চাওয়ালা থেকে প্রধানমন্ত্রী

তাঁকে ঘিরে অবিশ্বাস ছিল, ছিল দাঙ্গার কলঙ্ক আর ঘৃণা ৷ তারপরও তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনসমর্থন নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন ডানপন্থি নেতা নরেন্দ্র মোদী, কৈশরে যাঁর অনেকটা সময় কেটেছে রেলস্টেশনে চা বিক্রি করে ৷ উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টির এই নেতা গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন সেই ২০০১ সাল থেকে ৷ তাঁর গতিশীল নেতৃত্বে গুজরাট পরিণত হয়েছে ভারতের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিতে ৷ কৌশলী প্রচার মোদীকে দিয়েছে উন্নয়নের অগ্রদূতের ভাবমূর্তি, বিপুল জনসমর্থন ৷

অবশ্য ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় উসকানি দেয়ার অভিযোগ কখনোই হয়ত মোদীর পিছু ছাড়বে না৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন, যাঁদের অধিকাংশই মুসলমান৷

সাম্প্রদায়িক আদর্শের কারণে ভোটারদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের সমর্থন মোদী পাননি৷ কিন্তু নির্বাচনের আগে দিল্লিকেন্দ্রিক রাজনীতির পুরনো ছক ভেঙে পরিবর্তনকামী তারুণ্যের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি ছিনিয়ে এনেছেন বড় জয়৷ গুজরাটের এক ঘাঞ্চি পরিবারের সন্তান নরেন্দ্র মোদী দিল্লি চলেছেন ভারতের চতুর্দশ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে৷

আরএসএস থেকে মুখ্যমন্ত্রী
জন্ম ১৯৫০ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর৷ পারিবারিক নাম নরেন্দ্র দামোদারদাস মোদী৷ ছয় ভাইবেনের মধ্যে তৃতীয় মোদী স্কুলজীবনে ছাত্র হিসাবে ছিলেন মাঝারি মানের৷ তবে সেই সময়ই বিতর্ক আর থিয়েটারে ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ, যার প্রভাব তাঁর রাজনৈতিক জীবনেও স্পষ্ট৷

কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন মোদী ৷ পরে কাজ করেছেন গুজরাট রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটির ক্যান্টিন বয় হিসাবে৷ নির্বাচনের আগে তাঁর এই অতীত টেনে এনে কংগ্রেস শিবির থেকে অপপ্রচার চালানো শুরু করলেও মোদীর জন্য তা শাপে বর হয়েছে ৷ তাঁর প্রার্থীতাকে সমর্থন দিয়ে মনোনয়নপত্রে সই করেন এক চাওয়ালা, যা তাঁকে শ্রমজীবী ভোটারদের নজর কাড়তে সাহায্য করে ৷

ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী, ১৭ বছর বয়সেই যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে বিয়ে হয় মোদীর৷ তাঁর জীবনীকার নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য অনুযায়ী, সেই সংসার ছিল মাত্র তিন বছরের, শারীরিক সম্পর্কও তাঁদের ছিল না৷

একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে আট বছর বয়স থেকেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মোদী৷ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাওয়ার সময়ও তিনি প্রচারক হিসাবে আরএসএস-এর সঙ্গে ছিলেন৷

১৯৭১ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর আনুষ্ঠানিকভাবে আরএসএস-এ যুক্ত হন, উগ্র সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডের কারণে যে সংগঠনটি এ পর্যন্ত তিন দফা নিষিদ্ধ হয়েছে৷ ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৫ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে ধরপাকড় শুরু করলে আত্মগোপনে যান মোদী৷ এর দশ বছর পর আরএসএস-এর সিদ্ধান্তে ভারতীয় জনতা পর্টির হয়ে কাজ শুরু করেন তিনি৷

১৯৯৫ সালের রাজ্যসভা নির্বাচনে মোদী ছিলেন বিজপির অন্যতম কৌশলপ্রণেতা, তখন তিনি দলের গুজরাট শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক৷ সেই সাফল্যের পর অন্যান্য নির্বাচনেও তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৯৮ সালে দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান৷

২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী৷ এরপর আরো তিন দফা তিনি ওই পদে বিজয়ী হয়েছেন, গুজরাটকে পরিণত করেছেন উন্নয়নের মডেলে৷

গুজরাটের দাঙ্গা, হিন্দুত্ববাদ
২০০২ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি গোধরা স্টেশনে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বহনকারী একটি ট্রেনে আগুন দেয়া হলে ৫৯ জনের মৃত্যু হয়৷ ওই ঘটনার জন্য মুসলমানদের দায়ী করে গুজরাটে ব্যাপক হামলা, অগ্নসংযোগ চালায় হিন্দুত্ববাদীরা৷ টানা কয়েক দিনের দাঙ্গায় এক হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়৷

মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি নিজে কখনো ওই অভিযোগ স্বীকার করেননি৷ আদালতও তাঁকে অভিযোগ থেকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে পরবর্তী সময়ে রাজ্যসভা নির্বাচনে মোদী কার্যত দাঙ্গার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন এবং হিন্দুত্ববাদের ধুঁয়া তুলে ছিনিয়ে নিয়েছেন জয়৷

