মৌচাক, গাজীপুর: নৈতিক অবক্ষয়ের উর্ধ্বে উঠে আগামীর নেতৃত্ব গ্রহণে নতুন প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শনিবার নবম বাংলাদেশ ও প্রথম সানসো স্কাউট জাম্বুরী উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তিনি এ আহ্বান জানান।
গাজীপুরের মৌচাকে জাতীয় স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সারা দেশের স্কাউটদের এ মহাসম্মেলনটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। উদ্বোধনস্থল হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান এরিনাকে। সপ্তাহব্যাপী এ জাম্বুরীর এবারের প্রতিপাদ্য 'শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য স্কাউটিং'।
এ উদ্বোধন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে শিশু-কিশোরদের আনন্দ যেন আর বাধ মানছিল না। থেকে থেকেই উচ্ছ্বাস-মেশানো হর্ষধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠছিল তারা। গাজীপুরের মৌচাকে জাতীয় স্কাউট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র মাঠে বীরশ্রেষ্ঠদের নামখচিত শামিয়ানা ঘেরা স্থানগুলোর মাঝ বরাবর নির্মাণ করা হয়েছিল মঞ্চ।
সকাল ৯টা থেকেই মঞ্চের আশেপাশে একত্র হতে থাকে সবাই। সূর্যের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে চলছিল প্রতীক্ষার পালা-কখন আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। অবশেষে এল সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। ঘড়ির কাটায় তখন ঠিক ১০টা। মঞ্চ আলোকিত করে আসন গ্রহণ করলেন প্রধানমন্ত্রী।
জাম্বুরীতে অংশগ্রহণকারী দেশী ও সার্কভুক্ত দেশসমূহের স্কাউটসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে স্বাগত জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছেলে-মেয়েদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে স্কাউট আন্দোলনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আত্মমর্যাদায় বলিয়ান স্কাউটরা দেশ সেবায় নিজেদের বিলিয়ে দেয়। তারা সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা, বৃক্ষরোপন, স্যানিটেশন, ইপিআই কর্মসূচি ও পরিবেশ সচেতনতায় নিরলসভাবে কাজ করে। স্কাউটরা তাদের বিভিন্ন কার্যক্রম দিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছে। তারা প্রমাণ করছে যে, তারা বিশ্বাসী, বন্ধুবৎসল, বিনয়ী ও সকল জীবের প্রতি সদয়।
তিনি বলেন, এবারের জাম্বুরী থিম 'শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য স্কাউটিং' অত্যন্ত সময়োপযোগী। তিনি স্কাউটদের জাতীয় শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নে আত্মনিয়োগের আহবান জানান।
দেশব্যাপি বিগত পাঁচ বছরে স্কাউটদের সাথে বিভিন্ন স্বাস্থ্য ক্যাম্প, বিদ্যুৎ ক্যাম্প প্রভৃতিতে অংশগ্রহণের কথা স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ স্কাউটস গার্ল-ইন-স্কাউটিং কার্যক্রমের ২০ বছর পূর্তি এবং তাদের সংখ্যা দেড় লক্ষাধিক হওয়ায় বাংলাদেশ স্কাউটসকে তিনি আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
তিনি বলেন, গাজীপুরের মৌচাকে স্কাউটদের এই জাতীয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সার্বিক উন্নয়নে তার সরকার সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। স্কাউটদের নিয়মিত বিদ্যুৎ ও স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক ক্যাম্প আয়োজনের আহবান জানান তিনি।
ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য নিজেদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বহির্বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বশেষ কলা-কৌশল রপ্ত করে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজে স্কাউটগণ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবে বলে আমি আশা করি।
