মো. মুজিবুর রহমান: বাঙালির এযাবৎ কালের শ্রেষ্ঠ অর্জন, স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। একাত্তরের গণহত্যার রক্তের জমিন থেকে আমাদের বিজয়ের লাল-সবুজের পতাকা। বাঙালির মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ মার্চ ১৯৭১ এবং মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের দিন ১৭ এপ্রিল ১৯৭১ যেন একসূত্রে গাথা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একাত্তরের ১৭ এপ্রিল এক অবিস্মরণীয় দিন। ঐতিহাসিক দিক থেকে দিনটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সরকার গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাস সকল প্রকার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পরিচালনা করেছে দীর্ঘ নয় মাসের বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। নিয়েছে দেশ গঠন ও উন্নয়নের জন্য বিশেষ ভূমিকা। বিপুল অস্ত্র সম্ভারে সজ্জিত দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণদান, অস্ত্র সংগ্রহ, কূটনৈতিক তৎপরতা বিষয়ক কার্যক্রম সফলতার সঙ্গে পালন করেছে। ইতিহাস তার সাক্ষী। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজ উদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল সেই পলাশীর আম্রকাননের মাত্র ২৩ মাইল দূরে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলার আরেক আম্রকাননে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার স্বাধীনতার সেই অস্তমিত সূর্য আবার উদিত হলো। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির সংগ্রাম, ত্যাগ-তীতিক্ষার পর বৈদ্যনাথতলায় রচিত হয়েছিল আরেকটি ইতিহাস। একাত্তরের ১৭ এপ্রিল বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্নের স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম আনুষ্ঠানিক ভিত্তিমূল রচিত হয়। সেই সঙ্গে রচিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন এক উজ্জ্বল ইতিহাস। নয় মাসের সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয় স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
সমগ্র বাঙালি জাতি ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ব্যালট বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে গণরায় দেয়। বাঙালি জাতির গণরায়ের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্র শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে একাত্তরের এক মার্চ থেকে এদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র অকার্যকর হয়ে পড়ে। একাত্তরের উত্তাল মার্চ সবকিছু চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। তিনি ছিলেন বাঙালির মহানায়ক ও অধিকর্তা ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু দিলেন সেই কালজয়ী ভাষণটি। সেই ময়দানে লাখ লাখ জনতার সমানে তিনি বললেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' রেসকোর্স ময়দানের এই ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে ডাক দেন, সেই ডাকেই বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। পরে ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস গণহত্যা শুরু করে। সেই রাতে বাঙালি জাতি নির্ভয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই শুরু করে দেয়। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হলো বাংলার প্রতিটি গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে, বাজারে-ঘাটে লড়াই-প্রতিরোধ। এদিকে বাংলাদেশের আপামর জনতার একতার প্রতীক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে আটক রাখা হলো।
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ একাত্তরের ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় ফরিদপুর-কুষ্টিয়া পথে ভারতের পশ্চিমবাংলার সীমান্তে পৌঁছেন। তার রাজনৈতিক সহকর্মী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ৩১ মার্চ মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পর্দাপণ করেন।
১ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে দিল্লির পথে যাত্রা করেন তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। ৩ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের প্রথমবারের মতো দেখা হয়। তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। ৫ এপ্রিল পুনরায় তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। সেদিন যে বিষয়সমূহ আলোচনায় স্থান পায় তা ছিল এমন_ বাংলাদেশ সরকারকে ভারতের অবস্থানের অনুমতি প্রদান; সরকার পরিচালনায় সহায়তা প্রদান; মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের ব্যবস্থা; আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় ও বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক শেষে ভারতে উপস্থিত আওয়ামী লীগের এমএনএ ও এমপিদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার আলোচনা সভায় মিলিত হলেন তাজউদ্দীন আহমদ।
