টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বাজেট সংসদে পাস হয়েছে। রোববার স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধরীর সভাপতিত্বে সকাল ১০টায় অধিবেশন শুরু হয়। অধিবেশনে আগামী অর্থবছরের জন্য দুই লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট পাস হয়।
মঙ্গলবার থেকে নতুন অর্থবছর শুরু হচ্ছে। গত ৫ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ বাজেট পেশ করেন। প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সংসদ সদস্যরা ৬০ ঘণ্টা আলোচনা করেছেন।
বাজেট পাস হওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ উপস্থিত ছিলেন।
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী রোববার অধিবেশনের শুরুতেই জানান নয়টি মঞ্জুরী দাবিতে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির একজন ও একজন স্বতন্ত্র সাংসদ আলোচনা করবেন। তখন পর্যন্ত মঞ্জুরী দাবি ও ছাঁটাই প্রস্তাব দেওয়া অনেক সংসদ সদস্যই অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন না।
পরে বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা আরো কয়েকটি দাবিতে আলোচনা করেন।
এই বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ধরা হয়েছে ৮০ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। তবে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নে এডিপিতে ৫ হাজার ৬৮৫ কোটি ৪৮ টাকার কর্মসূচি রয়েছে। সব মিলে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের এডিপিতে মোট খরচ দেখানো হচ্ছে ৮৬ হাজার কোটি টাকা।
নতুন অর্থ বছরে অনুন্নয়ন ব্যয়ের পরিমাণ ধরা হয়েছে এক লাখ ৫৪ হাজার ২৪১ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরের বাজেট ব্যয়ের বাইরে সরকারের বিভিন্ন ধরনের সংযুক্ত দায় মিলিয়ে মোট তিন লাখ ৮২ হাজার ৩৪০ কোটি ১ লাখ ২১ হাজার টাকার নির্দিষ্টকরণ বিল জাতীয় সংসদে কণ্ঠভোটে রোববার পাস হয়।
এর মধ্যে সাংসদদের ভোটে গৃহীত অর্থের পরিমাণ দুই লাখ ৩০ হাজার ৪১৭ কোটি ১০ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং সংযুক্ত তহবিলের ওপর দায় এক লাখ ৫১ হাজার ৯২২ কোটি ৯০ লাখ ২৭ হাজার টাকা।
সংযুক্ত তহবিলের দায়ের মধ্যে ট্রেজারি বিলের দায় পরিশোধ, হাইকোর্টের বিচারপতি ও মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রককে বেতন ইত্যাদি দায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
মোট বাজেট ব্যয়ের মধ্যে বৈদেশিক অনুদান রয়েছে। সেই অনুদান বাদ দিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে নির্দিষ্টকরণ অর্থ মঞ্জুরের জন্য সংসদে পাস করা হয়েছে।
আগামী অর্থবছরের বাজেটের ওপর সংসদে উত্থাপিত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ খাতের ৫৬টি মঞ্জুরী দাবির বিপরীতে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র সাংসদেরা ২৪৯টি বিভিন্ন ধরনের ছাঁটাই প্রস্তাব আনেন।
ছাঁটাই প্রস্তাবগুলো ছিল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, জনপ্রশাসন, আইন, স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য ও পরারাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নামে মঞ্জুর দাবির বিপরীতে।
তবে বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র সাংসদদের আলোচনা সত্ত্বেও ছাঁটাই প্রস্তাবগুলো কণ্ঠভোটে বাতিল করা হয়।
২৪৯টি বিভিন্ন ধরনের ছাঁটাই প্রস্তাবে মন্ত্রণালয় ও বিভাগ খাতে ব্যয় হ্রাস করে সিংহভাগ ক্ষেত্রে মাত্র এক টাকা বরাদ্দ দেওয়া, প্রতিক ছাঁটাই প্রস্তাবে ১০০ টাকা ও ৫০০ টাকা হ্রাস করা, মিতব্যয় ছাঁটাই প্রস্তাবে এক হাজার টাকা হ্রাস করার প্রস্তাব করা হয়।
ছাঁটাই প্রস্তাবে সমালোচনা
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাবে সংশ্লিষ্ট সদস্যরা মন্ত্রণালয়গুলোর কর্মকাণ্ডের ব্যাপক সমালোচনা করেন।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের বরাদ্দ দেওয়ার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে স্বতন্ত্র সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী বলেন, “এই বিভাগে টাকা বরাদ্দ দেয়া মানে হলো সরকারি ব্যাংকগুলো আবার উল্টো-পাল্টা ঋণ দেবে। আর জনগণ সে ব্যয়ের বোঝা সইবে।”
জাতীয় পার্টির নুরুল ইসলাম মিলন বলেন, “গতবার বরাদ্দ বেশি হওয়ার পরেও এ বিভাগে লুটপাট হয়েছে। এবার যদি আরো বাড়ানো হয় তবে লুটপাট বাড়বে।”
