নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনার পর অবসরে পাঠানো র্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদসহ তিন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। দণ্ডবিধি বা বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া না গেলে ৫৪ (অপরাধ সংগঠনে সন্দেহ হলে) ধারায় গ্রেপ্তার করতে বলা হয়েছে। বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে রবিবার এ আদেশ দেন।
এদিকে হাইকোর্ট এই আদেশ দেয়ার পরপরই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, তিন র্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখনও নির্দেশনা পাইনি। ওই নির্দেশনার কপি হাতে পেলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। ওই নির্দেশনায় যা থাকবে, তাই করা হবে। তবে তদন্ত চলাকালে এ রিটটি না করলেও পারত বলে মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ৩ কর্মকর্তা নজরদারিতে রয়েছেন। যে কোনো সময় তাদের গ্রেপ্তার করা হতে পারে। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সুত্র দাবি করেছে, এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত হাইকোর্টের আদেশ মন্ত্রণালয়ে পৌঁছেনি। র্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মুহাম্মদ ছাড়া অন্য দুই র্যাব কর্মকর্তা হলেন- মেজর আরিফ হোসেন ও নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পের সাবেক প্রধান লে. কমান্ডার এম এম রানা। তিন কর্মকর্তার মধ্যে সেনাবাহিনীর দুজনকে অকালীন এবং নৌবাহিনীর একজনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়। গত ৬ মে সেনা দপ্তর ও নৌবাহিনী সদর দপ্তর থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। অবসরের পর তারা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন বলে জানা গেছে।
র্যাব কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের নির্দেশনার পাশাপাশি ?দুটি রুলও জারি করেছে আদালত। রুলে পুলিশ, র্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেশাগত কার্যক্রম সম্পর্কিত আইন সংশোধন ও হালনাগাদ করার বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনা করতে কেন নির্দেশনা দেয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় আইনের ঘাটতি সংশোধনে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়। দুই সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, জনপ্রশাসন সচিব ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
আদেশের পর ওই বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার বলেন, এর আগে হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ এ ব্যাপারে আদেশ দিয়েছিল। সে সময় ওই তিন কর্মকর্তাকে বরখাস্তের বিষয়টা থাকলে ওই বেঞ্চই তাদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিতো। আমরা নতুন করে এ বিষয়ে আদেশ দিলাম। কারণ কিছু পাওয়া না গেলে তো তাদের বরখাস্ত করা হতো না। আদালত বলেছেন, ইতিপূর্বে হাইকোর্টের যে বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেছেন, সেই বেঞ্চেই একসঙ্গে বিষয়টির শুনানি হবে
সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকাররক্ষায় ব্যর্থতা চ্যালেঞ্জ করে নিহত বা খুনের শিকার আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল, আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী সংগঠনের পক্ষে নির্বাহী সভাপতি মাহবুবুর রহমান ও নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন রবিবার রিট আবেদন করেন। রিটে সাতজনকে অপহরণের পর খুনের ঘটনার তদন্ত প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ড. কামাল হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্তি অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আল আমিন সরকার। শুনানিকালে আদালত রিট আবেদনটি সুস্পষ্ট করে দিতে বলেন। তাত্ক্ষণিক আবেদনকারীপক্ষ তা সংশোধন করে দেন।
শুনানিতে ড. কামাল হোসেন বলেন, র্যাবকে বলা হয়- এলিট ফোর্স (অভিজাত বাহিনী)। এই বাহিনী সকল প্রকার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হতেই থাকবে। তিনি বলেন, সংবিধানের ৩১, ৩২ ও ৩৬ ধারায় প্রত্যেক নাগরিকের আইনের আশ্রয় লাভ, জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার ও যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরার অধিকার রয়েছে। অনেক সময় র্যাব মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করছে। এছাড়া বিশেষ উদ্দেশ্যে র্যাবের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য এই বাহিনীকে অপব্যবহার করা হতে পারে। এই বাহিনীর জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো গাইডলাইন না থাকায় তাদের ক্ষমতা অসীম হয়ে গেছে। তাই এই বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অতিসত্বর বিদ্যমান আইন সংস্কার করা প্রয়োজন। যে তিন র্যাব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকায় র্যাব কর্তৃপক্ষ তাদেরকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে তাদেরকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদের দাবি জানান তিনি।
ড. কামাল বলেন, র্যাব অপরাধ করলে তাদের পুলিশ বা অন্য কোনো বাহিনী গ্রেপ্তার করতে পারবে কিনা সে সম্পর্কে বিদ্যমান আইনে কিছু বলা নেই। সুতরাং আইনে ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি দূর করা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, সংবিধানের ৪৪ নম্বর অনুচ্ছেদ যেনতেন অনুচ্ছেদ নয়। এটা বিশেষ ধরনের অনুচ্ছেদ। আদালত বলতে পারেন, অন্য একটি বেঞ্চ আদেশ দিয়েছে, সেখানে আরেকটি বেঞ্চে আবেদন নিয়ে আসেন কিভাবে? আমি মনে করি, যুক্তি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে আপনাদের সন্তুস্ট করতে পারবো। আমরা চেয়েছি, আইনরে মধ্যে দুর্বলতা, ঘাটতি অসঙ্গতি থাকার কারণে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী সঠিক ভূমিকা রাখতে পারে না। আবার অনেকক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা না থাকার কারণে লাগামহীন ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারা। যেমন র্যাব গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই লোকদের ধরে নিয়ে আসছে। যে কাজ পুলিশের সে কাজ করছে র্যাব। আপনারা হলেন সাংবিধানিক আদালত। জনগনের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে আপনারা আদেশ দিতে পারেন। বেচে থাকার অধিকার সবচেয়ে মৌলিক। এটা কোনো ফালতু ভোগাস-সারবত্তা) বিষয় নয়।
শুনানিতে ড. কামাল বলেন, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বিভিন্ন সময়ে হতাশার সুরে বলেছেন, তার আইনগত ক্ষমতা কম। তার কিছুর করার নেই। আদালতের এ ব্যাপারে ভূমিকা নেয়া উচিত। মানবাধিকার কমিশনকে দোষী হিসেবে বিবাদী করা হয়নি। বরং যাতে কমিশন আইন প্রণয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। আমাকে অনেকে বলেছেন, র্যাবের বিরুদ্ধে কিছু বলেন, কিছু বলেন। কিন্তু আমার চিন্তা হচ্ছে- কিভাবে তাদের আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা যায়। সে চেষ্টাই এখন করছি। সংবিধান অনুযায়ী কারো লাগামহীন ক্ষমতা নেই।
এ পর্যায়ে আদালত বলেন, র্যাবের তিনজন কর্মকর্তাকে অপহরণ ও হত্যার ঘটনায় যদি কোনো প্রাথমিক সম্পৃক্ততা না পেত, তাহলে তাদের চাকরি থেকে অবসরে পাঠানো হতো না। এদের ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে তো কোনো অসুবিধা নেই।
এ সময় হাইকোর্ট বলেন, হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ওই ঘটনা নিয়ে আদেশ ও রুল দিয়েছেন। হাইকোর্টের আদেশে ইতিমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে আমরা আবার আদেশ দিলে তদন্তের ব্যতয় ঘটবে কিনা জানতে চাইলে ড. কামাল বলেন, না এক্ষেত্রে কোনো ব্যতয় ঘটবে না। এই আদেশ হাইকোর্টের ওই আদেশের পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে।
ড. কামাল বলেন, এত বেশি গুম, অপহরণ ও খুন কেন হচ্ছে- এর একটা মানবিক সমাধান প্রয়োজন। এজন্য একটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা প্রয়োজন।
গত ২৭ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহূত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। এর তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যায় একে একে ভেসে ওঠে সাতজনের মরদেহ। এ ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে মামলা করেছে নজরুলের পরিবার। লাশ উদ্ধারের আগের দিন তারেক সাঈদ মুহাম্মদ র্যাব-১১ এর অধিনায়কের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে সেনাবাহিনীতে পাঠানো হয়েছিল।
এরপর গত ৪ মে নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম ওরফে শহীদ চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে র্যাব-১১ এর সদস্যরা ওই সাতজনকে অপহরণ ও খুন করেছেন। এ অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তারেক সাঈদ ওই দিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সব বাহিনীর লোক মিলে একসঙ্গে ঘুষ নেয়া বাস্তবসম্মত নয়। তা ছাড়া ছয় কোটি টাকা অনেক টাকা। এতগুলো টাকা নিতে পিকআপ লাগার কথা। প্রশ্ন হলো, এত টাকা নিয়ে আমি কী করলাম। সে টাকা তো আমার কাছে থাকতে হবে। আমার মনে হয়, কাউকে বাঁচানোর জন্য এসব কথা বলা হচ্ছে। এসব কথাবার্তা তদন্তকে জটিল করে তুলবে। ওই অভিযোগ ওঠার পর গত ৬ মে র্যাবের ওই তিন কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অকালীন ও বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়।
এর আগে বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গত ৫ মে নারায়ণগঞ্জে ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্ত করতে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। এছাড়া ওই ঘটনায় র্যাবের কোন সদস্যে জড়িত রয়েছে কিনা তা র্যাবকে বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ডিবির পাশাপাশি সিআইডিকেও মামলার তদন্ত করতে বলা হয়েছে আদালতের আদেশে। একই সঙ্গে এ মামলার সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশের মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ওই দিনই নারায়নগঞ্জে সাতজনকে অপহরণ ও খুনের ঘটনায় র্যাব সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ তদন্ত করতে র্যাবের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। চার সদস্যের কমিটির প্রধান হলেন র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আফতাব উদ্দিন আহমেদ। এছাড়া হাইকোর্টের নির্দেশে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাহজাহান আলী মোল্লার নেতৃত্বে সাত সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গত বৃহস্পতিবার থেকে কাজও শুরু করেছেন। এই তদন্ত কমিটি গত শনিবার নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের সাক্ষ্য নিয়েছে। তদন্ত কমিটি আজ ও ১৫ মে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গণশুনানি করবে।
COMMENTS