‘ইন্টারনেটে পূরণ করার পরও ফরম জমা দিতে ঢাকা আসতে হয়। এইডা কিসের ইন্টারনেট? একটা লোকেরও খাওয়া-দাওয়া নাই। জান বাঁচে না। এই লোকটা (মেঝেতে ঘুমানো মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ আলী হকারকে দেখিয়ে) তো ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়েই গেছে। আর এই মহিলা তো ক্ষিধায় বাড়ি থেকে আনা বরুই খাইতাছে। মহিলাদের কষ্ট আরও বেশি। ভিতরে গেলে পুলিশে পারলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। কষ্টের কথা আর কী কমু? এই মন্ত্রণালয় এখন আমাদের কাছে যন্ত্রণালয়।’
এই বর্ণনা চাপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাট উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা মো. জালাল উদ্দিনের।
গত রবিবার বেলা ৩টার দিকে রাজধানীতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিচ তলায় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় জালাল উদ্দিনের। এ দিন ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য সম্বলিত অনলাইনে পূরণ করা সংশোধন ফরম বা নতুন এন্ট্রি ফরম জমা দেওয়ার শেষ দিন।
হবিগঞ্জ থেকে আসা মৃত এক মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী রাজিয়া খাতুন প্রচণ্ড গরমের মধ্যে মন্ত্রণালয়ের নিচে বসে তরমুজ খাচ্ছিলেন। তার এখানে আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাবা আমি আইছি সার্টিফিকেট নিতে। এই নিয়া পাঁচবার আইছি। তুমি পারবা সার্টিফিকেটটা নিয়া দিতে? আর উপরে যাইতে ইচ্ছা করে না। এতো ভিড়ে লিফটে উঠতে পারি না। হাইটা উঠতে-নামতে পা ব্যথা অইয়া গেছে।’
জামালপুরের সরিষাবাড়ি থেকে রবিবার সকালে সংশোধন ফরম জমা দিতে মন্ত্রণালয়ে এসেছেন মৃত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আলীমের স্ত্রী রহিমা বেওয়া। তিনি অনলাইনে ফরম পূরণ করতে পারেননি। ভুল তথ্য সম্বলিত ফরম প্রিন্ট করে অন্য একজনকে দিয়ে হাতে লিখিয়ে নিয়ে এসেছেন। দীর্ঘ দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে কাউন্টারে পৌঁছালে তাকে জানানো হয় হাতে লেখা ফরম জমা নেওয়া হবে না। এরপর তিনি আশপাশের কম্পিউটার কম্পোজের দোকানে গিয়েছেন। কিন্তু অনলাইনে ফরম পূরণ করতে পারেননি। তাই আবার লাইনে দাঁড়িয়েছেন কিন্তু এবারও ফরম জমা নেয়নি।
রহিমা বেওয়া বলেন, ‘আমি কেমনে ফরম জমা দিমু। ইন্টারনেটের দোকানে গেছি। তারা বলে, পূরণ করা যাইব না। এখানে বলে এই ফরম নিব না। তুমি একটু আমার ফরমটা পূরণ কইরা দিবা?’
এরপর এই প্রতিবেদক সঙ্গে থাকা ল্যাপটপ ও মডেম নিয়ে হাওয়া বেওয়ার স্বামীর মুক্তিযোদ্ধা আইডি নিয়ে অনলাইনে ফরম পূরণের চেষ্টা করেও তা পূরণ করতে পারেননি। শুধু হাওয়া বেওয়া নয় অনেকেই অনলাইনে ফরম পূরণ করতে পারেননি। আবার অনেকে বিষয়টি ঠিকমতো বুঝেও না।
শুধু এই তিনজন নয় মন্ত্রণালয়ে অনলাইনে পূরণ করা সংশোধন ফরম বা নতুন এন্ট্রি ফরম জমা দিতে আসা অনেক মুক্তিযোদ্ধা, মৃত মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী বা মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মীয়-স্বজনদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। এ ছাড়াও সনদ নেওয়াসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে আসা অনেককেই ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। মূলত মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনাই মুক্তিযোদ্ধাদের এতো ভোগান্তির কারণ বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
অনলাইন ডাটাবেইজ কার্যক্রম ও ভোগান্তির কারণ
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও একাধিক মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য সম্বলিত খসড়া ডাটাবেইজের বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংশোধন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের সংশোধিত ডাটাবেইজ তৈরি করে মন্ত্রণালয়। একই বছরের ২৩ জুলাই থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত শুধু লাল মুক্তিবার্তার সংশোধিত ডাটাবেইজ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। সে সময় বলা হয়, সংশোধিত ডাটাবেইজের তথ্যে কোনো ভুল থাকলে কম্পিউটার থেকে সংশোধিত ডাটাবেইজ ফরম প্রিন্ট করে তা পুনরায় সংশোধন করে আবেদনকারীর নিজ স্বাক্ষর ও তারিখসহ ই-মেইলের মাধ্যমে অথবা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে পারবেন। মৃত মুক্তিযোদ্ধার ক্ষেত্রে আইনানুগ ওয়ারিশগণ ওই ডাটাবেইজ ফরম পূরণ করে স্বাক্ষর করে একই প্রক্রিয়ায় জমা দিতে পারবেন। পরবর্তী সময়ে ক্রমান্বয়ে গেজেটে অন্তর্ভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা ও সনদপ্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে জানানো হয়।
