জালিয়াতি করে সরকারি সম্পত্তি দীর্ঘমেয়াদে লিজ নেয়া কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে খোদ মন্ত্রী-সচিবের স্বাক্ষরও অহরহ জাল করা হচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসক কার্যালয় এবং দালাল চক্র অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বলছেন, অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। তদন্ত চলছে এবং সময় হলেই দেখা যাবে কারা এসবের সঙ্গে জড়িত।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২৮ জুন ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর আধাসরকারি পত্র (ডিও) জাল করে গাজীপুরের ডিসিকে চিঠি দেয়া হয়। সিনথিয়া প্যাকেজিং অ্যান্ড এঙ্সেরিজ লিমিটেড নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে ৭৮ শতাংশ সরকারি জমি দীর্ঘমেয়াদে বরাদ্দের জন্য ভূমি প্রতিমন্ত্রী ওই ডিও লেটার দিয়েছেন বলে চিঠিতে উল্লেখ ছিল। প্রতিমন্ত্রীর ডিও লেটার পেয়ে গাজীপুরের ডিসি এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শফিউল আলমের দফতরে ফ্যাঙ্ করেন। সচিবের দফতর থেকে ডিও লেটারের বিষয়টি প্রতিমন্ত্রীকে জানানো হলে তিনি জানান এ ধরনের কোনো ডিও লেটার তিনি দেননি। প্রতিমন্ত্রী ডিসিকে ওই জাল ডিওর ওপর সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। সিনথিয়া প্যাকেজিং অ্যান্ড এঙ্সেরিজ লিমিটেডকে সরকারি জমি বরাদ্দ দেয়ার আবেদনে ধানমন্ডি থেকে নির্বাচিত সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মুস্তাফিজুর রহমান এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মোতাহার হোসেনের সুপারিশ রয়েছে।
এ বিষয়ে সিনথিয়া প্যাকেজিং অ্যান্ড এঙ্সেরিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মাহামুদ আলী বলেন, আমরা আপনার সঙ্গে দেখা করে কাগজপত্র দেব। তিনি এ সংক্রান্ত সংবাদ না করার অনুরোধ করেন।
এ বিষয়ে গাজীপুরের ডিসি মোঃ নুরুল ইসলাম জানান, এখন পর্যন্ত কে বা কারা জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত তা ধরতে পারিনি। তবে একটি মামলা করেছি। কার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন জানতে চাইলে ডিসি বলেন, না, কারও বিরুদ্ধে মামলা করিনি। বিষয়টি তদন্তাধীন। সুতরাং এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলার সময় এখনও আসেনি।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ঘটনাটি তদন্তে জেলা প্রশাসন আন্তরিক নয়। ডিসি অফিস চাইলে তদন্ত করে সবকিছু বের করা অসম্ভব কিছু নয়। তারা আরও জানান, একশ্রেণীর দালাল বিভিন্ন ধরনের আবেদনে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং ক্ষমতাসীনদের সুপারিশ সংগ্রহ করে ওই আবেদনের আলোকে ডিসিকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর জাল ডিও লেটার সংগ্রহ করে দেন। এ ধরনের জালিয়াতির সঙ্গে আদালতপাড়ার দালালদেরও নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে বলে জানান তারা। তারা যখনই কোনো সমস্যায় পড়ছেন, তখন আদালতের আশ্রয় নিয়ে দিব্যি জামিনে বেরিয়ে আসছেন।
এর আগে নাটোরের রানী ভবানী দিঘিটিও জাল কাগজপত্রে দীর্ঘমেয়াদে বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে। জালিয়াতির ঘটনাটি জানাজানি হলে মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব (জরিপ) আবদুল মান্নানকে আহ্বায়ক করে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ৫০ একরবিশিষ্ট নাটোরের ঐতিহাসিক রানী ভবানী দিঘিটি বরাদ্দ দেয়ার সময় মন্ত্রণালয় থেকে তৎকালীন ডিসিকে যে চিঠি দেয়া হয়েছিল ওই চিঠিতে যে এন্ট্রি ও স্মারক নম্বর ব্যবহার করা হয়েছিল, তা পটুয়াখালীর ডিসিকে লেখা একটি চিঠির এন্ট্রি ও স্মারক নম্বর। এমনকি কোন কম্পিউটার থেকে কত ফন্টে তা কম্পোজ করে জাল চিঠিটি ইস্যু করা হয়েছে তা উদ্ঘাটন করা সম্ভব হলেও অপরাধীদের ধরা যায়নি।
তদন্ত করে অনেককিছু জানার পরও শেষ পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি বলে জানান সাবেক যুগ্ম সচিব আবদুল মান্নান। কারণ মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অনেকেই তখন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের রক্ষার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। ঘটনার সঙ্গে নাটোরের সাবেক ডিসি জড়িত এবং রানী ভবানী দিঘি বরাদ্দ নিয়ে নতুন করে তদন্ত করা দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।