আল আমীন দেওয়ান: বাংলাদেশ ব্যাংকের ইক্যুইটি অ্যান্ড এন্টারপ্রেনারশিপ ফান্ডের (ইইএফ) প্রায় সাড়ে ১৯ কোটি টাকা নিয়ে দীর্ঘ প্রায় এক যুগেও ফেরত দেননি তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ১৫ ব্যবসায়ী। ঋণ খেলাপির এ তালিকায় বাংলাদেশ অ্যাসেসিয়েশন অব ইনফরমেশন অ্যান্ড সফটওয়্যার সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক দুই সভাপতিও রয়েছেন।
ইইএফ নামে পরিচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এ পুন:অর্থায়ন তহবিল থেকে বিনা সুদে বড় অংকের ঋণ নেওয়ার পর সাত থেকে ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও এসব ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো অর্থ পরিশোধে গা করছে না। ঋণ খেলাপি এসব কোম্পানির বেশিরভাগই এক টাকাও পরিশোধ করেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব ঋণের ব্যবস্থাপক আইসিবি বিভিন্ন মেয়াদে কিস্তি আদায়ের চেষ্টা করেও সক্ষম হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে অর্থ আদায় না হওয়ার পেছনে সরকারি এ সংস্থার কিছু কর্মকর্তার যোগসাজস রয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ঋণ খেলাপির তালিকায় থাকা কার্যক্রমবিহীন সাত কোম্পানি হলো- ফার্মগেটের ঠিকানায় এস এম রেদোয়ানে মালিকানাধীন আরাফাত ইনফরমেশন টেকনোলজিস অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিকস লিমিটেড (৮০ লাখ টাকা), ঢাকার ঠিকানায় মো. সাইফুল ইসলামের মালিকানাধীন মেস্ট্রো প্রাইভেট লিমিটেড (২৩ লাখ টাকা), মোহাম্মপুরের ঠিকানায় মাহমুদুল হাসানের আই জেন সফটওয়্যার লিমিটেডের (৯৫ লাখ টাকা), ধানমন্ডির জাহেদ মান্নান সুমনের ফাইভ এম ইনফোটিচ লিমিটেডের (৫০ লাখ টাকা), উত্তরার আবদুল্লাহ আল মামুনের অ্যাস্টেরয়েড সিস্টেমস লিমিটেড (৮৪ লাখ টাকা), ধানমণ্ডির ঠিকানায় মালিকের নাম ছাড়া ডাটা এজ লিমিটেড (২০ হাজার টাকা) এবং নো ভিশন লিমিটেড (এক হাজার টাকা)।
আংশিক অপারেশনে থাকা দুই কোম্পানি হলো বেসিসের সাবেক সভাপতি সরওয়ার ই আলমের দি ডেকোড লিমিলেড (৭ কোটি ৮৬ লাখ) এবং গুলশানের খন্দকার ইমরুল হাসানের স্পেইল ম্যাক্রোসফ লিমিটেড (৫২ লাখ ৬৬ হাজার টাকা)।
বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালু থাকা ছয় কোম্পানি হলো- বেসিসের সাবেক সভাপতি হাবিবুল্লাহ এন করিমের টেকনোহ্যাভেন কোম্পানি লি (২ কোটি টাকা), কাওরানবাজারের মোহাম্মদ মনির হোসেনের ইলেক্ট্রো ক্রাফট কর্পোরেশন লিমিটেড (৫৩ লাখ ৭৭ হাজার টাকা), সিলেটের মিফতা উল ইসলামের এক্সপার্ট কম্পিউটার সিস্টেম লিমিটেড (৬০ লাখ টাকা), চট্টগ্রামের জামাল উদ্দিনের মাল্টি মাইক্রোটেক সলিউশন লিমিটেড (৯০ লাখ টাকা), গুলশানের ওয়াসিম চৌধুরীর রিলেইসোর্স টেকনোলজি লিমিটেড (২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা) এবং কাওরান বাজারের সাঈদ শাপীর খাসরীর এক্স নেট লিমিটেড (৭৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা)।
ইইএফের আওতায় এ পর্যন্ত মোট ৬৭ তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ক কোম্পানিকে প্রকল্পভিত্তিক ঋণ দেওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ঋণ পরিশোধের সর্বোচ্চ মেয়াদ ৮ বছর পরেও অর্থ পরিশোধ করেনি এমন কোম্পানির সংখ্যা ২৫টি। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি কোম্পানির ঋণ নেওয়ার পর প্রায় ১২ বছর পার হলেও এক টাকাও অর্থ পরিশোধ করা হয়নি। ঋণ নেওয়ার পর সাত থেকে আট বছর পার হয়েছে এমন কোম্পানি ৩টি।
