গ্যাস-বিদ্যুতে দেড় হাজার কোটি টাকা লুটপাট

রাষ্ট্রীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ দুই খাত বিদ্যুৎ ও গ্যাস। এ দুই খাতে লুটপাট যেন থামছেই না। প্রতিবছর প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার হরিলুট চলছে এ দুই খাতে। বিদ্যুৎ খাতে পদ্ধতিগত ১০ শতাংশ লোকসান 'সিস্টেম লস'-এর সঙ্গে ৫ শতাংশ চুরি যুক্ত করে রীতিমতো চলছে ডাকাতি। প্রতিবছর ৫ শতাংশ চুরি করা বিদ্যুতের দাম ৬০০ কোটি টাকারও বেশি। অবশ্য জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, টেকনিক্যাল কারণে বিদ্যুতে সিস্টেম লসের পরিমাণ শতকরা সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। সে হিসেবে চুরির পরিমাণ ৯০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। প্রতিবছর এ বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ চুরিকে সরকারিভাবেই বৈধতা দেওয়া আছে। এর বাইরেও আছে নানা ধরনের কারসাজি আর হরিলুটের কাহিনী।

অন্যদিকে গ্যাস খাতে সরাসরি তিন কোটি ঘনফুট গ্যাস চুরির মাধ্যমে বছরে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে ২২০ কোটি টাকা। এ ছাড়া মিটার কারসাজি, বিল জালিয়াতি, নানা রকম প্রতারণা মিলিয়ে আরো প্রায় আড়াই শ কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে সরকারের। ফলে প্রতিবছর গ্যাস খাতে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকা লুটপাটের কাহিনী পেট্রোবাংলা থেকে শুরু করে জ্বালানি মন্ত্রণালয় পর্যন্ত সবাই গর্বের সঙ্গেই স্বীকার করে থাকেন। কিন্তু চুরি বন্ধে সংশ্লিষ্টরা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার নজির দেখাতে পারছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। মাঝেমধ্যে ভিজিলেন্স টিম গঠন করে অবৈধ গ্যাস সংযোগ খুঁজে বের করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। মাঠঘাট চষে বেড়ান ভ্রাম্যমাণ আদালত। গোটিকয় অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন আর অভিযুক্তদের যৎসামান্য জরিমানা দণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে যাবতীয় তৎপরতা।

নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের আশ্রয়, মাসের পর মাস গ্যাস-বিদ্যুতের বিল বকেয়া ফেলে রাখা, মিটার টেম্পারিং, অবৈধভাবে বাইপাস লাইন স্থাপনের মতো অভিযোগে গ্রাহকদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। পিডিবি, ডেসকো ও ডিপিডিসির রেকর্ডপত্র অনুযায়ী এ মুহূর্তে খোদ রাজধানীতেই বিদ্যুতের প্রায় আট হাজার গ্রাহকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা আছে। অন্যদিকে গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা আছে প্রায় তিন হাজার গ্রাহকের। কিন্তু এসব বিচ্ছিন্নতার খোঁজ নিয়ে বাস্তবে কোথাও গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগবিহীন বাড়িঘর, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। দাপ্তরিক খাতাপত্রে আর বিশেষ বিশেষ অভিযানের লগবুকে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ 'বিচ্ছিন্নকরণ'-এর তালিকা তৈরি হয়।

বিদ্যুতে লুটপাট চলছেই... : জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। কিন্তু সিস্টেম লসের নামে বিদ্যুতে চুরির যে মহোৎসব চলছে তা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন থাকছে নির্বিকার। সরকারি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা পাওয়ার সেলের দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পাঁচটি বিতরণকারী সংস্থায় সিস্টেম লস ১৫ শতাংশ, যার মূল্য টাকার অঙ্কে এক হাজার ৮০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরে সিস্টেম লসের কারণে রাষ্ট্রের ক্ষতি হচ্ছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। পাওয়ার সেলের তথ্য অনুযায়ী, বিতরণ সঞ্চালন কারিগরি ও রক্ষাণাবেক্ষণে সিস্টেম লস হচ্ছে ১০ শতাংশ। বাকি পাঁচ শতাংশ সিস্টেম লসের নামে চুরি। প্রকৃতপক্ষে সিস্টেম লসের কারণে বছরে লোকসান হচ্ছে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। সিস্টেম লসের নামে চুরি হচ্ছে ৬০০ কোটি টাকা।

