করে লিখলাম, ভাই স্ট্যাটাসটা অসাধারণ হয়েছে। খুবই কৌশলী এবং তথ্যবহুল। যে কেউ কনভিন্স হওয়ার মতো। কিন্তু প্রশ্নটা হলো, রাজাকার-আলবদররা এভাবেই ব্যাখ্যা দিত একাত্তর সময়ের। যেমন ধরেন, এশিয়া কাপে কিছু বাংলাদেশী পাকিদের সমর্থন করতে গিয়ে এরকম ব্যাখ্যা দিয়েছিল। বলেছিল, বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তান হেরে গেলে ভারত ফাইনালে উঠবে!!!!!! এজন্য ওরা পাকিস্তানের সমর্থন করে। ওরা রাজনীতির উর্ধ্বে খেলাকে স্থান দেওয়ার অবস্থানের কথা বলেছিল। কারন পাকিস্তান ভাল খেলে। অনেকে আফ্রিদির ভক্ত। মূলতঃ এইসব রাজাকার শ্রেনীর মানসিকতা নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেন নি আমাদের বীর মুক্তযোদ্ধারা। এজন্য জীবন দেননি। এই প্রেক্ষাপটে আমার মনে হয়, আপনার স্ট্যাটাসটাও পাকিস্তানের বশংবদ ওইসব রাজাকার মানসিকতার মানুষের কাছাকাছি হয়েছে। আপনি মাইন্ড করেবন না, এটাই বাস্তবতা। একটু মিলিয়ে দেখুন। দেশপ্রেম, ইসলাম প্রেম বা হিন্দুস্তান প্রেমের আড়ালে আমরা আমাদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক স্বকীয়তা হারাচ্ছি কি-না।
পাঠকদের উদ্দেশ্যে খোকন ভাই'র স্ট্যাটাসটা হুবহু তুলে ধরছি। "আজকের অনুষ্ঠানটি পুরাটাই ভারতীয়দের দখলে ছিল ,
আসেন একদিক থেকেই বলি ... রুনা লায়লা গান গাইলেন .. ওনার জামাই আলমগীর আওয়ামীলীগ করেন --তাই উনিও ইন্ডিয়ান ফ্লেবার এর আর মমতাজতো আওয়ামীলীগের এমপি - মার্কা মারা ইন্ডিয়ান সাবিনা ইয়াসমিনের বর্তমান স্বামী সুমন কবির একজন ভারতীয় শিল্পী - একজন ইন্ডিয়ান এর অর্ধাংগীনি তিনি ! কুমার বিশ্বজিতের কথা আর কি বলবো উনিতো হিন্দু, মানে - আমাদের মত না পুরাটাই হিন্দুস্তানি শুরুতে ফুয়াদের সাথে কোনাল নামের একটি মেয়ে সাগত গান গাইল - কোনাল নামের অর্থ পদ্মফুল ! আর পদ্মফুল হলো ভারতের জনপ্রিয় একটি দলের প্রতিক ! এখানেও ইন্ডিয়ান ফ্লেবার মুসুলমান বইলা আমরা পাকিদের পতাকা উড়াই - এআর রহমানও মুসুলমান কিন্তু তিনি ভারতীয় ! একন মিয়া পুরাই কালা আমেরিকান কিন্তু এই উপমহাদেশে বিখ্যাত হইসে "ইন্ডিয়ান" ছাম্মাক ছালু গান গাইয়া ! পুরা অনুষ্ঠানের "হিন্দুস্তানি ফ্লেবার" নিয়ে আজ অনেক ফেসবুক স্ট্যাটাস পড়লাম ! এর মধ্যে একজন আমার বন্ধু যার গাড়িতে ক্রমাগত হিন্দি গান শুনে আমি বলেছিলাম আমার গাড়িতে সব সিডি "বাপ্পা আর সামিনা চৌধুরীর "- উত্তরে সে বলেছিল হুদাই পয়সা নষ্ট করস ! আরেক বান্ধবীর স্ট্যাটাস পড়লাম যে কিনা নিজের জন্য পাকিস্তানি থেকে সালোয়ার কামিজ আনে - দেশী জিনিস ভালো লাগেনা ! এক বন্ধু কাম ছোট ভাই ! উদীয়মান ফিল্ম নির্মাতা ! যার এইম ইন লাইফ ই হিন্দি মুভি বানানো ! এই রকম অসংখ্য উদাহরণ আছে ! তাদের ফেসবুকের লায়কিংস অপসনে গেলেই দেখতে পাবেন বিদেশী প্রেমে ভরপুর ! আমার এই স্ট্যাটাস কিন্তু বিসিবির পক্ষে কিংবা কারো দেশপ্রেমের বিপক্ষে না ! শুধু এইটুকু বলি বাংলাদেশের শিল্পীদের প্রতি এতো দরদ , বুকে হাত দিয়ে বলেনতো গত একবছরে "তাদের " কয়টা সিডি - ডিভিডি কিনেছেন