একাত্তরের অগ্নিগর্ভা সময়ের ১০ এপ্রিল এক বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে তাজউদ্দীন আহমদ এক বেতার ভাষণ দেন। জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি (রাষ্ট্র্রপতির অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) ও তাকে প্রধানমন্ত্রী করে বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। সেই সঙ্গে ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ঘোষিত হয়। ঘোষিত স্বাধীনতাপত্রে জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অখ-তা রক্ষা, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিক মর্যাদাবোধ সমুন্নত রাখার জন্য সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের অঙ্গীকার করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভবের পটভূমি, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতন, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে বৈষম্য ও বাঙালি জাতির বীরত্ব অভিব্যক্ত হয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে। লক্ষণীয় যে, একাত্তরের ২৬ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণাটি কে দিয়েছিলেন তা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের পাঁচ নম্বর প্যারায় পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে, '... বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন...।' বাংলাদেশ সংবিধানে এই ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত করা হয়।
বাংলাদেশ সরকার গঠন ও স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের সংবাদ ১১ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও আকাশবাণী বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। তারপর দিল্লি কেন্দ্র, বিবিসিসহ বিশ্বের অন্যান্য গণমাধ্যম এই সংবাদ প্রচার করে। এই সংবাদ অবরুদ্ধ বাংলাদেশে ও মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে সাহস, আস্থা ও যুদ্ধ বিজয়ের মনোভাব তৈরি করে। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধকল্পে আরও এগিয়ে আসে। কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে রণধ্বনি 'জয় বাংলা'। কানে বেজে ওঠে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণের নির্দেশাবলী। সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছে সর্বত্র। একাত্তরের ১১ এপ্রিল ভারতের আগরতলায় এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, চুয়াডাঙ্গায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবর্গ ১৪ এপিল প্রকাশ্যে শপথ গ্রহণ করবেন। এই সিদ্ধান্ত গণমাধ্যমে প্রকাশ লাভ করায় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী চুয়াডাঙ্গায় প্রবল বোমবর্ষণ করে। পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত হয়, চুয়াডাঙ্গার পার্শ্ববর্তী মেহেরপুর মহকুমার (বর্তমানে জেলা) বৈদ্যনাথতলায় বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেবে।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলায় (পরবর্তীতে মুজিবনগর) আম্রকাননের চারদিকে অস্ত্র হাতে কড়া পাহাড়ায় ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। চারদিকে হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষের উপচেপড়া ভিড়। শপথের ঐতিহাসিক মুহূর্তটি ধারণ করতে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরাও প্রস্তুত। মুক্ত আকাশের নিচে চৌকি পেতে তৈরি করা হয়েছিল শপথ মঞ্চ। মঞ্চের ওপর সাজনো ছয়খানা চেয়ার। শপথ অনুষ্ঠানের প্রবেশপথে বাংলা লেখা স্বাগতম। এক পর্যায়ে নতুন রাষ্ট্রের নেতারা একে একে আসতে থাকেন। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্নোগানে প্রকম্পিত চারদিক। প্রথম শপথ মঞ্চে উঠে এলেন বঙ্গবন্ধুর আজীবনের ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তার পেছনে আরেক সহচর তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচ এম কামরুজ্জামান, খন্দাকার মোশতাক আহমেদ (পরবর্তীতে বিশ্বাসঘাতকরূপে আবির্ভূত বলে খ্যাত) ও কর্নেল (অব.) এমএজি ওসমানী। অনুষ্ঠানের সূচনায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও গীতা, বাইবেল থেকে পাঠ করা হয়। স্থানীয় শিল্পী ও হাজারো মানুষের কণ্ঠে গাওয়া হয় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।' এর পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম উত্তোলন করেন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। এরপর আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী ঐতিহাসিক দলিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। তারপর তিনি নতুন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রীবর্গকে শপথবাক্য পাঠ করান। শপথ গ্রহণের পর সশস্ত্র তেজোদীপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবর্গকে রাষ্ট্রীয় কায়দায় গার্ড অফ অনার প্রদান করেন। শপথ গ্রহণ শেষে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইমলাম তার ভাষণে বলেন, 'আজ এই আম্রকাননে একটি