শিল্প-কারখানা থেকে ফুটপাত সর্বত্রই চুরি : সারা দেশে বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে গেছে। শিল্প-কারখানায়, বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে অবৈধ সংযোগ নেওয়া ও দেওয়ার জন্য বিদ্যুৎ অফিসে রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) সূত্রমতে, শুধু ঢাকা শহরেই অবৈধভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। ফুটপাত ঘিরে অবৈধ বিদ্যুৎ ব্যবহার বেড়েই চলেছে। ঢাকা শহরের ফুটপাতগুলোয় বিদ্যুৎ বিল সংগ্রহের কাজ সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীর কাছে অলিখিত লিজ দেওয়া হয়েছে। আর ওই নেতা-কর্মীরা বিদ্যুৎ বিলের নামে দোকানপ্রতি ৩০০ টাকা সংগ্রহ করলেও বিদ্যুৎ অফিসে জমা দিচ্ছে ২০ থেকে ৩০ টাকা করে।

হিটার খায় ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ : বৈদ্যুতিক চুলি্ল বা হিটারের ব্যবহার শুধু ঢাকা শহরেই নয়, ইদানীং অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে গ্রামেগঞ্জে। ঢাকায় শতকার ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয় বৈদ্যুতিক চুলি্লতে। মিটার রিডারদের সঙ্গে কারসাজি করে বৈদ্যুতিক চুলি্লর মাসিক একটি বিল দেওয়া হয়, যার পুরোটাই মিটার রিডারদের পকেটস্থ হচ্ছে। শুধু রান্নাবান্নার কাজে বৈদ্যুতিক চুলি্ল ব্যবহৃত হচ্ছে তা নয়, কাপড়চোপড় শুকানোর কাজেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্বালিয়ে রাখা হচ্ছে তা।

জেনারেটর ব্যবসার আড়ালে চুরি : রাজধানীর পুরান ঢাকার অনেক মহল্লায় মধ্যরাতে ঘড়ি ধরে লোডশেডিং হয়। 'কিন্তু আইপিএস নেই, জেনারেটর নেই, অথচ বিদ্যুৎ চলে গেলেও চকবাজার-মৌলভীবাজার এলাকায় নেভে না বাতি। ফ্যানও ঘোরে। এ বিদ্যুৎটা আসে কোত্থেকে?' এসব প্রশ্ন এলাকাবাসীর। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পরও জেনারেটর লাইনের সঙ্গে সংযোগ দিয়ে চলে চুরির মহোৎসব। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও একদল অসাধু ব্যবসায়ী। বিদ্যুতের প্রধান সংযোগের সঙ্গে অতিরিক্ত একটি তার লাগিয়ে দিনের পর দিন বিদ্যুৎ চুরি করছে তারা। এভাবে কেবল পুরান ঢাকাতেই প্রতিদিন চুরি হয়ে যাচ্ছে কয়েক হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ। কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে সরকার।

অটোবাইক চার্জের ফাঁদে : অতিসমপ্রতি ইজিবাইক অটোরিকশা সারা দেশেই বেড়ে গেছে। এসব ইজিবাইকের ব্যাটারি চার্জের জন্য বিদ্যুতের প্রয়োজন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফোর-ফোরটি লাইনের ১১ কেভি থেকে সরাসরি বিকল্প লাইনের ঝুঁকিপূর্ণ সংযোগ নিয়ে ব্যাটারি চার্জ দেওয়া হচ্ছে। ফলে এসব অটো চার্জের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের বিল দিতে হচ্ছে না। দেশে এখন কমবেশি সাড়ে তিন লাখ ইজিবাইক চলাচল করছে। এর বিপরীতে ৩৫০ থেকে ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। এসব ইজিবাইক ও অটোরিকশা ভ্যানের ব্যাটারি চার্জের নামে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ লুটে নেওয়া হচ্ছে। একটি ইজিবাইকের পাঁচটি ব্যাটারি ৯-১০ ঘণ্টা ধরে এবং অটোরিকশার চারটি ব্যাটারি চার্জ দিতে হয় ৬-৭ ঘণ্টা। একেকটি বাহন প্রতি গড়ে প্রতিদিন পাঁচ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়ে থাকে। চোরাই লাইনের সাহায্যে বিভিন্ন গ্যারেজে রাত-দিন দেওয়া হয় চার্জ। একেকটি বাহনে চার্জ দেওয়া বাবদ আদায় করা হচ্ছে ১২০-১৩০ টাকা করে।

জাতীয় গ্রিডে চুরি : জাতীয় গ্রিড লাইনের বিদ্যুৎও রাখা যাচ্ছে না চুরিবিহীন। উৎপাদন করে যেহেতু মজুদ রাখার কোনো উপায় নেই, তাই উৎপাদিত বিদ্যুৎ তাৎক্ষণিকভাবে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করতে হয়। দীর্ঘ সঞ্চালন লাইনের ভেতর কোথাও কোথাও বিকল্প কানেকশনের কারণে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ ন্যাশনাল গ্রিড থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। সাধারণত জাতীয় গ্রিডের আশপাশে বা কাছাকাছি যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলোর অধিকাংশই এমন অনৈতিক কাজে জড়িত।

