আজ পহেলা বৈশাখ, কোটি বাঙালির প্রাণের উৎসবের দিন। পুরানো বছরের সব অপ্রাপ্তি, বেদনা মুছে দিয়ে জীবনে নতুন সম্ভাবনার আলো জ্বালাতে এসেছে পহেলা বৈশাখ। একটি নতুন মাস, একটি নতুন বছরের শুভ সূচনা আজ। রোববার চৈত্র সংক্রান্তির পড়ন্ত বেলার রোদের সঙ্গে সঙ্গে শেষ দিনটি কালের অতলে হারিয়ে গেছে। আজ পহেলা বৈশাখে লাখো প্রাণের স্পন্দনে প্রথম সূর্য কিরণের সঙ্গে জেগে উঠবে নতুন বাংলা বছর ১৪২১।
সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর সব বয়সের নাগরিক নতুন পোশাক পরে নতুন বছরকে বরণের জন্য বিপুল উত্সাহে বের হয়ে আসবে রাজপথে। অধিকাংশের ঠিকানা হয়ে উঠবে রমনা বটমূল ও চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমী কেন্দ্রিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানস্থল। নতুনের আবাহনে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই চিরায়ত সুর অনুরণন তুলবে প্রতিটি বাঙালির হূদয়ে- 'এসো হে, বৈশাখ এসো এসো/ তাপস নিঃশ্বাস বায়ে, মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,/ বত্সরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক'/।
জাতি, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে কেবল বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই নয়, পৃথিবীর যেখানেই বাঙালি ও বাংলা ভাষাভাষী মানুষ রয়েছে সবাই পয়লা বৈশাখে বর্ণাঢ্য উত্সবের আয়োজন করবে। রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষ বাংলা গান, কবিতা, শোভাযাত্রা, নাচসহ নানা আয়োজনে দিনটি উদযাপন করবেন। তবে ছায়ানট আয়োজিত বর্ষ আবাহনের অনুষ্ঠান ঢাকাবাসীর বৈশাখ উদযাপনে নিয়ে এসেছে নতুন মাত্রা। ৫০ বছর ধরে আয়োজিত তাদের এ অনুষ্ঠানের আবেদন এখনো পুরো দেশবাসীর কাছে সমানভাবেই ক্রিয়াশীল। স্বাধিকার আন্দোলনে বাঙালি সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরার মধ্য দিয়ে ছায়ানট যে প্রতিবাদী যাত্রা শুরু করেছিল — আজো ছায়ানটের এ অনুষ্ঠানে অনিবার্য টানে লাখো মানুষের উপস্থিতি ঘটে তীব্র আবেগময়তায়। আজ ভোর ৬টা থেকেই রমনার বটমূলে শুরু হবে এ অনুষ্ঠান।
নববর্ষ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী শুভেচ্ছা বাণী দিয়েছেন। আজ সরকারি ছুটির দিন। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। সকল সরকারি-বেসরকারি টিভি ও রেডিও বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা সমপ্রচার করছে। নববর্ষ উদযাপনের জন্য ঢাকাসহ সারাদেশে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ৫টি বিভাগীয় শহর, ঢাকা মহানগর, দেশের সকল জেলা ও উপজেলায় নানা বর্ণিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা ও লোকজ মেলার আয়োজন করা হয়েছে। বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনসমূহ এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করবে।
নববর্ষ উপলক্ষে সকল কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবারে (এতিমখানা) উন্নতমানের বাঙালি খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। শিশু পরিবারের শিশুদের নিয়ে ও কারাবন্দীদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে এবং কয়েদিদের তৈরি বিভিন্ন দ্রব্যাদি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকবে। সকল জাদুঘর ও প্রত্নস্থান সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে (শিশু-কিশোর, প্রতিবন্ধী ও ছাত্র-ছাত্রীদের বিনা টিকেটে)। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্ব-স্ব ব্যবস্থাপনায় জাঁকজমকপূর্ণভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপনব করা হবে।
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেত্রীর শুভেচ্ছা
নববর্ষ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াসহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতারা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি বলেছেন, অতীতের সব গ্লানি ও বিভেদ ভুলে বাংলা নববর্ষ জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমাদের ঐক্য আরো সুদৃঢ় করবে এবং বয়ে আনবে অফুরন্ত আনন্দের বারতা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নববর্ষ সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ও দেশবিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি যোগাবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, বাংলা নববর্ষ জরা ও গ্ল¬ানি মুছে দিয়ে বাঙালির জীবনে সুখ, সমৃদ্ধি ও অনাবিল আনন্দ বয়ে আনবে।
রওশন এরশাদ তার বাণীতে নতুন বছরে পুরাতন ও জরাজীর্ণতাকে বিসর্জন দিয়ে বাংলা নববর্ষে নতুন উত্সাহ-উদ্দীপনায় দেশ গঠনে সবাইকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে কাজ করার আহ্বান জানান।
বেগম খালেদা জিয়া বলেন, নতুন বছরে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে প্রবাহিত হোক শান্তির অমিয় ধারা, সবার জীবন হয়ে উঠুক সমৃদ্ধময়।
বঙ্গভবন: জাতীয় পর্যায়ে বাংলা নববর্ষের দ্বিতীয় দিন বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি স্বাধীনতা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সুধীবৃন্দ, নেতৃস্থানীয় লেখক, কবি, সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সংবর্ধনা প্রদান করবেন। বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বিভাগীয় শহর এবং ৫৭টি জেলা সদরে ও সকল উপজেলায় বৈশাখী অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে স্থানীয় প্রশাসন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করবে। বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটসমূহ ও বিসিক নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করবে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলার আয়োজন করবে।
ছায়ানট: রমনা বটমূলে সকাল সোয়া ছয়টায় শুরু হবে ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণ উত্সব। সুরলহরী দিয়ে শুরু হবে অনুষ্ঠান। এরপর শুরু হবে ছায়ানটের শিল্পীদের সমবেত সঙ্গীত পরিবেশন এবং দেশের জনপ্রিয় শিল্পীদের একক পরিবেশনা। ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আনাম শাকিল জানান, পহেলা বৈশাখে সাধারণত মনকে শুদ্ধ করে এমন গান দিয়েই অনুষ্ঠান করা হয়। দেশপ্রেমের গান, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এবং পাঁচ কবির গান পরিবেশন করা হবে রমনার বটমূলে।
চারুকলা: প্রতিবারের মতো এবারও মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে। 'উদ্ধত কর, জাগ্রত কর, নির্ভয়ও কর হে...' এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেবে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষ।
বাংলা একাডেমি: সকাল সাড়ে ৭টায় বর্ষবরণ সংগীতের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি তাদের নববর্ষের অনুষ্ঠান শুরু করবে। একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে নজরুল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে একক বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। একক বক্তৃতা প্রদান করবেন অধ্যাপক হায়াত্ মামুদ। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ১লা বৈশাখ থেকে ১০ বৈশাখ পর্যন্ত বইয়ের আড়ং অনুষ্ঠিত হবে। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এ আড়ং খোলা থাকবে। আড়ং-এ বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বই ৩৫%-৬০% ছাড়ে বিক্রি হবে। এছাড়া বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)-এর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত ১০ দিনব্যাপী বৈশাখী মেলার উদ্বোধন হবে আজ বিকেল ৪টায়।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর: সকাল ৯টায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
চ্যানেল আই ও সুরের ধারা: বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিতে চ্যানেল আই ও সুরের ধারা আয়োজন করেছে হাজারও শিল্পীর অংশগ্রহণে হাজারও কণ্ঠে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানটি সরাসরি সমপ্রচার করবে চ্যানেল আই এবং কলকাতার রূপসী বাংলা টেলিভিশন।
আওয়ামী লীগ: নববর্ষকে বরণ করতে শোভাযাত্রা করবে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ। শোভাযাত্রাটি ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে থেকে সকাল সাড়ে ৭টায় শুরু হয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এসে শেষ হবে।
জাতীয় প্রেসক্লাব: বর্ষবরণ উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাব আয়োজন করেছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের। সকাল ৮টায় ক্লাব সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খৈ, মুড়ি, মুড়কি, পান্তা ইলিশসহ নানা ধরনের খাওয়া-দাওয়া আর মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে বিশেষ আকর্ষণ থাকছে- গ্রামবাংলার বায়োস্কোপ প্রদর্শনী, সাপের খেলা ও বানরের নাচ।
মহিলা দল ও জাসাস: নয়াপল্টনে বৈশাখী মেলার আয়োজন করছে জাতীয়তাবাদী মহিলা দল। আর আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেবে জাতীয়তাবাদী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস)।
ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী: 'জাগো নব আনন্দে' আহ্বান নিয়ে শাহবাগের শিশুপার্কের সামনে নারকেলবীথি চত্বরে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠানটি শুরু হবে আজ সকাল সাড়ে ৭টায়।
কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা: সেগুনবাগিচায় কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার মেলা কার্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে পিঠা মেলা, ছবি প্রদর্শনী, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা।
আবাহনী লিমিটেড: প্রতিবারের মতো এবারও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে ধানমন্ডির আবাহনী মাঠে অনুষ্ঠিত হবে বিশেষ কনসার্ট। 'বৈশাখী উত্সব ১৪২১' শিরোনামের এ কনসার্টে গান করবেন জনপ্রিয় চারটি গানের দল (ব্যান্ড)- মাকসুদ ও ঢাকা, চিরকুট, জলের গান এবং ব্রাদারহুড প্রজেক্ট (জয় ও পারভেজ)। আরও থাকবে টুনটুন বাউল ও রব ফকিরের পরিবেশনা। আজ আড়াইটা থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলবে এ অনুষ্ঠান।
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়: বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সকাল ৮টায় শুরু হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এরপরই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের লিচু তলায় শুরু হবে দিনব্যাপি অনুষ্ঠানমালা।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট: ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরের উন্মুক্ত মঞ্চে জোট বৈশাখী উত্সবের আয়োজন করেছে।
রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী সংসদ: বর্ষবরণ উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় শুরু হবে অনুষ্ঠান।
এছাড়া শিশু একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, নজরুল ইনস্টিটিউট, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় (সিদ্ধেশ্বরী ক্যাম্পাস), মৈত্রী থিয়েটার, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, সুইড বাংলাদেশ, সরগম ললিতকলা, প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-মেলা-লোক উত্সব-পিঠা উত্সব-আলোচনার আয়োজন করা হয়েছে।
বারাক ওবামার শুভেচ্ছা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের পক্ষ থেকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরী বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বিশ্বের সব বাঙালিদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। গত ১১ এপ্রিল এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জন কেরী জানান, নববর্ষ উদযাপনবের জন্য আপনারা যখন পরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবসহ একত্রিত হবেন, তখন জানবেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও আপনাদের বন্ধু ও অংশীদার হিসাবে আপনাদের সঙ্গে রয়েছে।
COMMENTS