মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের কড়া নির্দেশনা স্বত্ত্বেও গাজীপুরে আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভা এখন অবহেলা ও নিয়ম রক্ষায় পরিণত হয়েছে। জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে আইনশৃঙ্খলা কমিটির অনেক সদস্য সভায় উপস্থিত না থাকায় সরকারের সিদ্ধান্ত উপেক্ষিত হচ্ছে। কমিটির সদস্য বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, সংসদ সদস্যদের মনোনিত প্রতিনিধি ও বিভিন্ন সরকারি অফিস প্রধানরা সভায় উপস্থিত থাকছেন না। গাজীপুরে আইনশৃঙ্খলা তদারকি করতে সর্বোচ্চ প্রশাসনিক নীতি নির্ধারনী ফোরাম জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটি সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়হীনতায় গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারছেন না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১০ জুন ঘোষণা ছাড়াই সভা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় কমিটির সদস্যরা এসে ফিরে যায়। পরে ১৪ জুন অনুষ্ঠিত এ সভায় অনেক সদস্যই যোগ দেননি। শুধু তাই নয়, আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা চলাবস্থায় কোনোরূপ আলোচনা ছাড়াই নারী ও শিশু পাচার প্রতিরোধ কমিটি, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি, জেলা চোরাচালান নিরোধ কমিটি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কমিটি, জেলা এসিড নিয়ন্ত্রণ কমিটি, জেলা সড়ক নিরাপত্তা কমিটি ও কারাগারে থাকা শিশু কিশোরদের অবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে গঠিত টাস্কর্ফোস সভার সদস্যদের স্বাক্ষর নিয়েই দায়িত্ব শেষ করছেন জেলা প্রশাসন। এ যেন কাগজে কলমে নিয়ম রক্ষার সভা। আবার আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা চলা অবস্থায় কোনো আলোচনা ছাড়াই অন্তত সাতটি কমিটির সদস্যদের কাছ থেকে রেজুলেশন শিটে স্বাক্ষর নিয়ে নেন জেলা প্রশাসনের কর্মচারীরা।
গাজীপুর জেলা পুলিশের মাসিক তুলনা মূলক অপরাধ বিবরণীতে সঠিক চিত্র উপস্থাপিত এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়হীনতায় আইনশৃঙ্খলা কমিটিতে গৃহীত অনেক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে কমিটির সদস্যরা সভায় উপস্থিত হতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
গত ১৪ জুলাই গাজীপুর জেলা প্রশাসনের ভাওয়াল সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসক মো. নূরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এমন চিত্রই দেখা গেছে। এই সভায় পাঁচটি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা ও পৌর সভার মেয়রগণ কেউই উপস্থিত হয়নি।
এমনকি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান জেলা পরিষদ, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, সিভিল সার্জন, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর, এলজিইডি, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস, বন বিভাগ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিভিউশন কোং সহ অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত হয়নি।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিভিউশন কোং কর্মকর্তাদের দৃষ্টতা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিভিউশন কোং এর গাজীপুরের কর্মকর্তাদের দৃষ্টতা অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে জাতীয় সম্পদ তিতাস গ্যাসের লুটপাট ও নৈরাজ্য বন্ধে গত কয়েকটি সভায় আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আর যেন নতুন কোনো ধরণের অবৈধ গ্যাস সংযোগ কেউ না দিতে পারে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে কার্যকর ভূমিকা রাখার সিদ্ধান্ত হয়। অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগকারী ও ব্যবহারকারীদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত শাস্তির ব্যবস্থা করতে অবৈধ সংযোগকারী ও ব্যবহারকারীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা চাওয়া হয়। অবৈধ সংযোগ চিহ্নিত করে বিচ্ছিন্নকরণ কার্যক্রম বাস্তবায়নের দায়িত্বটাও নেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপার। কিন্তু তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিভিউশন কোম্পানির গাজীপুর অঞ্চলের জিএম, ডিজিএম, জোনাল ম্যানেজার ও ম্যানেজারসহ কর্মকর্তাদের অসহযোগিতার কারণে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করণে পরিচালিত মোবাইল কোর্ট সংযোগকারী ও ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর পরই পুনরায় সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে অবৈধ গ্যাস ব্যবহার শুরু হয়। এতে মোবাইল কোর্টের কার্যকারিতা হারাচ্ছে বলে মনে করেন অনেকেই। অবৈধ সংযোগের তালিকা সরবরাহ না করা এবং সভায় তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিভিউশন কোং এর গাজীপুরের কর্মকর্তাদের উপস্থিত না থাকা ধৃষ্টতার শামিল মনে করছেন অনেকেই।
রাষ্ট্রীয় কাজে অসহযোগিতা ও সভায় উপস্থিত না থাকার বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিভিউশন কোম্পানির গাজীপুর অঞ্চলের কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীন আচরণের বিষয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার সিদ্ধান্ত জানান জেলা প্রশাসক।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয় না