আর কয়টা "বিদেশী" সিডি - ডিভিডি কিনিছেন ? এই পার্থক্যটা বের করতে পারলেই নিজের দেশপ্রেমের পরিমানটা উপলব্ধি করতে পারবেন !" খোকন ভাই'র স্ট্যাটাসের জবাবে নিজে আরো কিছু লিখলাম। বললাম, সহজ ব্যাখ্যা হলো... ওরা (ভারতীয়) ভাল শিল্পী। খ্যাতিমান। তাই বলে ওদের ভীড়ের মাঝে টি টুয়েন্টির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কি আমরা আমাদের সংস্কৃতির উপস্থাপনা একটু বেশী করতে পারতাম না? এখানে বাংলাদেশের গণমানুষের পকেটের প্রায় ২০ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে বলে এটিএন নিউজ-এর টকশো থেকে জানলাম। আইসিসি কোনো টাকা দেয়নি। এরকম খরচ-ওয়ালা উদ্বোধনীও ওদের ডিমান্ড ছিলো না। ভাল অনুষ্ঠান করতে পারার মধ্যে কৃতিত্ব আছে। এটা ঠিক আছে। কিন্তু ভারতীয় শিল্পীদের ভীড়ে দেখেন আপনি কিন্তু খুব বেশী বাংলাদেশী শিল্পীর নাম বলতে পারেন নি। চেষ্টা করেছেন বিসিবিকে রক্ষার। নিঃসন্দেহে অনেক কৌশলে আপনার অবস্থান থেকে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু যা-ই বলেন- বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এটা ভালভাবে নেয়নি। রাজনৈতিক দল বা তাদের কর্মীরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে ব্যাখ্যা দেবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এভাবে আওয়ামী লীগকে ভারতের সঙ্গে তুলনা করার বিষয়টি স্বয়ং বঙ্গবন্ধু মেনে নিতেন না। এটা আপনিও স্বীকার করবেন। এটা স্বাধীনতার স্থপতি হিসেবে গন্য একটি রাজনৈতিক দলের জন্য লজ্জাস্কর। দেখেছেন, আমাদের অনেক ফেসবুক বন্ধু, যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন কিংবা কর্মী-সমর্থক হয়ে আছেন, তারাও আওয়ামী লীগকে ভারতের সঙ্গে তুলনায় খুশি হয়। এটা ভাই, ভাল না। ভাল না। ভাল না। একাত্তরে এরকম-ই একটি পরিস্থিতিতে জামায়াত ইসলামী ও মুসলিম লীগ পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। ওরা বুঝে-শুনেই স্বাধীন হতে যাওয়া বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। ওদের পরিণতি ভাল হয়নি। সময় লাগলেও ওরা ভুলের মাশুল পাচ্ছে। বর্তমানে আওয়ামী লীগের অবস্থানও কিন্তু একাত্তরের জামায়াতের ভুমিকার পথে এগুচ্ছে। কখনো কখনো মনে হয়, জেনে-বুঝেই আওয়ামী লীগ ভারতের পক্ষে কথা বলা বা কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশের স্বকীয়তা বিকিয়ে দিচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে না বুঝেই হয়তো আ'লীগ ভারতকে সমর্থন দিতে গিয়ে নিজ দেশকে ঠকাচ্ছে। বন্ধুরা, আপনাদের কাছে নিশ্চয়ই ভিন্ন যুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয়, এটা আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চরিত্র বিরোধী। বাংলাদেশ সৃষ্টির মূল কারিগর আওয়ামী লীগের কেবল বর্তমান অবস্থানের কারনেই সময়ের ব্যবধানে মুসলীম লীগ বা জামায়াত ইসলামের পরিণতি হতে পারে!!!!!! এটা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য বড় হুমকি এবং বিশাল ঝুঁকি বলেই আমার মনে হয়। এ বিষয়ে রাষ্ট্র দার্শনিক অধ্যাপক ড. তালুকদার মনিরুজ্জামানের একটি বিশ্লেষণ হাজির করছি। তাঁর মতে, 'ভৌগোলিক অবস্থানের কারনেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বেভৌমত্ব টিকিয়ে রাখতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে নিজ নিজ অবস্থানে শক্তিশালী থাকা জরুরী। এটা যতোদিন থাকবে, ততোদিন বাংলাদেশ তার অস্তিত্ব হারাবে না। বাংলাদেশ সামনের দিকে এগুবে।' ইতিহাস চর্চা, গবেষণা ও রাজনৈতিক সাংবাদিকতার সামান্য অভিজ্ঞতায় আমার ধারনাও এমনই। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শন ভিন্ন হলেও ফলাফল কিন্তু প্রায় কাছাকাছি। মূল দর্শনের বাইরে লুটেরাদের ভাগ-বাটোয়ারার রাজনীতি উন্নয়নশীল সব দেশেই আছে। আমাদের দুই দলেই আছে। ক্রমশ কমার কথা থাকলেও, লুটেরারা ক্রমাগত বাড়ছে। এটা দুঃশ্চিন্তার। যাই হোক, মূল বিষয়ে আসি।
বন্ধুরা, দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া বলতে গেলে ছেড়েই দিয়েছি। তবে প্রায় প্রতিদিন-ই একবার ফেসবুক লগইন করি। দেখি, বন্ধুরা অনেক কিছু নিয়ে লেখেন। গুরুত্বপূর্ণ অনেক সংবাদের লিংকও পাই। অনেকে দেশপ্রেম, অনেকে দুর্নীতি, হত্যা-গুম, সরকারের ভাল-মন্দ, বৈধতা-অবৈধতা নিয়ে লেখেন। লিখতে না্ চাইলেও এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে পারলাম না। জানি, আপনারা অনেকে আমাকে গালাগাল করতে পারেন। এটা আপনাদের অধিকার। মুখ আপনার, হাত, মস্তিস্ক সব-ই আপনার। যা ইচ্ছা বলতে পারেন, কিন্তু ভাই আপনারা আওয়ামী লীগের ২০ বছর পরের চিত্র অনুধাবন করুন। নতুন প্রজন্ম এমনকি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও এই দলটিকে ভারতের পদলেহী বলতে চাইছেন। এটা খুবই লজ্জাস্কর। আমরা আওয়ামী লীগকে দেখতে চাই, মহান স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল হিসেবে। বাংলাদেশের মানুষের দল হিসেবে। বিএনপিকে দেখেত চাই, মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের দল হিসেবে। তাদের দর্শন লালন করলে আর 'পাকি' বা 'ভাকু' শব্দের মতো নোংরা কিছু আমাদের ব্যবহার করতে হবে না। 'ছাগু' বা 'ভাদা' নিয়ে বিতর্ক না করে আসুন নিজেদের দেশের কথা বলি। নিজেদের সংস্কৃতি চর্চা করি। ভিন দেশের উপর নির্ভর করে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা ছাড়ি, বাংলাদেশের মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনা করি। নতুন প্রজন্মের চাওয়া এটাই। নতুন প্রজন্মের মধ্যেও 'রাজাকার' বা 'দালাল' শ্রেনীর প্রেতাত্মা ভর করছে। এসব থেকে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে আসুন, আমরা সবাই মিলে বাংলাদেশ গড়ি। স্বাধীন সার্বেভৌম বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশের জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধারা জীবন দিয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন।
মাহাবুবুর রহমান
সাবেক সভাপতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি
COMMENTS