তার ও ট্রান্সফরমার চুরি : বিদ্যুৎ চুরি করেই ক্ষান্ত থাকছে না সংঘবদ্ধ চোরচক্র। তারা বিদ্যুতের সরঞ্জামাদি পর্যন্ত লুটে নিচ্ছে। শত শত মিটার তার চুরি করে তা পুড়িয়ে তামা বের করছে চোরেরা। ট্রান্সফরমার চুরি করে তা আবার বিদ্যুৎ বিভাগেই সাপ্লাই দিচ্ছে আরেক দল চোর। বাসাবাড়ি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে বৈদ্যুতিক ডিজিটাল মিটারগুলো পর্যন্ত চুরি হয়ে যাচ্ছে যখন-তখন। সেসব মিটার দিয়ে আবার চোরাই সংযোগ লাগানোর ঘটনাও ঘটছে। শুধু এসবের বিল পায় না বিদ্যুৎ বিভাগ।

অনুসন্ধানকালে জানা যায়, গাজীপুরের টঙ্গী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লায় পৃথক পৃথক চোর সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তারাই সারা দেশের বৈদ্যুতিক তার, ট্রান্সফরমারসহ নানা সরঞ্জাম চুরি করে থাকে। টঙ্গী ও ভোগড়া এলাকার দুটি ফ্যান কারখানায় তামার তার সরবরাহ দিতে গড়ে উঠেছে চোর সিন্ডিকেট। অন্যদিকে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে এবং বিভিন্ন শিল্প ইউনিটে আন্তসংযোগ দিতেও পৃথক পৃথক ট্রান্সফরমারের প্রয়োজন পড়ে। এগুলো নতুনভাবে আমদানি করতে লাখ লাখ টাকা খরচ হয়। কিন্তু চোর সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মাত্র কয়েক হাজার টাকার বিনিময়েই একেকটি ট্রান্সফরমার সংগ্রহ করা যায়।

বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি চুরির ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মচারীরা সরাসরি জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। বৈদ্যুতিক লাইন চালু অবস্থায় তার ও ট্রান্সফরমার চুরি করতে হলে বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন। এ ছাড়া গ্রাম থেকে এসব চুরি করতে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মচারীদের প্রয়োজন। বিদ্যুৎ কর্মচারীদের উপস্থিতি থাকলে সাধারণ মানুষ কোনো সন্দেহ করেন না। তারা ভাবেন, হয়তো লাইন মেরামতের কাজ করতেই খুলে নেওয়া হচ্ছে ট্রান্সফরমার। গত তিন মাসেই সারা দেশে সহস্রাধিক ট্রান্সফরমার চুরির ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে গ্রাহকদের।

- সাঈদুর রহমান রিমন, বাংলাদেশ প্রতিদিন

COMMENTS





নাম

অর্থ ও বাণিজ্য,235,আন্তর্জাতিক,731,কাপাসিয়া,342,কালিয়াকৈর,417,কালীগঞ্জ,253,খেলা,644,গাজীপুর,3936,চাকরির খবর,33,জয়দেবপুর,1581,জাতীয়,2958,টঙ্গী,911,তথ্যপ্রযুক্তি,512,ধর্ম,196,পরিবেশ,136,প্রতিবেদন,310,বিজ্ঞান,55,বিনোদন,697,ভিডিও,58,ভিন্ন খবর,142,ভ্রমন,115,মুক্তমত,27,রাজধানী,829,রাজনীতি,1055,লাইফস্টাইল,283,শিক্ষাঙ্গন,398,শীর্ষ খবর,10757,শ্রীপুর,481,সাক্ষাৎকার,12,সারাদেশ,649,স্বাস্থ্য,212,
ltr
item
GazipurOnline.com: গ্যাস-বিদ্যুতে দেড় হাজার কোটি টাকা লুটপাট
গ্যাস-বিদ্যুতে দেড় হাজার কোটি টাকা লুটপাট
http://1.bp.blogspot.com/-sSAwykQjR9w/U0cBlErTEWI/AAAAAAAAG3Q/unbDz7Ocm-U/s1600/gas-electricity.jpg
http://1.bp.blogspot.com/-sSAwykQjR9w/U0cBlErTEWI/AAAAAAAAG3Q/unbDz7Ocm-U/s72-c/gas-electricity.jpg
GazipurOnline.com
https://www.gazipuronline.com/2014/04/gas-electricity.html
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/2014/04/gas-electricity.html
true
13958681640745950
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Read More Reply Cancel reply Delete By প্রচ্ছদ PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share. STEP 2: Click the link you shared to unlock Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy