মোঃ মুজিবুর রহমানঃ ২৩ জুলাই ২০১৪, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ৮৯তম জন্মবার্ষিকী। এই সৎ ও আলোকিত মানুষটি বেঁচে থাকলে এবারের ২৩ জুলাই তিনি ৯০ বছরে পা দিতেন। ৮৯ বছর আগে হাজার বছরের শৃঙ্খলিত ও নিপীড়িত বাঙালির মুক্তির লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করার জন্য জন্ম হয় তাজউদ্দীন আহমদ নামের এক দেদীপ্যমান আলোকবর্তিকার। তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের ইতিহাস রচনায় অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ছিলেন মনে প্রাণে দেশপ্রেমিক এবং সম্পূর্ণ নির্লোভ এক চরিত্রের মানুষ। মানুষের জন্য একেবারেই নিঃস্বার্থ সেবা ও কল্যাণ ছিল তাঁর রাজনীতির লক্ষ্য।
১৯২৫ সালে ঢাকার অদূরে গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ২৩ জুলাই বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মৌলবী মুহাম্মদ ইয়াসিন খান এবং মা মেহেরুন্নেসা খানম। তাঁরা ছিলেন চার ভাই ও ছয় বোন। তাজউদ্দীন আহমদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের মক্তবে, এরপর বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরবর্তী ভুলেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তৃতীয় শ্রেণিতে উঠে তিনি ভর্তি হন দরদরিয়া থেকে আট কিলোমিটার দূরের কাপাসিয়া মাইনর ইংরেজি স্কুলে। তারপর তিনি গাজীপুরের কালিগঞ্জের সেন্ নিকোলাস ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। সর্বশেষ স্কুল জীবন ঢাকার সেন্ট গ্রেগরীজ হাইস্কুলে শেষ হয়। তবে এর পূর্বে ঢাকার মুসলিম বয়েজ হাইস্কুলে অধ্যয়ন করেন। তাজউদ্দীন আহমদ মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি পবিত্র কোরআন - এ হাফেজ ছিলেন। তিনি শৈশব থেকে প্রতিবাদী ও বিপ্লবী মনোভাব পোষণ করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং গ্রহণ করেন। ওই সময়ে বন্ধুদের নিয়ে পোশাক পরে সারা রাত ডিউটি করেছেন তাজউদ্দীন আহমদ। তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৪২ সাল থেকে আজীবন বয়স্কাউট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। ছাত্র জীবন থেকে কথাবার্তা যা বলতেন সবই সামনাসামনি। উচিত কথায় কাউকে তিনি ছাড় দিতেন না।
তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাকালে ফজলুল হক মুসলিম হলের ছাত্র ছিলেন। অন্যদিকে জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় পরীক্ষা দিয়ে তিনি আইন শাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তাজউদ্দীন আহমদ সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িত হন। ১৯৪৩ সালে মুসলিম লীগের সক্রিয় সদস্য হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু। ১৯৪৪ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। পাকিস্তান আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর তাজউদ্দীন আহমদ সরকারের নীতির বিরোধিতায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিমের লীগের জন্ম হয়। (পরবর্তীতে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়) সেই দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে নতুনমাত্রা যোগ হয়। তখনকার তরুণ নেতা শেখ মুজিবের সান্নিধ্য লাভ, তাঁর সাথে বাঙালি জাতির মুক্তির লড়াইয়ে এগিয়ে যাওয়াই গণমানুষের এ নেতার অন্যতম কর্ম হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে কাপাসিয়া নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি কারাবরণের মাধ্যমে চলে যায় গত শতকের পঞ্চাশ দশকের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অধ্যায়। তাজউদ্দীন আহমদ শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে সকল প্রকার আন্দোলনে সক্রিয় জড়িত ছিলেন। ১৯৫৫ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালের পরের বছরগুলো তাজউদ্দীন আহমদের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল তেমনি আওয়ামী লীগের জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৬ সালে তাজউদ্দীন আহমদ লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলীয় সম্মেলনে যোগদান করেন। এই সম্মেলনেই বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা পেশ করেন। এই বছরই তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। এর আগে তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ বাঙালীর মুক্তি সনদ ৬ দফার প্রচারাভিযানে অংশগ্রহণকালে ১৯৬৬ সালের ৮ মে গ্রেফতার হন। দেশে ৬ দফা ও ছাত্রদের ১১ দফার আন্দোলন চলাকালে ১৯৬৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মুক্তিলাভ করেন তিনি। এদিকে বঙ্গবন্ধু তখন জেলে এবং ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার (বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ইসলামাবাদ ষড়যন্ত্র মামলা) বিচার কার্য চলতে থাকে। ছাত্র শ্রমিক জনতার আন্দোলন চরম পর্যায়ে। অবশেষে ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্তিলাভ করেন। এরপর ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে তাজউদ্দীন আহমদ জাতীয় পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন। পরিক্রমায় দেখা যায় যে এই নির্বাচনের পর তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বড় ধরনের একটি অধ্যায়ের সূচনা হয় ।
একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের আকাঙ্ক্ষা এই দেশের মানুষের বুকের মাঝে জাগ্রত করেন বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমিতে সাংগঠনিক দিকসমূহ পরিচালনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আস্থাভাজন সহযোগী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ অতুলনীয় দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন । মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে শুধু বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ প্রজ্ঞাসূলভ নেতৃত্বে ছিলেন বলেই মাত্র নয় মাসে দখলদার হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর কাছ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে পুরো মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বে দেন তাজউদ্দীন আহমদ। মহান মুক্তিযুদ্ধকে তিনি খুবই দূরদর্শিতা ও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেছিলেন।
২৭ মার্চ ১৯৭১ সাল। তাজউদ্দীন আহমদ আর ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ঢাকা শহরের লালমাটিয়ার একটি বাড়ি থেকে বের হয়ে একেবারে সাধারণ পোশাক পড়ে মিশে যায় সাধারণ মানুষের মাঝে। এভাবেই ঢাকা ত্যাগ করেন। এর আগে ২৫ মার্চ রাত্রে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ত্যাগ করার সময় বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা গ্রহণ করেছিলেন গণমানুষের দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ তাজউদ্দীন আহমদ সীমান্ত পাড়ি দেন। তখনও তাঁর সাথে ছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার আগে তাজউদ্দীন আহমদ ভারত সরকারের মনোভাব জানার জন্য একটি প্রতিনিধি দল ভারতে পাঠান। ১ এপ্রিল ১৯৭১ গভীর রাতে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে দিল্লির উদ্দেশে যাত্রা করেন তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। ৩ এপ্রিল ১৯৭১ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয় এবং বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার ও মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার বিষয়ে ভারতের সম্মতি আদায় করেন।
১০ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি(রাষ্ট্রপতি অবর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) ও তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন। একইদিনে রাতে আকাশবাণী বেতারে প্রচারিত হয় বাংলাদেশ সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত সংবলিত তাজউদ্দীন আহমদের বিবৃতি। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে এই সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। শপথ অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ। ভাষণের শেষে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নে জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। এক বিদেশি সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন আজ থেকে এই এলাকার নাম ‘মুজিবনগর’।
অকুতোভয় তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে এবং নিষ্ঠা ও ধৈর্যের সাথে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সকল কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তিনি সফল স্বাপ্নিক হিসেবে সমস্ত বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধে দক্ষতার সাথে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এদিকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চক্র মুক্তিযুদ্ধকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার যে চক্রান্ত করে, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কৌশলগত ও প্রশাসনিক দক্ষতা দিয়ে তাকে দৃঢ়চিত্তে মোকাবিলা করেন। মাস মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প পরিদর্শন; শরণার্থীদের আশ্রয় কেন্দ্র পরিদর্শন; মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়; বিভিন্ন সময়ে জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণদান - এ রকম বহুবিধ কাজ করে মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস দক্ষতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। মুক্তিসেনাদের অদম্য সাহস ও মনোবলকে বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে তিনি বলেন ঃ “আমাদের মানবিক মূল্যবোধ ও আদর্শেও পতাকা সমুন্নত রেখে আমরা আবার প্রমাণ করেছি যে, আমরা তিতুমীর- সূর্য সেনের বংশধর। স্বাধীনতার জন্যে যেমন আমরা জীবন দিতে পারি. তেমনি আমাদের দেশ থেকে বিদেশি শত্রু- সৈন্যদের চিরতরে হটিয়ে দিতেও আমরা সক্ষম। আমাদের অদম্য সাহস ও মনোবলের কাছে শত্রু যত প্রবল পরাক্রম হোক না কেন, পরাজয় করতে বাধ্য। ”
মুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্বদানকারী তাজউদ্দীন আহমদ যুদ্ধের শেষে বিজয়ের বেশে ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার পরিচালনা করেন । মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ত্যাগ, নিষ্ঠা, দক্ষতা ও স্বদেশপ্রেম বাঙালি জাতির ইতিহাসে ভাস্বর হয়ে থাকবে।
১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। অতঃপর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয় সেই মন্ত্রিসভায় অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন তাজউদ্দীন আহমদ। বাংলাদেশের সংবিধান রচনায় তিনি প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। স্বাধীনতা লাভের পর অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদকে উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণের প্রশ্নে নীতি নির্ধারণ বিষয়ক ভূমিকা রাখতে হয়। ১৯৭১ সালে আমেরিকা বাংলাদেশকে বিরোধিতা ও পাকিস্তানের প্রতি বিবেকহীন সমর্থনের কারণে মার্কিন সাহায্য গ্রহণে তিনি অনিচ্ছুক ছিলেন । আত্ম-নির্ভর বিকাশমান অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য তিনি বিশেষ সচেষ্ট ছিলেন। ১৯৭৪ সালে ২৬ অক্টোবর তাজউদ্দীন আহমদ অর্থমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা বিরোধী ও ক্ষমতা দখলকারী ঘাতকদের হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একই দিন সকালে তাজউদ্দীন আহমদকে গৃহবন্দি করা হয় এবং পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
রাজনীতিতে মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততার প্রতীক ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। সেই ব্রিটিশ শাসনের শোষণ থেকে জাতির মুক্তির লক্ষ্যে সেই সময়কার মুসলিম লীগের হয়ে তিনি আন্দোলন-সংগ্রামের মশাল হাতে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। আর পরিসমাপ্তি ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরে জেলখানায় স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতক দলদের গুলিতে। বন্দি অবস্থায় ও কারাগারের সমস্ত নিয়ম ভঙ্গ করে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় তাজউদ্দীন আহমদ এবং অপরাপর তিন জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে।
তাজউদ্দীন আহমদ বাঙালিদের নিয়ে ও সমাজকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। তবে রাজনীতিকে তিনি কঠিন মানদ- দিয়ে বিচার করতেন। বিচার বিশ্লেষণে তাঁর আত্ম-সমালোচনা নিমর্ম। তিনি ছিলেন প্রচার বিমুখ এক ব্যক্তিত্ব। তাঁর অবলোকন দূরদর্শী। এই দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে তিনি যে বলয় তৈরি করেছিলেন তা সৎ, সুস্থ ও আদর্শ রাজনীতিতে অনুপ্রাণিত, সতেজ ও বেগবান করতো তাতে সন্দেহ নেই। তাজউদ্দীন আহমদ আজ বেঁচে থাকলে তিনি ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে কোনো প্রকার পাত্তাই দিতেন না । পাশাপাশি ওই শক্তির সঙ্গে কোনো প্রকার আপসরফা করতেন না। এদিকে যে সামাজিক অবক্ষয় আমাদের চারিদিক থেকে আক্রমণ করছে, এ অবস্থায় তা রুখে দাঁড়ানোর সফল নেতৃত্ব দিতেন তিনি। তাজউদ্দীন আহমদ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। ১৯৪৮ সাল থেকে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার দাবি আদায়ের প্রশ্নে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তিনি ছিলেন তার সক্রিয় অংশীদার।
দেশপ্রেম ও দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের প্রাণশক্তি ছিল। তাঁর অদম্য সাহস, আত্মত্যাগ, সাংগঠনিক দক্ষতা, নেতৃত্বদানের কলা কৌশল, মানুষের আপনজন হওয়ার ও তাদের প্রতি বিশ্বাস অর্জনের মতো গুণাবলী তাজউদ্দীন আহমদকে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত করেছিল রাজনৈতিক কর্মী থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নায়কে।
তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন ৪৬ বছর বয়সে আর ঘাতকদের বুলেটে মৃত্যু হয় ৫০ বছর বয়সে। তাঁর তো আরো অনেককিছু দেবার ছিল বাঙালি জাতিকে? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে যুগ যুগ ধরে আজকের প্রজন্মকে ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে । বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন বাংলার ঘরে ঘরে তাজউদ্দীন আহমদের পবিত্র স্মৃতির অনির্বাণ শিখা জ্বলবে। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ততদিন উন্নত সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে সৎ রাজনীতিবিদ তাজউদ্দীন আহমদের রেখে যাওয়া কর্ম ও দর্শন দিকনির্দেশনা দেবে বলে বিশ্বাস করি।
৮৯তম জন্মবার্ষিকীতে মহান মুক্তিযুদ্ধের নায়ক ও বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি এবং তাঁর পবিত্র স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি ।
লেখক: কলেজ শিক্ষক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও আর্কাইভস ৭১ - এর প্রতিষ্ঠাতা, গাজীপুর