চৈত্র যাচ্ছে সংক্রান্তির দিকে, এগিয়ে আসছে বৈশাখ। অতীতের হাসি কান্না আনন্দ বেদনাকে ভুলে নতুন বর্ষকে বরণ করার অপেক্ষায় দেশের মানুষ। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী উৎসবকে বরণ করে নিতে দেশব্যাপী চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। নতুন বছরে নিজেকে নতুন রূপে সাজাতে তরুণ-তরুণীরা ভিড় করছেন বিপনী বিতানে।
অপরদিকে, পহেলা বৈশাখের সুস্বাদু খাবার পান্তা-ইলিশ, মুড়ি-মুড়কি, ক্ষীর-পায়েশ আর পিঠা-পুলি তৈরিতে ব্যস্ত পাঁচতারকা হোটেল থেকে শুরু করে ফুটপাতের মৌসুমি রেস্টুরেন্ট।
পহেলা বৈশাখ এখন বাঙালির একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। শুরুতে এমনটি ছিল না। তখন নববর্ষ ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত। তখন এটি ছিল কৃষান-কৃষানির উৎসব। ভারত বর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে খাজনা আদায় করত। হিজরী সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সঙ্গে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে আসুবিধা হত।
মুঘল সম্রাট আকবর বাংলার কৃষকদের সুবিধার্থে প্রাচীন বর্ষপঞ্জতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবীদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। কৃষকদের কাছে এ সনের নাম ছিল ফসলি সন। পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।
আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের ধারা প্রথম শুরু হয় ১৯১৭ সালে। সে বছর পহেলা বৈশাখে প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এরপর আবার পহেলা বৈশাখ উদযাপনের খবর পাওয়া যায় ১৯৩৮ সালে। তবে ১৯৬৭ সাল থেকে 'ছায়ানট' রমনা বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এর পুনঃজাগরণ করে। এভাবেই বাঙালির আধুনিক নববর্ষ উদযাপন শুরু। তখন থেকেই নববর্ষে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পান্তা-ইলিশের ঐতিহ্যে।
পহেলা বৈশাখে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলিত কণ্ঠে 'এসো হে বৈশাখ' গান গেয়ে নতুন বর্ষকে বরণ করেন। ঢাকার বৈশাখী উৎসবের অন্যতম একটি আকর্ষণ হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট ১৯৮৯ সাল থেকে এ মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু করে। এই শোভাযাত্রায় আবহমান গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জীবনের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়। রঙ-বেরঙের মুখোশ পরা নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণে মঙ্গল শোভাযাত্রাটি বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে উৎসবের কেন্দ্রস্থল রমনা বটমূলে শেষ হয়।
বাংলা নববর্ষ মানেই যেন বৈশাখী মেলা। সারা দেশে প্রায় ২৭০টি বৈশাখী মেলা বসে। বৈশাখের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় মেলা। কোন কোন জায়গায় চলে মাসব্যাপী। মেলাতে নানা প্রকারের দেশীয় মিষ্টান্ন, নারিকেল মুড়কিসহ আরও অনেক সুস্বাদু খাদ্যের দেখা মেলে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্তে লাঠি খেলা, নৌকা বাইচ প্রভৃতি খেলা হয়।
COMMENTS