ইউরিয়া ও খাওয়ার সোডা মিশ্রিত মুড়িতে বাজার সয়লাব

শেখ আব্দুল আওয়াল, শ্রীপুর থেকে ফিরে ॥ খোলায় মাত্র চার-পাঁচ মিনিট চাল গরম হওয়ার পর ছিটিয়ে দেয়া হয় ইউরিয়া মিশ্রিত পানি। পনের মিনিট পর জ্বলন্ত চুলার খোলা থেকে চাল উঠিয়ে রাখা হয় ময়লা স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে। মেঝেতে সোডিয়াম বাই কার্বনেট ও সালফার মিশিয়ে চাল উত্তপ্ত বালুর চোঙ্গায় ঢেলে দিলে মুহূর্তেই মুড়মুড় করে ফুটে তৈরি হয়ে যায় সুস্বাদু নরম ফাঁপা ধবধবে সাদা মুড়ি। প্রতিদিন এমন প্রক্রিয়ায় গাজীপুরের শ্রীপুরে প্রায় ডজনখানেক কারখানায় টনের পর টন সুস্বাদু বিষের মুড়ি তৈরি হচ্ছে। নিরীহ মানুষ নিজের অজান্তেই মুখে তুলে নিচ্ছে এই বিষ!

সরেজমিন মুড়ি তৈরির পাঁচ-ছয়টি কারখানায় গিয়ে এমন ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে। কারখানার মালিকরা নৈপুণ্য প্রমাণ করে প্রতিযোগিতার বাজার ধরতে দিনের পর দিন চালে ইউরিয়া ও সালফার মিশিয়ে মুড়ি তৈরি করছে। কারখানায় তৈরি নরম ধবধবে সাদা মুড়ি হাত বদল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে। আর এ সুস্বাদু মুড়ি খেয়ে মানুষ নানা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।

জানা গেছে, গত কয়েক বছরের ব্যবধানে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ঘেঁষে শ্রীপুরের মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় প্রায় ডজনখানেক মুড়ি তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। কারখানাগুলোতে প্রতিদিন টনের পর টন মুড়ি তৈরি হচ্ছে। সারাবছর মুড়ির চাহিদা থাকলেও পবিত্র রমজানে এ চাহিদা চারগুণ বেড়ে যায়। রোজাদারদের চাহিদা পূরণে সুস্বাদু নরম মুড়ি তৈরির প্রতিযোগিতায় নামে কারখানা মালিকরা। বছরজুড়ে মুড়ি তৈরিতে বিষাক্ত নানা কেমিক্যাল মেশালেও পবিত্র রমজানে বাজারে ব্যাপক চাহিদা বাড়াতে তৈরি মুড়িতে এ সব কেমিক্যালের পরিমাণ আরও বাড়ে।

সরেজমিন মুড়ি তৈরির পাঁচ-ছয়টি কারখানায় গিয়ে পিলে চমকানো চিত্র চোখে পড়ে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পশ্চিম পাশে পল্লীবিদ্যুত এলাকায় আল আমিন কারখানায় গিয়ে দেখা গেছেÑ কারখানার দোতলার পশ্চিমে একটি কক্ষে তৈরি হচ্ছে মুড়ি। কক্ষের ভেতর কাজে মশগুল ১২-১৪ জন শ্রমিক। দুই পাশ থেকে চার শ্রমিক বস্তায় বস্তায় চাল দিচ্ছেন গ্যাসের চুলার উত্তপ্ত খোলায়। মাত্র চার-পাঁচ মিনিট পর আরও দুই শ্রমিক খোলায় গরম চালে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছেন। পনের মিনিট পর খোলা থেকে চাল নামিয়ে রাখা হচ্ছে ময়লা স্যাঁতসেঁঁতে মেঝেতে। মেঝেতে আরও দুটি উপকরণ মিশিয়ে চাল চোঙ্গায় দিতেই মুড়মুড় চাল ফুটে ধবধবে সাদা মুড়ি তৈরি হয়ে যায়। কারখানার তরুণ এক শ্রমিককে বাইরে নিয়ে কথা বলে জানা গেছে, উত্তপ্ত খোলায় চার-পাঁচ মিনিট চাল গরম হওয়ার পর ছিটিয়ে দেয়া হয় ইউরিয়া মেশানো পানি। পনের মিনিট পর খোলা থেকে চাল নামিয়ে মেঝেতে রেখে একটু ঠা-া করে মেশানো হয় সোডিয়াম বাই কার্বনেট ও সালফার। গরম চালে এ সব কেমিক্যাল মিশিয়ে চোঙ্গায় চাল দিতেই মুহূর্তে মুড়মুড় চাল ফুটে নরম সাদা মুড়ি তৈরি হয়ে যায়। বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো চাল দিয়ে তৈরি মুড়ি ফাঁপানো ও সুস্বাদু।

মুড়ি তৈরির কারখানার শ্রমিকরা জানান, কারখানায় গ্যাসের চুলায় উত্তপ্ত খোলায় চাল গরম করে মুড়ি তৈরি হয়। রাত-দিন চুলা জ্বলন্ত থাকায় কারখানায় এ কক্ষটিও উত্তপ্ত থাকে। ফলে শ্রমিকদের ঘামে কক্ষের পুরো মেঝে থাকে স্যাঁতসেঁতে অবস্থা। ময়লা-নোংরা খোলা মেঝে থেকেই প্যাকেটজাত করে মুড়ি গুদামজাত করা হয়।

কারখানার মালিক আবুল কালাম দাবি করেন, ‘তাঁর কারখানায় তৈরি মুড়িতে কোন বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো হয় না।’ তবে কারখানার মালিক আবুল কালামের ছোট ভাই আব্দুল মালেক জানান, মুড়ি তৈরির জন্য দিনাজপুরের বিভিন্ন চালকল মালিকদের কাছ থেকে তাঁরা বিভিন্ন জাতের চাল কেনেন। ভাল মুড়ি তৈরির জন্য চালকল মালিকরা কোন কেমিক্যাল মিশিয়ে থাকেন কিনা তাঁদের জানা নেই।

পাশের আকলিমা ফুড প্রোডাক্ট কারখানায় রাত-দিন উৎপাদন হচ্ছে মুড়ি। শ্রমিকরা বস্তায় বস্তায় চাল খোলায় ঢালছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আকলিমা ফুড প্রোডাক্টের এক শ্রমিক জানান, সকল কারখানায় একইভাবে মুড়ি তৈরি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘সার মেশাইন্যা পানি ছিডাইয়া চাইল গরম কইরা খোলাততে নামানোর পরে কারিগররা চাইল একটু ঠা-া কইরা সোডার লগে আরও একটা পাউডার মিশাইয়া চাল চোঙ্গায় ঢালে।’
তবে কারখানার শ্রমিকরা মুড়ি উৎপাদনকালে চালে শুধু সোডা (সোডিয়াম কার্বনেট) মেশানোর কথা স্বীকার করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুড়িতে দুই দফা চালে বিষাক্ত কেমিক্যালের মিশ্রণ ঘটে। ধান থেকে চাল তৈরির পর চালকল মালিকরা সালফার মিশিয়ে বস্তায় বস্তায় চাল মুড়ি তৈরির জন্য কারখানা মালিকদের কাছে বিক্রি করছেন। দিনের পর দিন এ চাল কারখানার গুদামে পড়ে থাকে। কেমিক্যাল মিশ্রিত থাকায় মুড়ি উৎপাদনকালে চাল উপযোগী থাকে। উপরন্তু ফের মুড়িকে আরও আকর্ষণীয় করতে কারখানা মালিকরা চালে ইউরিয়া, সোডিয়াম কার্বনেট ও সালফার মেশায়।

আশপাশের আকলিমা ফুড, আল মদিনা, ভাই ভাই ফুড ও নিউ আল আমিন মুড়ি তৈরির কারখানায় গিয়ে দেখা গেছে একই রকম চিত্র।

শ্রীপুরের ছাপিলাপাড়া এলাকায় বন্ধ থাকা মুড়ি তৈরির কারখানা সোহাগ ফুডের মালিক রেজাউল করিম জানান, অনেক আগে থেকে মুড়ি তৈরি কালে চালে ইউরিয়া মেশানো হতো। এখন শুধু ইউরিয়ায় মুড়ি নরম ও ফাঁপানো যাচ্ছে না। তাই মুড়ি তৈরিকালে খোলা থেকে চাল উঠিয়ে সোডিয়াম কার্বনেট ও সালফার মেশানো হচ্ছে। সোডিয়াম কার্বনেট ও ইউরিয়া সহজলভ্য হলেও সালফার যেখানে-সেখানে কিনতে পাওয়া যায় না। তবে মুড়ি তৈরির কারখানায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চড়া দরে সালফার পৌঁছে দিচ্ছে।