এর আগে বাংলাদেশ স্কাউটসের সভাপতি মো. আবদুল করিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ স্কাউটসের প্রধান জাতীয় কমিশনার ও জাম্বুরী চীফ মো. আবুল কালাম আজাদ ও জাম্বুরী সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন, এনডিসি।
প্রধানমন্ত্রী জাম্বুরীর আনুষ্ঠানিক শান্তির পায়রা ও রঙিন বেলুন উড়িয়ে জাম্বুরীর উদ্বোধন ঘোষণা করেন। উদ্বাধন শেষে আয়োজিত সাংস্কৃতিক পর্বে গাজীপুর, রংপুর, খুলনা, শরিয়তপুর কন্টিনজেন্টের সদস্যরা নিজ নিজ এলাকার কৃষ্টি, ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি তুলে ধরে।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে জাম্বুরীর তাঁবু এলাকা পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী।
সার্কভুক্ত দেশগুলোর সমন্বয়ে এবারই প্রথম সার্ক ন্যাশনাল স্কাউট অরগানাইজেশনস (সানসো) জাম্বুরী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এছাড়া মেয়েদের স্কাউটিং তথা 'গার্ল-ইন-স্কাউটিং'-এর ২০ বছর পূর্তি উদযাপন করা হচ্ছে জাম্বুরীর উদ্বোধনী দিনেই। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।
এবারের জাম্বুরীতে সারা দেশের প্রায় ১৩ লক্ষ স্কাউটের মধ্য থেকে নির্বাচিত প্রায় সাড়ে আট হাজার স্কাউট, স্বেচ্ছাসেবক ও স্কাউট কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ভারত, শ্রীলংকা ও ভুটান থেকে অংশ নিয়েছে ২৭জন স্কাউট ।
অংশগ্রহণকারী স্কাউটরা জাম্বুরীতে যুগোপযোগী বিভিন্ন ভিলেজ ও সাব ক্যাম্পভিত্তিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজেদের যোগ্যতা যাচাই, অভিজ্ঞতা বিনিময়, বন্ধুত্ব স্থাপন ও নিজেকে সুযোগ্য করে গড়ে তোলার সুযোগ লাভ করবে।
এবারের জাম্বুরীটি আকর্ষণীয়, উদ্দীপনামূলক, শিক্ষণীয় ও প্রতিযোগিতামূলক নানা অনুষ্ঠানের সমন্বয়ে সাজানো হয়েছে। চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকছে ১৩টি 'অ্যাডভেঞ্চার'।
এবার নতুন অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে যোগ হয়েছে 'পানিতে খেলা' ও 'প্রত্যাশা'। এছাড়া 'আমার বিশ্ব আমার ঐতিহ্য' অ্যাডভেঞ্চারটি নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপিত হবে। সুষ্ঠুভাবে জাম্বুরীটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এবার ১০টি সাব ক্যাম্প ও পাঁচটি ভিলেজ গঠন করা হয়েছে।
জাম্বুরীর এ অনুষ্ঠানগুলোতে জাতীয় সংসদের স্পীকার, মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, সচিবসহ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকবেন।
স্কাউটিং বিশ্বব্যাপী একটি অরাজনৈতিক ও স্বেচ্ছাসেবামূলক আন্দোলন। শিশু, কিশোর ও যুবাদের জন্য প্রচলিত শিক্ষার পাশাপাশি স্কাউটিং একটি সম্পূরক শিক্ষা ব্যবস্থা। শিশু, কিশোর ও যুবাদের আত্মা মর্যাদাবান, আত্মনির্ভরশীল, সৎ, চরিত্রবান, দৃঢ় মনোবলসম্পন্ন ও অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে স্কাউটিং।
স্কাউট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট স্টিফেনসন স্মিথ লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল অব গিলওয়েল। বিশ্বব্যাপী তিনি 'বিপি' হিসেবে সমধিক পরিচিত।
স্কাউটদের সবচেয়ে বড় শিক্ষামূলক মহাসমাবেশ হলো জাম্বুরী। এতে স্কাউটরা বিশ্ব ভ্রাতৃত্বে উজ্জীবিত হয়ে একে অপরের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় ও বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায়। এখানে প্রত্যেক জেলা ও ইউনিট থেকে আগত স্কাউটরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগদানের মাধ্যমে নিজেদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব উপস্থাপনের মাধ্যমে দক্ষতা ও নৈপুণ্য প্রদর্শন করে।
এবারের জাম্বুরীর সমাপনী আয়োজন অনুষ্ঠিত হবে ১০ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
COMMENTS