ওই দাঙ্গার পর ভারত ও ভারতের বাইরে মোদীর ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ণ হয়৷ যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ভিসা দিতে অস্বীকার করে এবং যুক্তরাজ্যের সঙ্গেও তিক্ততা তৈরি হয়৷ এই প্রেক্ষাপটে একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে কৌশলী প্রচার শুরু করেন তিনি৷

২০০৭ সালের পর তিনি নিজেকে তুলে ধরতে শুরু করেন একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী'৷ আর এই চেষ্টায় তিনি যে পুরোপুরি সফল, তার প্রমাণ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন৷

তারুণ্যে কুর্নিশ, অভিনব প্রচার
গত বছর জুনে বিজেপি যখন প্রধানমন্ত্রী পদে তাঁদের প্রার্থী হিসাবে নরেন্দ্র মোদীর নাম ঘোষণা করে, এনডিএ জোটের অন্যতম শরিক জনতা দল (ইউনাইটেড) নিজেদের সরিয়ে নেয় এই আশঙ্কায় যে, মোদীই হয়ত নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ হবেন৷

তবে সব আশঙ্কাকে মোদী মিথ্যা প্রমাণ করেছেন তরুণদের আস্থা অর্জনের মধ্য দিয়ে৷ দলের প্রার্থী মনোনীত হওয়ার পরপরই তিনি ভারতের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অগ্রসর তরুণদের সঙ্গে বসেন এবং নির্বাচনি প্রচারের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন৷ এর মধ্য দিয়ে মোদী কার্যত বিজেপির দিল্লিকেন্দ্রিক নেতৃত্ব কাঠামোকে প্রত্যাখ্যান করে ভারতীয় তারুণ্যের পরিবর্তনকামী মানসিকতাকেই কুর্নিশ করেন৷ হলোগ্রাম থেকে হোয়াটসঅ্যাপ – সর্বত্র চলে মোদীর পক্ষে অভিনব প্রচার৷

ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ হাজার হাজার কর্মী সমর্থক মোদীর মুখোশ পরে এ সব জনসভায় হাজির হয়েছেন৷ সারা ভারতে এক হাজার স্টল থেকে ভোটারদের মাঝে বিলি করা হয়েছে ‘মোদী চা'৷

কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হলেও এবারের নির্বাচনে হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন মোদী৷ যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷

নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি পুরো ভারতকে বদলে দেবেন৷ ভারতকে কখনও মাথা নোয়াতে দেবেন না৷

অবশ্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী মোদীর সমালোচনাও ছিল অনেক৷ বলা হয়েছে, তিনি স্বৈরাচারী মেজাজে দল চালাতে চান, প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতি মানেন না৷ মোদীর শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে বিরোধী শিবিরে৷ বলা হয়েছে, দাঙ্গার কলঙ্ক আড়াল করতেই মোদী উন্নয়নের ফাঁপা বুলি আওড়াচ্ছেন৷

সব কিছুর পরও নির্বাচনে অভাবনীয় জনসমর্থন পেয়েছে বিজেপি, ভরাডুবি হয়েছে গান্ধী পরিবারের প্রতাপ আর ভারতীয় কংগ্রেসের৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বেই তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে ধর্মভিত্তিক দলটি৷

সূত্রঃ রয়টার্স, এএফপি, এপি

COMMENTS





নাম

অর্থ ও বাণিজ্য,235,আন্তর্জাতিক,731,কাপাসিয়া,342,কালিয়াকৈর,417,কালীগঞ্জ,253,খেলা,644,গাজীপুর,3936,চাকরির খবর,33,জয়দেবপুর,1581,জাতীয়,2958,টঙ্গী,911,তথ্যপ্রযুক্তি,512,ধর্ম,196,পরিবেশ,136,প্রতিবেদন,310,বিজ্ঞান,55,বিনোদন,697,ভিডিও,58,ভিন্ন খবর,142,ভ্রমন,115,মুক্তমত,27,রাজধানী,829,রাজনীতি,1055,লাইফস্টাইল,283,শিক্ষাঙ্গন,398,শীর্ষ খবর,10757,শ্রীপুর,481,সাক্ষাৎকার,12,সারাদেশ,649,স্বাস্থ্য,212,
ltr
item
GazipurOnline.com: চাওয়ালা থেকে প্রধানমন্ত্রী
চাওয়ালা থেকে প্রধানমন্ত্রী
http://1.bp.blogspot.com/-yxWCkAlR_OQ/U3aBiNhYLlI/AAAAAAAAHc4/D0sdKJhw8Ro/s1600/modi.jpg
http://1.bp.blogspot.com/-yxWCkAlR_OQ/U3aBiNhYLlI/AAAAAAAAHc4/D0sdKJhw8Ro/s72-c/modi.jpg
GazipurOnline.com
https://www.gazipuronline.com/2014/05/modi.html
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/2014/05/modi.html
true
13958681640745950
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Read More Reply Cancel reply Delete By প্রচ্ছদ PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share. STEP 2: Click the link you shared to unlock Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy