মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী বন্ধুদের দেয়া ক্রেষ্ট জালিয়াতিতে ক্ষুন্ন দেশের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেয়া মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা ও মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননার ক্রেস্ট পুনরায় দেয়া হবে। এতে দেশের ভাবমূর্তি উদ্ধারতো নয়ই, বরং আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রসঙ্গে সাবেক কূটনীতিক ফারুক আহমেদ চৌধুরী জাস্ট নিউজকে বলেন, এটা আমাদের জন্য খুবই লজ্জাজনক বিষয়। এ রকম ঘটনা পৃথিবীতে এর আগে ঘটেছে কিনা আমার জানা নেই। তিনি বলেন, যারাই এ ধরনের চুরি করেছে তারা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধরনের চোর।
বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যেভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে তা আর কোনোভাবেই ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় আবার সন্মাননা দেয়ার কথা বলছে। কিন্তু আর কোনো সম্মাননাই হারানো ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে পারবে না। বিশ্ববাসী জেনে গেছে, আমরা কত বড় মাপের চোর।
পুনরায় সন্মাননা দেয়ার আগে যারা এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করা উচিত বলেও দাবী করেন সাবেক এ রাষ্ট্রদূত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ড. আ আ স ম আরফিন সিদ্দিকী জাষ্ট নিউজকে বলেন, এই উদ্যোগটা সত্যিই দারুন ছিল। কিন্তু এর ভিতরে এমন জালিয়াতি খুবই লজ্জাজনক।
তিনি বলেন, এত বড় চুরির সঙ্গে যারাই জড়িত তাদেরকে চিহ্নিত করে দ্রুততার সঙ্গে গ্রেফতার করা উচিত ছিল।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পুনরায় সম্মাননা দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হারানো ভাবমুর্তি কোনোভাবেই ফিরিয়ে আনা যাবে না। তবুও নতুন এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই আমি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এবং বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. এমাজ উদ্দিন আহমেদ জাষ্ট নিউজকে বলেন, এই ঘটনার মধ্য দিয়ে সরকারের ক্ষমতাসীনরা চুরির বিষয়ে কতটা পারদর্শী তা প্রমানিত হলো। এরা এখন দেশের পাশাপাশি বিদেশীদের কাছ থেকেও চুরি করতে দ্বিধা করে না।
তিনি বলেন, এমন হীন ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের ভাবমূর্তি কোন স্তরে নিমজ্জিত হলো তা এখন আর নতুন করে বলার কিছুই নেই। এখন বিদেশে গিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বললেও যে কেউ প্রশ্ন তুলবে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পুনরায় সম্মাননা দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা খারাপ নয়। তবে তা অবশ্যই এই চুরির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতারের পর করতে হবে। নয়তো আমি মনে করি, বিচার না করে সম্মাননা পুন:প্রদান করা জাতীয় কলঙ্ক ঢাকার একটা অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।
প্রসঙ্গত, ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে এই সম্মাননাগুলো দেয়া হয়। তখন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন এ বি তাজুল ইসলাম। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে সরকার স্বাধীনতার চার দশক পূর্তি উপলক্ষে সাত পর্বে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু স্বনামধন্য ৩৩৮ বিদেশি ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনকে অন্যান্য উপহারসামগ্রীর সঙ্গে একটি করে ক্রেস্ট দেয়।
তিন শ্রেণিতে এই সম্মাননা দেয়া হয়। বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা ও মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা হিসেবে সবার হাতে একটি করে ক্রেস্ট তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শেষ ধাপে বিদেশী বন্ধুদের দেয়া সম্মাননা দেয়ার পর ক্রেষ্টে দেয়া স্বর্ণের পরিমানে জালিয়াতির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
জানা যায়, সম্মাননা প্রদান সংক্রান্ত নীতিমালায় বলা আছে, প্রতিটি ক্রেস্টে এক ভরি (১৬ আনা) স্বর্ণ ও ৩০ ভরি রুপা থাকবে। পরে মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে করা বিএসটিআইয়ের পরীক্ষায় দেখা গেছে, এক ভরির (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) জায়গায় ক্রেস্টে স্বর্ণ পাওয়া গেছে মাত্র দুই দশমিক ৩৬৩ গ্রাম (সোয়া তিন আনা)। এক ভরির মধ্যে প্রায় ১২ আনাই নেই। আর রুপার বদলে ৩০ ভরি বা ৩৫১ গ্রাম পিতল, তামা ও দস্তামিশ্রিত সংকর ধাতু পাওয়া গেছে।
সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে একটি ক্রেস্টের জন্য অন্যান্য খরচের সঙ্গে দুই ভরির বেশি (২৩ দশমিক ৫ গ্রাম) স্বর্ণ ও ৩০ ভরি রুপার দাম পরিশোধ করা হয়েছে। উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান ছাড়াই এই ক্রেস্ট কেনা হয়েছিল। ৩৩৮টির মধ্যে ৬০টি ছাড়া বাকি সব ক্রেস্ট সরবরাহ করেছে এমিকন নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন-এর (বিএসটিআই) পরীক্ষায় এসব প্রমাণ পাওয়া গেছে।
COMMENTS