নয়াদিল্লি: ভারতে কোটি কোটি মানুষ যে শিরডি সাইবাবার ভক্ত, হিন্দুদের মন্দিরে তাঁর ঠাঁই হওয়া উচিত নয় বলে বিরাট বিতর্ক তৈরি করেছেন দেশের প্রধান ধর্মগুরুদের একজন শঙ্করাচার্য স্বরূপানন্দ সরস্বতী।
শঙ্করাচার্য বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, শিরডির সাইবাবা আল্লাহর উপাসনা করতেন এবং ছাগল কেটে মাংস পর্যন্ত খেতেন – তাই তাকে হিন্দুরা কিছুতেই পূজা করতে পারে না।
এই মন্তব্যের প্রতিবাদে সাইবাবার ভক্তরা গোটা দেশ জুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে নেমেছেন।
শঙ্করাচার্যের বিরুদ্ধে কেন এফআইআর হবে না সেই প্রশ্নে এলাহাবাদ হাইকোর্টে শুক্রবার শুনানিও হতে যাচ্ছে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর বলিউডে সবচেয়ে স্মরণীয় যে ছবিগুলো হয়েছে, তারই অন্যতম অমর আকবর অ্যান্টনির ভীষণ জনপ্রিয় গান ছিল ‘শিরডি ওয়ালে সাইবাবা’ – গেয়েছিলেন মহম্মদ রফি।
আর যাকে নিয়ে এই গান, তিনি ভারতের সবচেয়ে পূজিত সন্তদের একজন – মহারাষ্ট্রের শিরডির সাইবাবা। গোটা দেশ জুড়ে তার ভক্তের সংখ্যা কোটি কোটি, তাতে নানা ধর্মের মানুষই আছেন। আর ভারতজুড়ে আছে অজস্র সাইবাবার মন্দির।
কিন্তু এহেন সাইবাবাকে হিন্দুদের কখনওই পূজা করা উচিত নয়, সরাসরি বলেছেন হিন্দুদের অন্যতম প্রধান ধর্মগুরু শঙ্করাচার্য স্বরূপানন্দ সরস্বতী।
তার যুক্তি হল, ‘যিনি আল্লাহ্ ছাড়া কারও নাম নিতেন না, গঙ্গাকে মানতেন না, ছাগল কেটে মাংস পর্যন্ত খেতেন তাকে কীভাবে হিন্দুরা পুজো করতে পারে?’
সাইবাবার নামে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে, কিন্তু তার পেছনে আসলে হিন্দু একতাকে দুর্বল করার বিদেশি ষড়যন্ত্র আছে, এমন অভিযোগও করেছেন শঙ্করাচার্য।
নব্বই বছর বয়সী ধর্মগুরু বলছেন, ‘বৃটেনের মতো দেশগুলোই এসব করাচ্ছে – যাতে ভারত হিন্দুপ্রধান দেশ না-থাকে, হিন্দুরা যাতে নানা ভাগে ভাগ হয়ে যায়। সংঘবদ্ধভাবে হিন্দুরা যাতে কিছু করতে না-পারে, তার জন্যই এত কিছু করা হচ্ছে।’
শঙ্করাচার্যের এই বক্তব্য প্রচারিত হওয়ার পরই সারা দেশে সাইবাবার ভক্তরা রাস্তায় নেমে এসেছেন। শিরডিতে তো বটেই, বারাণসী-লখনোউ-জয়পুর-দিল্লি সর্বত্রই এই ভক্তরা তুমুল প্রতিবাদ জানাচ্ছেন এবং বলছেন সাইবাবার প্রতি তাদের ভক্তি কোনো মতেই টলবে না।
তারা কেউ বলছেন, এসব সম্পূর্ণ আজেবাজে কথা। সাই ভগবানের প্রতি আমার শ্রদ্ধা অটুট থাকবে। কেউ বলছেন, সাইবাবার কাছে সব ইচ্ছা পূর্ণ হয়, তিনি তার প্রমাণ পেয়েছেন। আবার কারও দাবি সাইবাবা যে ভগবান ছাড়া কিছু নন তিনি নিজে সেটা অনুভব করছেন।
বিতর্ক এখন আদালতেও গড়িয়েছে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্য কেন শঙ্করাচার্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না – সেই প্রশ্ন তুলে দুটো মামলা হয়েছে লখনৌ আর জয়পুরে।
আর এরই মাঝে শক্তিশালী নাগা সন্ন্যাসীরা শঙ্করাচার্যের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তারা বলছেন তাকে কেউ অপমান করলে রাস্তায় আগুন জ্বলবে।
কিন্তু শিরডি সাইবাবার যে পরধর্মসহিষ্ণু আচরণ নিয়ে এত বিতর্ক, সেটা কিন্তু ভারতে হিন্দু ধর্মগুরুদের মধ্যে মোটেই বিরল নয়, বিবিসিকে বলছিলেন ধর্মতত্বের ঐতিহাসিক ড: নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী।
ড: ভাদুড়ী জানাচ্ছেন, ‘শ্রীচৈতন্যর কীর্তনের দলে সবার আগে থাকতেন যবন হরিদাস। শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেও ইসলাম ধর্মমতে সাধনা করেছিলেন, বলেছিলেন যত মত তত পথ!’
‘কিন্তু এই ধরনের উদারতা বা সহিষ্ণুতা যেহেতু সকলে দেখাতে পারেন না, তাই অমুকে ভাল বা তমুক খারাপ বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে যায়’, বলছেন ড: ভাদুড়ী।
শঙ্করাচার্য স্বরূপানন্দ সরস্বতী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কট্টর বিরোধী ও কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। তাই গোটা বিতর্কে অবধারিতভাবে রাজনীতির রংও লেগেছে।
তবে সাইবাবাকে পূজা না করতে বলার মধ্যে কংগ্রেসের উসকানি আছে, এমন অভিযোগ জোরালোভাবে অস্বীকার করেছেন তিনি।
সূত্র: বিবিসি