মুড়ি তৈরির কারখানা মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পবিত্র রমজানে রোজাদারদের প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে মুড়ি। তাই মুড়ির চাহিদাও বাড়ে। রোজাদারদের চাহিদার যোগান দিতে পবিত্র রমজান শুরু হওয়ার আগেই প্রস্তুতি থাকে কারখানা মালিকদের।

মাওনা চৌরাস্তার জননী কারখানার পরিচালক আবদুল মান্নান জানান, রমজানের আগে তাঁদের কারখানায় প্রতিদিন এক টন মুড়ি তৈরি করতেন। রমজান শুরুর পর চাহিদা বাড়ায় এখন প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই টন মুড়ি উৎপাদন করছেন। তাঁদের উৎপাদিত মুড়ি ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, নরসিংদী ও রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করছেন। মুড়িতে বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানোর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা কারখানায় মুড়িতে কোন কেমিক্যাল মেশাই না। তবে চালকল মালিকরা মুড়ি উৎপাদনের জন্য ধান থেকে চাল তৈরির পর কেমিক্যাল মিশিয়ে থাকতে পারেন।’

মুড়ি উৎপাদনকালে মেশানো বিভিন্ন কেমিক্যালের বিষয় নিয়ে শ্রীপুর রহমত আলী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, কারখানায় ইউরিয়া ছাড়াও চালে মেশানো হয়ে থাকে হাইড্রোজ। হাইড্রোজের কেমিক্যালের নাম সোডিয়াম কার্বনেট, যা মূলত খাইসোডা। খাদ্যে বেশি পরিমাণ খাইসোডা ব্যবহারের কারণে মানবদেহে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। এ ছাড়া মুড়ি উৎপাদনকালে চালে মেশানো সালফারের অনেক রূপভেদ রয়েছে। তবে সকল প্রকার সালফারই খাদ্যে ব্যবহার মারাত্মক ক্ষতিকর।

গাজীপুরের সিভিল সার্জন শাহ আলম শরীফ বলেন, ‘এ সব কেমিক্যাল মিশ্রিত খাবার খেয়ে তাৎক্ষণিক বদহজম, বমি বমি ভাব ও মাথাধরা শারীরিক সমস্যা হতে পারে। তবে শরীরে বিষক্রিয়া থেকেই যাবে। এতে মানুষের শরীরে স্থায়ীভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। লিভারের কর্মক্ষমতা কমে ও কিডনি বিকল হয়ে পড়ে। এ ছাড়া এ সব কেমিক্যাল মিশ্রিত খাবার খেয়ে ক্যান্সারসহ নানা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।

সূত্রঃ জনকণ্ঠ




নাম

অর্থ ও বাণিজ্য,237,আন্তর্জাতিক,732,কাপাসিয়া,343,কালিয়াকৈর,418,কালীগঞ্জ,253,খেলা,644,গাজীপুর,3942,চাকরির খবর,34,জয়দেবপুর,1581,জাতীয়,2968,টঙ্গী,912,তথ্যপ্রযুক্তি,512,ধর্ম,196,পরিবেশ,137,প্রতিবেদন,310,বিজ্ঞান,55,বিনোদন,698,ভিডিও,58,ভিন্ন খবর,142,ভ্রমন,115,মুক্তমত,27,রাজধানী,829,রাজনীতি,1057,লাইফস্টাইল,283,শিক্ষাঙ্গন,398,শীর্ষ খবর,10776,শ্রীপুর,481,সাক্ষাৎকার,12,সারাদেশ,649,স্বাস্থ্য,212,
ltr
item
GazipurOnline.com: ইউরিয়া ও খাওয়ার সোডা মিশ্রিত মুড়িতে বাজার সয়লাব
ইউরিয়া ও খাওয়ার সোডা মিশ্রিত মুড়িতে বাজার সয়লাব
http://2.bp.blogspot.com/-jkQF6YAYFFw/U7xItFMJByI/AAAAAAAAItw/fYInQKGBlKQ/s1600/muri.jpg
http://2.bp.blogspot.com/-jkQF6YAYFFw/U7xItFMJByI/AAAAAAAAItw/fYInQKGBlKQ/s72-c/muri.jpg
GazipurOnline.com
https://www.gazipuronline.com/2014/07/muri.html
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/
https://www.gazipuronline.com/2014/07/muri.html
true
13958681640745950
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Read More Reply Cancel reply Delete By প্রচ্ছদ PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share. STEP 2: Click the link you shared to unlock Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy