অনেক দিনই নিজের পরিচয়ে পরিচিত বলে কথাটা আর শোনা যায় না। তবে একসময় অবধারিতভাবেই তাঁর নাম ছিল ‘নতুন ম্যারাডোনা’। গত দেড়-দুই দশকে আর্জেন্টাইন কেউ একটু ভালো খেললেই এই নাম জুটেছে, ১০ নম্বর জার্সি পরলে তো কথাই নেই। অতি ব্যবহারে একসময় তকমাটা মূল্যও হারিয়েছে। কখনো তো এমনও হয়েছে, আর্জেন্টিনার হয়ে একসঙ্গে মাঠে নেমেছেন তিন-চারজন ‘নতুন ম্যারাডোনা’!
ম্যারাডোনার মতো মেসিও আর্জেন্টিনার অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক। আরেকটি মিল একেবারেই কাকতালীয়।দুজনেরই আন্তর্জাতিক অভিষেক হাঙ্গেরির বিপক্ষে। মেসিকে তাই ‘নতুন ম্যারাডোনা’ নামে ডাকা হবে আশ্চর্য কি!
ইদানীং আর ডাকা হয় না, বরং এখন প্রায়ই বিভিন্ন দেশে ‘নতুন মেসি’র খোঁজ মেলে। এই বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডেই তো ‘আল্পসের মেসি’র সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আসল মেসির। কিন্তু যতই স্বমহিমায় উজ্জ্বল হোন না, অন্তত বিশ্বকাপে মেসির নিস্তার নেই। ম্যারাডোনার গাট্টাগোট্টা শরীরের দীর্ঘ ছায়ায় ঠিকই ঢাকা পড়তে হচ্ছে তাঁকে।
নানা উপলক্ষে নানা প্রসঙ্গে ফিরে আসছেন ম্যারাডোনা। আজ ব্রাসিলিয়ায় কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ বেলজিয়াম বলে যেমন আরও প্রবলভাবে। এই বেলজিয়াম যে ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ ক্যারিয়ারের স্মরণীয় দুটি অধ্যায়। প্রথমটি হতাশার, দ্বিতীয়টি আনন্দের। ১৯৮২ সালে এই বেলজিয়ামের বিপক্ষেই ম্যারাডোনার বিশ্বকাপ অভিষেক আর সেটিতে ১-০ গোলে পরাজয়। তাঁর একটি ফ্রি-কিক ক্রসবার কাঁপিয়ে ফিরে এসেছিল, এর বাইরে ম্যারাডোনা বেলজিয়ান গোলরক্ষক জাঁ-মেরি পাফের তেমন কোনো পরীক্ষাই নিতে পারেননি।
পরের বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে মুখোমুখি হওয়ার আগে সেটি মনে করিয়ে দিয়ে পাফ ঘোষণা করেছিলেন, এবারও ম্যারাডোনাকে গোল করতে দেবেন না। ম্যারাডোনা জবাব দিয়েছিলেন দুই গোল করে। দ্বিতীয়টি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অত্যাশ্চর্য ওই গোলের চেয়ে খুব বেশি পিছিয়ে ছিল না।
একটা মিল কি উঁকি দিচ্ছে এখনই? জাঁ-মেরি পাফের জায়গায় এবার থিবো কোর্তোয়া। তথ্যটা বিস্ময়করই লাগে, গত মৌসুমে ছয়বার মুখোমুখি হয়েও কিনা মেসিকে গোল করতে দেননি বেলজিয়ান গোলরক্ষক! অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার ছয় ম্যাচের ৫টিই ড্র হয়েছিল, অন্যটিতে অ্যাটলেটিকো জিতেছে ১-০ গোলে। পাঁচ ড্রয়ের তিনটি ১-১ গোলে, বার্সার ওই তিনটি গোলের দুটি নেইমারের, অন্যটি করেছেন আলেক্সিস সানচেজ।
বিশ্বকাপ আবারও তাঁকে মেসির মুখোমুখি করে দেওয়ার পর কোর্তোয়া এ কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন বলাটা ভুল হবে; বরং সাংবাদিকেরাই প্রসঙ্গটা তুলেছেন তাঁর সামনে। তোলারই কথা। একটা মৌসুমে ছয়-ছয়টা ম্যাচে কোনো গোলরক্ষক মেসির বিপক্ষে অজেয় থাকলে তাঁকে নিয়ে আলোচনা তো হবেই। আর এই বিশ্বকাপ আরও অনেক বৈশিষ্ট্যের ভিড়ে ‘গোলরক্ষকদেরও বিশ্বকাপ’। গোলপোস্টের নিচে প্রায় অতিমানবীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া সব পারফরম্যান্স। আজ কোর্তোয়ার দিকে আলাদা করে চোখ থাকবেই। মেসির দিকে তো অবশ্যই।
সেটি এমনিতেই থাকে। এই বিশ্বকাপে আরও বেশি। আর্জেন্টিনার এই দলের এমন অবস্থা যে, ‘মেসিই আশা-মেসিই ভরসা-মেসিই ত্রাতা’ মন্ত্র জপ করতে হচ্ছে আর্জেন্টাইন-সমর্থকদের। অনেক বছরের প্রতিষ্ঠিত সত্যকেও নতুন আলোতে দেখছেন অনেকে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের আর্জেন্টিনাকে ‘ম্যারাডোনা ও আরও দশজন’ বললে এত দিন কোনো আপত্তি শোনা যেত না। এখন অনেকে বলছেন, ম্যারাডোনার পাশে তো ভালডানো ও বুরুচাগা ছিল, ডিফেন্সে ছিল রুগেরির মতো আর্জেন্টিনার ইতিহাসের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার। কিন্তু আর্জেন্টিনার এই দলে মেসি ছাড়া আর কেউ আছে নাকি?
কিন্তু ছিলেন তো! বিশ্বকাপ শুরুর আগে মেসির সঙ্গে হিগুইয়েন ও আগুয়েরোর গড়া আক্রমণের ত্রিফলা নিয়ে কত কথা! আগুয়েরোর এমনই অবস্থা যে, চোট পেয়ে তাঁর বাইরে চলে যাওয়াটাকে ‘শাপে বর’ ভাবার মতো লোকের অভাব ছিল না। তাঁর বদলে আসা লাভেজ্জির এই বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় ‘কীর্তি’ কোচ আলেসান্দ্রো সাবেলার গায়ে পানি ছিটানো। আর্জেন্টিনার আক্রমণের আরেক ‘ফলা’ অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া রিয়াল মাদ্রিদের পক্ষে দারুণ একটা মৌসুম কাটিয়ে এসেছেন। নিজেকে যেন নিঃশেষও করে এসেছেন সেখানেই। সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে জয়সূচক গোলটি করেছেন বটে, তবে যেটিকে ব্যঙ্গ করে বলা হচ্ছে ‘ইতিহাসের জঘন্যতম ম্যাচজয়ী পারফরম্যান্স’! ৫১ বার বল প্রতিপক্ষের পায়ে তুলে দিয়েছেন, ১৯ বার চেষ্টা করে বলার মতো ক্রস করতে পেরেছেন মাত্র ৪টি।
আর্জেন্টিনার খেলা দেখে ম্যারাডোনা তাই যারপরনাই বিরক্ত। কিন্তু শুধু বিরক্তি আর হতাশা প্রকাশ করলে তিনি ম্যারাডোনা কেন? নিজের ভেতরে প্রচণ্ড শক্তিশালী একটা অনুভূতি টের পাচ্ছেন বলে জানিয়ে সেটির বর্ণনায় ব্যবহার করেছেন ‘তিক্ততা’, ‘ক্রোধ’, ‘হতাশা’ ইত্যাদি। আর্জেন্টিনা এখনো সামর্থ্যের ৪০ ভাগও খেলতে পারেনি দাবি করে ম্যারাডোনা বলেছেন, এমন চলতে থাকলে আর্জেন্টিনা ‘স্পোর্টিং মেসি’তে পরিণত হবে।
‘স্পোর্টিং মেসি’ বলতে নিশ্চয়ই মেসির নামে কোনো ক্লাব বুঝিয়েছেন। তা আর্জেন্টিনা তো এই বিশ্বকাপে ‘স্পোর্টিং মেসি’-ই। ১৯৮৬ বিশ্বকাপের প্রথম চার ম্যাচে ম্যারাডোনা গোল করেছিলেন মাত্র একটি। সেখানে এই বিশ্বকাপে মেসির চারটি গোল হয়ে গেছে। আর্জেন্টিনার সাত গোলের একটি আত্মঘাতী। বাকি দুটি গোলেও অবদান আছে তাঁর। কোয়ার্টার ফাইনালের আগ পর্যন্ত এই বিশ্বকাপে সতীর্থদের গোলের সুযোগ তৈরি করে দেওয়াতেও সবার ওপরে মেসি (১৮টি)। ড্রিবলিংয়েও তিনিই এক নম্বর।
কিন্তু এসব দেখে ম্যারাডোনার গর্ব হবে কী, উল্টো মায়া হচ্ছে মেসির জন্য। মেসির নিজেরই ‘কিড’ আছে, গ্যালারিতে তাকে নিয়মিত দেখাও যাচ্ছে, তার পরও মেসির প্রতি ভালোবাসা বোঝাতে ‘কিড’ শব্দটাই ব্যবহার করে বলেছেন—‘দ্য কিড ইজ ভেরি অ্যালোন।’
ম্যারাডোনার ভয়ও হচ্ছে। বাকিদের যে অবস্থা, তাতে মেসির হঠাৎ একটা খারাপ দিন এলেই তো সর্বনাশ। তখন না আবার সবাই মেসির ওপরই সব দোষ চাপিয়ে দেয়! আজ বেলজিয়ামের বিপক্ষে সেই ভয়কে সঙ্গী করেই মাঠে নামবে আর্জেন্টিনা।
শুধু ভয় কেন, সঙ্গে আশাটাও তো মাঠে নামবে। আশার নাম লিওনেল মেসি। মেসির মনেও একটা ভয় খেলা না করে পারে না। তাঁর কাছে বিশ্বকাপ মানেই যে কোয়ার্টার ফাইনালে সব শেষ! ২০০৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার বিদায় দেখেছিলেন বেঞ্চে বসে। গতবার মাঠে নেমেও পিষ্ট হতে হয়েছে জার্মান বুলডোজারে।
এবার সেই গল্পটাও নতুন করে লেখার দায় লিওনেল মেসির।