অপরাধের উৎস মাদকের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কার্যকর তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপই চোখে পড়ছে না। মাদক বিরোধী উদ্বুদ্ধকরণ ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম নেই। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে রুজুকৃত মামলায় খালাসের বিরুদ্ধে আপীল মামলা করার সিদ্ধান্ত থাকলেও আপিল হয়েছে এমন কোনো তথ্য গাজীপুর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে নেই।
গাজীপুর অফিসের পরিদর্শক ফরহাদ হোসেন জানান, মাদকের মামলায় খালাস প্রাপ্তদের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়।
অপরাধের সঠিক চিত্র আইনশৃঙ্খলা কমিটিতে উত্থাপিত হয় না
আইনশৃঙ্খলা কতটা স্বাভাবিক কিংবা খারাপ তা নির্ভর করে ওই এলাকায় সংঘটিত চুরি, ডাকাতি, অপহরণ ও দস্যুতার মতো গুরুতর অপরাধ সংঘটনের ওপর। জেলা পুলিশের মাসিক তুলনামূলক অপরাধ বিবরণীতে গত মে মাসের তুলনায় জুন মাসে অপরাধ হ্রাস পেয়েছে। তবে গত জুন ২০১৩ এর চেয়ে জুন ২০১৪ মাসে অপরাধ বৃদ্ধির হার ২.৫ ভাগ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাল বা স্বাভাবিক দেখানোর জন্য থানা পুলিশ ডাকাতি বা অপহরণের ঘটনায় অন্য ধারায় মামলা নেয়।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সংরক্ষিত ১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পারভীন আক্তার অপহরণের পর উদ্ধারের ঘটনায় জয়দেবপুর থানা পুলিশ মামলা নিয়েছে নারী নির্যাতন আইনে। মহিলা কাউন্সিলর উদ্ধারের পর সাংবাদিক সম্মেলনে গাজীপুরের পুলিশ সুপার সাংবাদিকদের জানিয়ে ছিলেন ধর্ষণ বা নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
গাজীপুর সদর উপজেলার মির্জাপুর এলাকায় গত জুন মাসে রানী ফুড ফ্যাক্টরিতে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনায় জয়দেবপুর থানা পুলিশ মামলা নিয়েছে চুরির।
এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় গাজীপুরের পুলিশ সুপার আব্দুল বাতেন পিপিএম এর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সভায় জানান, খোঁজ নিয়ে দেখবো চুরির মামলা হয়ে থাকলে ডাকাতির মামলায় রূপান্তর করা হবে।
আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় উপস্থিত থাকতে সদস্যদের অনীহা
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষরিত নোটিশে, গত জুন মাসের জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটি সংশ্লিষ্ট ৫৭ জন সদস্যকে সভায় উপস্থিত থাকার নোটিশ দেয়া হয়। কিন্তু ওই সভায় কমিটির ২৯ জন সদস্য উপস্থিত হন। কমিটির সদস্য নয় এমন ১১ জন বিভিন্ন পেশার লোক উপস্থিত ছিলেন। বিগত ১৫ জুনের সভায় সদস্যদের হাতে দেয়া উপস্থিত অনুপস্থিত নামের তালিকায় পরিশিষ্ট- ‘ক’‘ এ কমিটির অনুপস্থিত সদস্য সংখ্যা ৩৫ জন। এবং উপস্থিত দেখানো হয়েছে ৪৮ জন। তবে কমিটির সদস্য নয় এমন অত্যন্ত ১৩ জনকে সদস্য দেখানো হয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ এই সভায় গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত না থাকায় সভায় সমালোচনা হয়। গাজীপুর পুলিশ বিভাগে কর্মরত বেশির ভাগ কর্মকর্তাদের গ্রামের বাড়ি বিশেষ জেলায় হওয়ায় জেলা পুলিশের সিনিয়র অফিসারদের নির্দেশ আমলে নিতে গড়িমসি করেন বলে গোয়েন্দা বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়।
কালিয়াকৈর পৌর সভার মেয়র মো. মুজিবুর রহমান বলেন, “জেলার আইনশৃঙ্খলায় মাসিক সভায় ব্যস্ততার কারণে খুব কম যাওয়া হয়।”
কাপাসিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান খন্দকার আজিজুর রহমান পেরা বলেন, “সময় মতো সভা অনুষ্ঠিত হলে উপস্থিত হওয়া সম্ভব।”
কমিটির সদস্য ওয়াজ উদ্দিন মিয়া জানান, আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় জন প্রতিনিধিদের অবশ্যই উপস্থিত থাকা জরুরি। এর বাইরে কমিটির সদস্যদের বক্তব্য তেমন গুরুত্ব পায়নি বলে অনেক সদস্য সভায় উপস্থিত হয় না।
এ ব্যাপারে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ও জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি মো. নূরুল ইসলাম জানান, প্রতি মাসের ১০ তারিখ সভাটি হয়। ওই দিন সরকারি বন্ধ থাকলে পরবর্তী কার্যদিবসে সভা অনুষ্ঠিত হয়। যদি রাষ্ট্রিয় কারণে সভা না হয় তাহলে আমরা জানিয়ে দেই। সভায় মোটামুটি অনেকেই উপস্থিতি থাকেন তো অনেক সময় মূল কর্মকর্তারা উপস্থিত হতে পারে না। তার পদস্থ অন্য কর্মকর্তা পাঠান। এ বিষয়টা সরকারের নজরে আনা হয়েছে। অনুপস্থিতির তালিকা ও কে উপস্থিতি হয়েছে তাদের তালিকা সরকারের কাছে পাঠিয়ে দেই। এ কমিটি করেছে সরকার। এটা জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটি ও সভা। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এ সভায় আলোচনা হয়। কেউ অনীহা প্রকাশ করেছে তা আমার জানা নেই। তবে অনেকের অনুপস্থিতি হয়ত কারো কারো দৃষ্টিগোচর হতে পারে আর এটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে এ বিষয়টি সরকারকে অবহিত করা হয়েছে। নিশ্চয়ই সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।