স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, “হলমার্ক-বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি ঘটলো। ব্যাংকের টাকা চলে গেল। সুইস ব্যাংকে টাকা চলে গেল। সরকারের ছত্রছায়া ছাড়া এটা করা সম্ভব নয়।”
জবাবে অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেন, “ব্যাংকিং খাতে কিছু জালিয়াতি হয়ে গেছে। সোনালি ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকে এগুলোকে দেখেছি। অতীতে কোনে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আমরা নিচ্ছি। বেসিক ব্যাংকের পরিচালনার পর্ষদ পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। শিগগিরই এটা দেখবেন।”
সংসদ সদস্যদের অভিযোগগুলো ‘স্বীকার’ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, “সংসদ এ ব্যাপারে সচেতন। এতে করে শুধু সরকার নয়, যারা দুর্নীতি করে তারাও সতর্ক হবে।”
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ নোমান বলেন, “স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মানুষের আস্থার প্রতীক না হয়ে ভীতি ও দুর্ভোগের প্রতীক হয়ে উঠেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খুন, চাঁদাবাজির কথা সবাই জানে। পুলিশের চাঁদাবাজি সত্য। তাই এই মন্ত্রণঅলয়ের বরাদ্দ না বাড়িয়ে পুলিশের চাঁদাবাজি থেকে ব্যয় নির্বাহ করা হোক।”
এছাড়া স্বতন্ত্র সতদ্য রুস্তম আলী ফরাজী ও হাজি সেলিমও মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করেন।
এর জবাবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন বলেন, “আমরা সক্ষমতা বাড়াতে চাই বলেই বরাদ্দ চেয়েছি। চাঁদাবাজির অভিযোগ থাকলে আমাদের জানান। আইজি সাহেব ব্যবস্থা নেবেন।”
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের সময় ছাঁটাই প্রস্তাব দেয়া সংসদ সদস্যরা ডাক্তারদের মফস্বলে না যাওয়া, সরকারি হাসপাতালে ওষুধ ও যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা এবং সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতির বিষয় তুলে ধরেন।
জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, “উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিচাণার কমিটির সভাপতি এমপি সাহেবরা। কে কর্মক্ষেত্রে থাকছে না এটা দেখা তাদের দায়িত্ব। সব কাজ আমার বা প্রধানমন্ত্রীর না। সরকার সব কাজ করে না। আপনারা বলেন কে থাকছে না। অবশ্যই সুপারিশ বাস্তবায়ন হবে।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করে নুরল ইসলাম মিলন বলেন, “আমাদের পররাষ্ট্র নীতি কোন মুখী হবে সেটা ঠিক করতে হবে। পূর্বমুখী হবে না কি পশ্চিমমুখী হবে। বিদেশের মিশনগুলোতে কর্মকর্তারা কোন সহায়তা করেন না। বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য কাজ করে না। এ জন্য এদের বরাদ্দ না দিয়ে কমানো হোক।”
স্বতন্ত্র সতস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, “মিয়ানমার আমাদের বিজিবি সদস্যকে মেরে চলে যায়। আমাদের নতজানু নীতির কারণে প্রতিবাদ করতে পারি না। ভারতের সাথে তিস্তাসহ ৫৪টি নদী নিয়ে সমস্যা আছে। এগুলোর বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে আরো দক্ষ হতে হবে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গে কি আলোচনা হলো জানা গেলো না।”
এছাড়া হাজি সেলিম ও মোহাম্মদ নোমান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বরাদ্দ না দেয়ার দাবি করেন।
জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী বলেন “সার্ভিস চাইবেন আর বরাদ্দ দিবেন না, তাতো হয় না। বাণিজ্যতো বেড়েই চলছে। আপনারা মনে হয় চোখেরও দেখেন না, কানেও শোনেন না। একজন বলেছেন আমাদের নীতি কোনমুখী। আমি বলতে চাই এটা বাংলাদেশমুখী।”
শুরু হতে হওয়া ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য পাস হওয়া বাজেট ব্যয় দুই লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার মধ্যে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে এক লাখ ৮২ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা। ফলে সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি দাঁড়াচ্ছে ৬১ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট দেশজ উৎপাদনের তুলনায় ঘাটতি ধরা হয়েছে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ।
তবে অনুদান বাদ দিলে ঘাটতি গিয়ে দাঁড়াবে ৬৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকায়। শতকরা হিসাবে যা ৫ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে ছয় হাজার ২০৬ কোটি টাকার অনুদান পাওয়া যাবে বলে ধরা হয়েছে।
COMMENTS