এরপর আরও একবার ওয়েবসাইটে তালিকা প্রকাশ করে তা পুনরায় সংশোধন করে আবেদনকারীকে ওই প্রক্রিয়ায় জমা দিতে বলা হয়।
সর্বশেষ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘আগামী ২২/০২/২০১৪ তারিখ থেকে হাতে লেখা কোনো প্রকার সংশোধন ফরম বা নতুন এন্ট্রি ফরম গ্রহণ করা হবে না। আবেদনকারীকে অবশ্যই অনলাইনে ফরম পূরণ/সংশোধন করে এবং স্বাক্ষর করে মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে হবে। উল্লেখ্য, আগামী ৩০/০৩/২০১৪ তারিখ পর্যন্ত পূরণকৃত এ সকল ফরম মন্ত্রণালয়ে গ্রহণ করা হবে।’
বিজ্ঞপ্তির কোথাও অনলাইনে আবেদন প্রক্রিয়া ও জমাদান সংক্রান্ত বিষয়ে বিস্তারিত কিছুই জানানো হয়নি। এমনকি সশরীরে না এসে ফরম জমা দেওয়া যাবে কিনা তাও পরিষ্কার করা হয়নি। তা ছাড়া অনলাইনে আবেদন প্রক্রিয়াটি ছিল খুবই ত্রুটিপূর্ণ ও জটিল। কেননা, একজন আবেদনকারী যদি কোনো কারণে প্রথমবারের চেষ্টায় ফরম পূরণ/সংশোধন করতে না পারে তাহলে সে আর দ্বিতীয়বার অনলাইন ডাটাবেইজে প্রবেশ করতে পারবে না। তাছাড়াও কেউ যদি ভুল করে বা ইচ্ছা করে অন্যের মুক্তিযোদ্ধার আইডি দিয়ে ডাটাবেইজে প্রবেশ করে তাহলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আর ডাটাবেইজে প্রবেশ করতে পারবেন না।
এ সব কারণে অনেক মুক্তিযোদ্ধাই অনলাইনে ফরম পূরণ/সংশোধন করতে পারেননি। যারা পেরেছেন তাদের দীর্ঘ লাইনের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ফরম জমা দিতে হয়েছে। আর যারা অনলাইনে ফরম পূরণ/সংশোধন করতে পারেননি তারাও পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মন্ত্রণালয়ে এসে চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য
অনলাইনে ডাটাবেইজ তৈরি কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত মন্ত্রণালয়ের এক সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘ওয়েবসাইট হ্যাপ হাজার্ড হওয়ার আশঙ্কা থেকে আমরা অনলাইন ডাটাবেইজে দ্বিতীয়বার প্রবেশের সুযোগ রাখিনি। তবে ফরম জমা দিতে মন্ত্রণালয়ে আসতে কিন্তু বলা হয়নি। ডাক বা যে কোনো উপায়ে মন্ত্রণালয়ে ফরম পৌঁছাতে পারলেই হবে।’
বিজ্ঞপ্তির কোথাও তো আপনারা ‘যে কোনো উপায়ে মন্ত্রণালয়ে ফরম পৌঁছানো যাবে’ এমন কথা লিখেননি মন্তব্য করলে তিনি বলেন, ‘আরও এক মাস সময় বাড়ানো হবে। এবার লিখে দিব।’
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের অনলাইন সম্পর্কে ধারণা নেই। বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধাকেই কারো না কারো সাহায্য নিয়ে অনলাইনে ডাটাবেইজ ফরম পূরণ করতে হবে। সাহায্যকারীদের দক্ষতার অভাবে প্রথমবারের চেষ্টায় ভুল হতেই পারে। সেক্ষেত্রে অনলাইন ডাটাবেইজে দ্বিতীয়বার প্রবেশের সুযোগ না রাখাটা কতটা যৌক্তিক প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয়বার প্রবেশের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে এবং যারা এখনও ফরম পূরণ করতে পারেননি বা পূরণ করতে গিয়ে ভুল করেছেন তাদের সবাইকে সুযোগ দেওয়া হবে।’
এ প্রসঙ্গে মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী বলেন, ‘অনলাইন ডাটাবেইজ তৈরির বিষয়টি আমি দেখি না। এটি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. আবুল কাসেম তালুকদার দেখেন। আপনি তার কাছে যান। আমি তাকে ফোনে বলে দিচ্ছি। আমি শুধু এতটুকু বলতে পারি যে, আরও এক মাস সময় বাড়ানো হবে।’
যুগ্ম সচিবের কাছে গেলে তিনি তার কক্ষে বসে থাকা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র অ্যাসিসট্যান্ট চিফ ও অনলাইনে ডাটাবেইজ কার্যক্রমের তদারককারী মোহাম্মদ নুরুল আমিন খানকে দেখিয়ে বলেন, ‘বিষয়টি ইনি দেখেন। আমি কিছু বলতে পারবো না।’
নুরুল আমিন খানও এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি না হয়ে বলেন, ‘পুরো বিষয়টি পুনরায় ভেবে দেখা হবে। ইতোমধ্যে মন্ত্রীর নির্দেশে এক মাস সময় বাড়ানো হয়েছে। মানুষের যাতে ভোগান্তি না হয়, সে বিষয়ে আমরা সচেতন। প্রয়োজনে আরও পর্যালোচনা করে অনলাইনে ডাটাবেইজ কার্যক্রম সহজ ও গতিশীল করা হবে। প্রচারণা বাড়ানো হবে। কাউকে আর মন্ত্রণালয়ে এসে ফরম জমা দিতে হবে না। সবাইকে আবারও ফরম পূরণের সুযোগ দেওয়া হবে।’
উল্লেখ্য, বুধবার দুপুর পর্যন্ত নতুন করে কোনো বিজ্ঞপ্তি দেয়নি মন্ত্রণালয়। ডাটাবেইজ পূরণের কার্যক্রমও পুনরায় শুরু করেনি।
প্রতিবেদকঃ সৌরভ রায়
COMMENTS