অন্যদিকে ১৩টি কোম্পানি ঋণের অর্থ নেওয়ার পর উধাও হয়ে গেছে। এখন এগুলোর অস্তিত্বহীন কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। আইসিবির রিকভারি বিভাগ সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়েও এগুলোকে খুঁজে পায়নি। রোববার এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এ কোম্পানিগুলোর মধ্যেও বেসিসের সদস্য তিনটি কোম্পানি রয়েছে।
এদিকে পরিদর্শনকালে বাকি ১৫ কোম্পানির মধ্যে ৭টির কোনো কার্যক্রম নেই, ২টি আংশিক চালু আছে এবং ছয়টি কোম্পানি বাণিজ্যিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
ঋণ খেলাপি এসব কোম্পানি বিএনপি জোট সরকারের সময় ২০০৩ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে ইইএফ থেকে ঋণ নিয়েছিল।
দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ইইএফ তহবিলের আওতায় কয়েকটি খাতে বিনা সুদে ঋণ দিয়ে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এ ঋণ ব্যবস্থাপনার কাজ করে থাকে।
ইইএফের নিয়ম অনুযায়ী বিনাসুদের এ ঋণ কোম্পানি ও উদ্যোক্তাদের কয়েকটি কিস্তিতে তিন বছরে প্রদান করা হয়। পঞ্চম বছর থেকে আইসিবির কাছে রক্ষিত সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ার কয়েক কিস্তিতে বাইব্যাক করার মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করার কথা। আর আট বছরে ঋণের পুরো অর্থ শেয়ার বাইব্যাক করে পরিশোধের কথা। কিন্তু ২৮টি কোম্পানি অর্থ পরিশোধ করেনি।
২০০৪-০৫ মেয়াদে বেসিসের সাবেক সভাপতি সরওয়ার ই আলমের মালিকানাধীন দি ডেকোড লিমিলেড ২০০৩ সালের ৩১ মার্চ ৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা নিয়েছে। যার মধ্যে মাত্র ৫ লাখ টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। কোম্পানীটি ৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ফেরত দেয়নি।
এ বিষয়ে সরওয়ার ই আলম বলেন, আইসিবিকে তখনই আমার কোম্পানির ৪৯ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে টাকাটা তুলে নিতে বলেছিলাম। বর্তমানে ব্যবসায়িক অবস্থা খারাপ হওয়ায় এ অর্থ পরিশোধে আমি সক্ষম নই। তবে জুনের পর থেকে অল্প অল্প করে এ অর্থ পরিশোধ করে দিতে পারার আশা প্রকাশ করেন তিনি।
কানাডিয় এক কোম্পানির প্রতারণায় কোটি কোটি টাকা লোকসানে পরেছেন জানিয়ে এ ব্যবসায়ী বলেন, “দেশের আইসিটির উন্নয়নে কাজ করতে গিয়ে দেউলিয়া হয়ে গেলাম। জীবনে কখনও অসততা করিনি। বাকি অর্থও শোধ করে দেব।”
২০০৮-২০০৯ মেয়াদে বেসিসের সভাপতি হাবিবুল্লাহ এন করিমের মালিকানাধীন টেকনোহ্যাভেন কোম্পানি লিমিটেড ২০০৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বরে নিয়েছে ২ কোটি টাকা। এর এক টাকাও ফেরত দেওয়া হয়নি।
যদিও আইসিবিরি ঋণ প্রদানের সময় কোম্পানিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দেখানো হয়েছে মিসেস রোকেয়া হককে। হাবিবুল্লাহ এন করিম এ কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর।
হাবিবুল্লাহ এন করিম এ বিষয়ে বলেন, পুরো ঋণের অর্থ প্রদান না করে আইসিবিই ‘ডিফল্টার’ হয়েছে। তারা যে টাকা দেওয়ার কথা ছিল তা দেয়নি।
এ বিষয়ে আইসিবির উপ-মহাব্যবস্থাপক টিপু সুলতান ফারাজী বলেন, ইইএফের টাকা কয়েক ধাপে দেয়া হয়। কেউ টাকা নিয়ে কাজ করছে কিনা তা দেখে পরের ধাপের টাকা দেয়া হয়। কেউ কাজ না করলে ঋণের পরের কিস্তি স্বাভাবিকভাবেই আটকে যায়। টেকনোহ্যাভেনের ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন।
আইসিবির নথিতে দেখা যায়, টেকনোহ্যাভেনের ইইএফ ইক্যুইটি ছিল ২ কোটি ৮৮ লাখ ২০ হাজার টাকা। কোম্পানিটি পেয়েছে ২ কোটি টাকা।
সাবেক দুই সভাপতির অর্থ পরিশোধ না করার বিষয়ে জানতে চাইলে বর্তমান বেসিস সভাপতি শামীম আহসান জানান, এই দুই সাবেক সভাপতির ব্যবসায়িক সততার সুনাম রয়েছে। তারা পরিস্থিতির শিকার। দেশের আইসিটির উন্নয়নে তারা নিবেদিত হয়ে কাজ করেছেন।
সৌজন্যেঃ টেকশহর
COMMENTS