নতুন জাতি জন্ম নিল। ... পৃথিবীর মানচিত্রে আজ নতুন রাষ্ট্রের সূচনা হলো তা চিরদিন থাকবে।' প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর নামানুসারে বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করেন মুজিবনগর। তিনি জাতির উদ্দেশে স্বাধীনতার ঘোষণার পটভূমি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'পাকিস্তান আজ মৃত। অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে।... স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটি বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন শিশু রাষ্ট্রকে লালন-পালন করছেন। দুনিয়ার কোন জাতি এ নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হোক, কাল হোক দুনিয়ার ছোট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হবে এ নতুন জাতিকে। স্থান করে দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে।' স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার মাধ্যমে শেষ হয় একটি প্রজ্ঞা সমৃদ্ধ রাজনৈতিক পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাত থেকে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর জ্বালাও, পোড়াও হত্যা ও লুটপাটের পৈশাচিক কর্মকাণ্ড শুরু করার স্বাধীনতার স্বপক্ষের লোকদের একত্রিত করে একটা সরকার গঠন করা এবং পাকিস্তানের মতো একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নয় মাসের মধ্যে বিজয় ছিনিয়ে আনাটা সত্যিই একটি কঠিন কাজ বলে বিবেচিত। আর এই কঠিন কাজটি সুচারুরূপে ও দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার। এ সরকার মুজিবনগর সরকার নামে খ্যাত। জাতি ১৭ এপ্রিলকে ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। এবারের ১৭ এপ্রিল ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বাঙালির জাতির সামনে এসেছে। স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা নতুন করে শুরু হয়েছে। এই স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্ম সর্বদা জাগ্রত রয়েছে। এর প্রমাণ এরই মধ্যে দিয়েছে। প্রমাণ করেছে তারা ইতিহাস সচেতন। অসাম্প্রদায়িক, রাজাকারমুক্ত, ক্ষুধামুক্ত ও সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে অঙ্গীকারবদ্ধ আজকের তরুণ প্রজন্ম। আজকের তরুণ প্রজন্মকে বাঙালির মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও চেতনাকে বুকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধুর ন্যায় স্বদেশকে ভালোবাসতে হবে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের দিনের তাৎপর্য রয়েছে তাও তরুণ প্রজন্ম অনুধাবন করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এই মুজিবনগর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার ও স্বর্ণদুয়ার। স্বাধীনতার কথা ও মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠলে এই স্বর্ণ দুয়ারের অস্তিত্ব মানতে হবে। সকলকে যথাযথ সম্মান দিতে হবে। একাত্তরের ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বরের মেলবন্ধন হচ্ছে ১৭ এপ্রিল। মুজিবনগর সরকারের (বাংলাদেশের প্রথম সরকার) দূরদৃষ্টি ও দক্ষতার ফলে মাত্র নয় মাসে বাংলাদেশ দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে অস্ত্রসমর্পণে বাধ্য করে। মেহেরপুরের সেই ঐতিহাসিক মুজিবনগরের পুরো এলাকা ঘুরে আসলে মনে হবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত ইতিহাস বুকে ধারণ করে আছে মুজিবনগর।
[লেখক : কলেজ শিক্ষক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক এবং আর্কাইভস ৭১-এর প্রতিষ্ঠাতা।]
সমগ্র বাঙালি জাতি ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ব্যালট বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে গণরায় দেয়। বাঙালি জাতির গণরায়ের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্র শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে একাত্তরের এক মার্চ থেকে এদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র অকার্যকর হয়ে পড়ে। একাত্তরের উত্তাল মার্চ সবকিছু চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। তিনি ছিলেন বাঙালির মহানায়ক ও অধিকর্তা ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু দিলেন সেই কালজয়ী ভাষণটি। সেই ময়দানে লাখ লাখ জনতার সমানে তিনি বললেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' রেসকোর্স ময়দানের এই ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে ডাক দেন, সেই ডাকেই বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। পরে ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস গণহত্যা শুরু করে। সেই রাতে বাঙালি জাতি নির্ভয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই শুরু করে দেয়। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। শুরু হলো বাংলার প্রতিটি গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে, বাজারে-ঘাটে লড়াই-প্রতিরোধ। এদিকে বাংলাদেশের আপামর জনতার একতার প্রতীক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে আটক রাখা হলো।
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ একাত্তরের ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় ফরিদপুর-কুষ্টিয়া পথে ভারতের পশ্চিমবাংলার সীমান্তে পৌঁছেন। তার রাজনৈতিক সহকর্মী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ৩১ মার্চ মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পর্দাপণ করেন।
১ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে দিল্লির পথে যাত্রা করেন তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। ৩ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের প্রথমবারের মতো দেখা হয়। তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। ৫ এপ্রিল পুনরায় তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। সেদিন যে বিষয়সমূহ আলোচনায় স্থান পায় তা ছিল এমন_ বাংলাদেশ সরকারকে ভারতের অবস্থানের অনুমতি প্রদান; সরকার পরিচালনায় সহায়তা প্রদান; মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের ব্যবস্থা; আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় ও বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক শেষে ভারতে উপস্থিত আওয়ামী লীগের এমএনএ ও এমপিদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার আলোচনা সভায় মিলিত হলেন তাজউদ্দীন আহমদ।
একাত্তরের অগ্নিগর্ভা সময়ের ১০ এপ্রিল এক বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে তাজউদ্দীন আহমদ এক বেতার ভাষণ দেন। জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি (রাষ্ট্র্রপতির অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) ও তাকে প্রধানমন্ত্রী করে বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। সেই সঙ্গে ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ঘোষিত হয়। ঘোষিত স্বাধীনতাপত্রে জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অখ-তা রক্ষা, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিক মর্যাদাবোধ সমুন্নত রাখার জন্য সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারের অঙ্গীকার করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভবের পটভূমি, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতন, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে বৈষম্য ও বাঙালি জাতির বীরত্ব অভিব্যক্ত হয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে। লক্ষণীয় যে, একাত্তরের ২৬ মার্চে স্বাধীনতার ঘোষণাটি কে দিয়েছিলেন তা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের পাঁচ নম্বর প্যারায় পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে, '... বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন...।' বাংলাদেশ সংবিধানে এই ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত করা হয়।
বাংলাদেশ সরকার গঠন ও স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের সংবাদ ১১ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও আকাশবাণী বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। তারপর দিল্লি কেন্দ্র, বিবিসিসহ বিশ্বের অন্যান্য গণমাধ্যম এই সংবাদ প্রচার করে। এই সংবাদ অবরুদ্ধ বাংলাদেশে ও মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে সাহস, আস্থা ও যুদ্ধ বিজয়ের মনোভাব তৈরি করে। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধকল্পে আরও এগিয়ে আসে। কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে রণধ্বনি 'জয় বাংলা'। কানে বেজে ওঠে ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণের নির্দেশাবলী। সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছে সর্বত্র। একাত্তরের ১১ এপ্রিল ভারতের আগরতলায় এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, চুয়াডাঙ্গায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবর্গ ১৪ এপিল প্রকাশ্যে শপথ গ্রহণ করবেন। এই সিদ্ধান্ত গণমাধ্যমে প্রকাশ লাভ করায় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী চুয়াডাঙ্গায় প্রবল বোমবর্ষণ করে। পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত হয়, চুয়াডাঙ্গার পার্শ্ববর্তী মেহেরপুর মহকুমার (বর্তমানে জেলা) বৈদ্যনাথতলায় বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেবে।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলায় (পরবর্তীতে মুজিবনগর) আম্রকাননের চারদিকে অস্ত্র হাতে কড়া পাহাড়ায় ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। চারদিকে হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষের উপচেপড়া ভিড়। শপথের ঐতিহাসিক মুহূর্তটি ধারণ করতে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরাও প্রস্তুত। মুক্ত আকাশের নিচে চৌকি পেতে তৈরি করা হয়েছিল শপথ মঞ্চ। মঞ্চের ওপর সাজনো ছয়খানা চেয়ার। শপথ অনুষ্ঠানের প্রবেশপথে বাংলা লেখা স্বাগতম। এক পর্যায়ে নতুন রাষ্ট্রের নেতারা একে একে আসতে থাকেন। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্নোগানে প্রকম্পিত চারদিক। প্রথম শপথ মঞ্চে উঠে এলেন বঙ্গবন্ধুর আজীবনের ঘনিষ্ঠ সহচর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তার পেছনে আরেক সহচর তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এএইচ এম কামরুজ্জামান, খন্দাকার মোশতাক আহমেদ (পরবর্তীতে বিশ্বাসঘাতকরূপে আবির্ভূত বলে খ্যাত) ও কর্নেল (অব.) এমএজি ওসমানী। অনুষ্ঠানের সূচনায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও গীতা, বাইবেল থেকে পাঠ করা হয়। স্থানীয় শিল্পী ও হাজারো মানুষের কণ্ঠে গাওয়া হয় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।' এর পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম উত্তোলন করেন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। এরপর আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী ঐতিহাসিক দলিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। তারপর তিনি নতুন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রীবর্গকে শপথবাক্য পাঠ করান। শপথ গ্রহণের পর সশস্ত্র তেজোদীপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবর্গকে রাষ্ট্রীয় কায়দায় গার্ড অফ অনার প্রদান করেন। শপথ গ্রহণ শেষে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইমলাম তার ভাষণে বলেন, 'আজ এই আম্রকাননে একটি নতুন জাতি জন্ম নিল। ... পৃথিবীর মানচিত্রে আজ নতুন রাষ্ট্রের সূচনা হলো তা চিরদিন থাকবে।' প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর নামানুসারে বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করেন মুজিবনগর। তিনি জাতির উদ্দেশে স্বাধীনতার ঘোষণার পটভূমি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'পাকিস্তান আজ মৃত। অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে।... স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটি বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন শিশু রাষ্ট্রকে লালন-পালন করছেন। দুনিয়ার কোন জাতি এ নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হোক, কাল হোক দুনিয়ার ছোট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হবে এ নতুন জাতিকে। স্থান করে দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে।' স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার মাধ্যমে শেষ হয় একটি প্রজ্ঞা সমৃদ্ধ রাজনৈতিক পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাত থেকে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর জ্বালাও, পোড়াও হত্যা ও লুটপাটের পৈশাচিক কর্মকাণ্ড শুরু করার স্বাধীনতার স্বপক্ষের লোকদের একত্রিত করে একটা সরকার গঠন করা এবং পাকিস্তানের মতো একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নয় মাসের মধ্যে বিজয় ছিনিয়ে আনাটা সত্যিই একটি কঠিন কাজ বলে বিবেচিত। আর এই কঠিন কাজটি সুচারুরূপে ও দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার। এ সরকার মুজিবনগর সরকার নামে খ্যাত। জাতি ১৭ এপ্রিলকে ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। এবারের ১৭ এপ্রিল ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বাঙালির জাতির সামনে এসেছে। স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা নতুন করে শুরু হয়েছে। এই স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্ম সর্বদা জাগ্রত রয়েছে। এর প্রমাণ এরই মধ্যে দিয়েছে। প্রমাণ করেছে তারা ইতিহাস সচেতন। অসাম্প্রদায়িক, রাজাকারমুক্ত, ক্ষুধামুক্ত ও সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে অঙ্গীকারবদ্ধ আজকের তরুণ প্রজন্ম। আজকের তরুণ প্রজন্মকে বাঙালির মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও চেতনাকে বুকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধুর ন্যায় স্বদেশকে ভালোবাসতে হবে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের দিনের তাৎপর্য রয়েছে তাও তরুণ প্রজন্ম অনুধাবন করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এই মুজিবনগর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার ও স্বর্ণদুয়ার। স্বাধীনতার কথা ও মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠলে এই স্বর্ণ দুয়ারের অস্তিত্ব মানতে হবে। সকলকে যথাযথ সম্মান দিতে হবে। একাত্তরের ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বরের মেলবন্ধন হচ্ছে ১৭ এপ্রিল। মুজিবনগর সরকারের (বাংলাদেশের প্রথম সরকার) দূরদৃষ্টি ও দক্ষতার ফলে মাত্র নয় মাসে বাংলাদেশ দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে অস্ত্রসমর্পণে বাধ্য করে। মেহেরপুরের সেই ঐতিহাসিক মুজিবনগরের পুরো এলাকা ঘুরে আসলে মনে হবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত ইতিহাস বুকে ধারণ করে আছে মুজিবনগর।
[লেখক : কলেজ শিক্ষক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক এবং আর্কাইভস ৭১-এর প্রতিষ্ঠাতা।]
COMMENTS