আদম মালেক: অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে দেশের বাম রাজনীতি। অতীতে আন্দোলন-সংগ্রামে অবদান থাকলেও এখন জাতীয় রাজনীতিতে অনেকটা গুরুত্বহীন। দিন দিন কমছে জনসমর্থন। সেই সঙ্গে নিজেদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য পূরণে অনেকাংশেই ব্যর্থ।
শ্রেণী বৈষম্যের বিরুদ্ধে বললেও তাদের কেউ কেউ ধনিক শ্রেণী বা সরকারের লেজুড় হিসেবে কাজ করছে। কেউ সরকারে নেই, কিন্তু নামমাত্র আওয়ামী লীগের শরিক। কেউ আবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বিদলীয় বৃত্তের বাইরে আলাদা জোট করে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। কেউ আবার কিছু করতে না পেরে নিজেদের মতো করে টিকে থাকার সংগ্রাম করছে।
যে যেখানেই থেকে যাই করুক না কেন, ভালো নেই তারা। সাড়া মিলছে না তাদের সদস্য সংগ্রহ অভিযানে। নিষ্ক্রিয় অঙ্গসংগঠন। বাম নেতাদের বক্তব্য, আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্য থাকলেও সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করবেন তারা। সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে কথা বলবেন। তবে সরকারি দলের টেন্ডার, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ কোনো কিছুর দায় নিতে রাজি নয় বাম ঘরনার নেতারা।
তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপির সঙ্গে দেশের বাম রাজনৈতিক দলগুলোর লক্ষ্য উদ্দেশ্যের মিল নেই। তাই তাদের সঙ্গে কোনো আদর্শিক জোট হতে পারে না। বর্তমান সরকারের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বাম রাজনৈতিক দল যুক্ত থাকায় সাধারণ মানুষের পক্ষে কথা বলার শক্তি কমে আসছে। দেশে বাম রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সব মিলিয়ে দল পরিচালনায় আর্থিক সঙ্কট, জনসমর্থন কমতে থাকাসহ আভ্যন্তরীণ মতবিরোধসহ দল টিকিয়ে রাখাই বাম রাজনীতিকদের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
এদিকে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম প্রধান দুই শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) দুই শীর্ষ নেতা রাশেদ খান মেনন এবং হাসানুল হক ইনুকে মন্ত্রী করা হয়। তবে জনমত উপেক্ষা করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় ওয়াকার্স পার্টিতে চরম মতবিরোধ শুরু হয়। এজন্য ওয়াকার্স পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন দলের কেন্দ্রীয় সদস্য রাগিব আহসান মুন্না ও মোজাম্মেল হক তারা।
এ ব্যাপারে রাগিব আহসান মুন্না বলেন, ‘অনেক ত্যাগের বিনিময়ে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ অর্জিত হয়েছে। কিন্তু একতরফা নির্বাচনে ওয়াকার্স পার্টির অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মধ্য দিযে সে অর্জন ও আদর্শ ধুলিস্যাৎ হয়।’
এছাড়া ১৪ দলের আরেক শরিক সাম্যবাদী দলের (এমএল) শীর্ষ নেতা দিলীপ বড়ুয়া আওয়ামী লীগ নেতৃত্বধীন মহাজোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী ছিলেন। টানা পাঁচ বছর মন্ত্রী থাকা সত্ত্বেও দলের নেতাকর্মীদের তেমন একটা খোঁজ খবর নেননি তিনি। এমনকি দলীয় কার্যালয়েও তাকে খুব একটা দেখা যায়নি ওই সময়ে। আওয়ামী লীগ সরকারের এবারের মন্ত্রিসভায়ও জায়গা পাবেন- এমন আশায় ছিলেন দিলীপ বড়ুয়া। কিন্তু তা না পেয়ে তিনি হতাশ ও ক্ষুব্ধ। মন্ত্রী থাকাকালে দিলীপ বড়ুয়ার সঙ্গে দলের অনেকের যে মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল তা এখনও বজায় আছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে দলীয় কর্মকাণ্ডেও।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাম্যবাদী দলের এক নেতা বলেন, ‘পাটি প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ তোয়াহাকে জিয়াউর রহমান প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব দিয়েছেন কিন্তু তোয়াহা সাহেব সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। দিলীপ বড়ুয়া আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট ও মন্ত্রীত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে নীতি নৈতিকতা ও আদর্শকে বিসর্জন দিয়েছেন। পাটিটা ভেঙ্গে দেব। এখন পারিছ না, দিলীপ বড়ুয়ার পক্ষে পুলিশ আছে।’
১৪ দলের শরিক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-মোজাফফর), গণতন্ত্রী পার্টি, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণ-আজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি ও বাসদের একটি অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটে থাকলেও সরকারে নেই। নবম জাতীয় সংসদে ন্যাপ থেকে আমেনা আহমেদ এবং গণতন্ত্রী পার্টি থেকে রুবী রহমানকে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য করা হয়। এবার ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি এবং জাসদ ছাড়া আর কাউকেই কিছু দেয়নি আওয়ামী লীগ। ফলে বঞ্চনা ও হতাশায় ভুগছে বাকি দলগুলো। শক্তি-সামর্থ্যের কঠিন সীমাবদ্ধতা, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে এসব দলের নেতৃত্বের বিরোধ ও আর্থিক টানাপোড়েন।
এ প্রসঙ্গে গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড মোশারেফা মিশু বলেন, ‘হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন ও দিলীপ বড়ুয়া সারাজীবন আওয়ামী লীগের বিরোধীতা করেছেন। আবার তারা সেই সরকারের মন্ত্রীও হয়েছেন। তারা বিশ্বাসঘাতক। মানুষ তাদের বিশ্বাস করে না। তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। গণতান্ত্রিক বামমোর্চা সরকারের পদলেহী নষ্টভ্রষ্ট বাম নেতাদের প্রতিহত করে নিজেদের লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যাবে।’
দেশের অন্যতম প্রধান দুটি বাম ঘরানার রাজনৈতিক দল সিপিবি ও বাসদ। তারাও জোট-মহাজোট এই দ্বিদলীয় মেরুকরণের বাইরে স্বতন্ত্র অবস্থা বজায় রেখে বাম বিকল্প শক্তি হিসেবে নিজেদের অবস্থান গড়ে তুলে তা সুসংহত করার জন্য বেশ কিছুদিন যুগপৎ আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাচ্ছে। সিপিবির অভ্যন্তরীণ সঙ্কট তেমন না থাকলেও সম্প্রতি বাসদ থেকে একটি অংশ বেরিয়ে গেছে। তারা প্রায় একই নাম নিয়ে সম্পৃক্ত হয়েছে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সঙ্গে। যার ফলে সিপিবি ও বাসদের পথচলা কিছুটা হলেও বিঘ্নিত হয়েছে।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান বলেন, ‘আমরা বিএনপি-আওয়ামী লীগের জোট মহাজোটের বাইরে একটি বিকল্প শক্তি তৈরির চেষ্টা করছি। এই গণবিরোধী দুর্বৃত্ত সরকারের কবল থেকে মানুষ মুক্তি চায়। সিপিবি-বাসদ জোট মানুষের আশা আকাঙ্খা পূরণে সক্ষম।’
COMMENTS