স্টাফ রিপোর্টারঃ শিল্প, গৃহস্থালি, হাসপাতাল— সব বর্জ্যেরই গন্তব্য তুরাগ নদ। গাজীপুরে তুরাগতীর ঘিরে গড়ে ওঠা অনেক শিল্প-কারখানার বর্জ্য পরিশোধন ছাড়াই মিশছে এর পানিতে। দূষণকারীর তালিকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানই কেবল নয়, রয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের নামও। এমনকি খোদ সিটি করপোরেশনও আছে এ তালিকায়। আর ক্রমান্বয়ে এ দূষণে বিষাক্ত হয়ে উঠছে তুরাগের পানি। বিপন্ন হচ্ছে জলজ প্রাণী। বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকিও।
তুরাগ দূষণকারী বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। কামারপাড়া সেতু থেকে ইছাপুরা রাজউক পূর্বাচল সিটি পর্যন্ত দূষণের একটি চিত্র উঠে এসেছে এ প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়েছে, ভূ-উপরিতলের (সারফেস) ড্রেন, পাইপ, পিভিসি পাইপ ও ফেরো সিমেন্ট পাইপের মাধ্যমে রেডি মিক্স ও টেক্সটাইল বর্জ্য তুরাগে ফেলা হচ্ছে। মিশছে ওয়াশিং অ্যান্ড ডায়িং কারখানাগুলোর বিষাক্ত বর্জ্যও। বাদ নেই হাসপাতাল ও গৃহস্থালি বর্জ্যও। এসব বর্জ্য তুরাগে যাচ্ছে ৩৬টি পয়েন্টে ৪৫টি উৎসমুখের মাধ্যমে।
নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তালিকা অনুযায়ী, তুরাগ দূষণকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে কনক্রিট, আনন্দ জেরিন টেক্সটাইল, হাসীম ওয়াশিং অ্যান্ড ডায়িং, আনন্দ গোডাউন, বেঙ্গল ডায়িং অ্যান্ড নিটিং, আজমিরি গার্মেন্টস, ঢাকা ডায়িং, মেহমুদ হোসেন ডায়িং অ্যান্ড প্রিন্টিং লিমিটেড, এভার ওয়ে ডায়িং, মার্চেন্ট ডায়িং, জাবের জুবায়ের, সার্ফ ফিটিং ওয়াশিং প্লান্ট ও প্যারাডাইস ওয়াশিং প্লান্ট। প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের শিল্পবর্জ্য পরিশোধন না করেই তুরাগে ফেলছে।
তবে দূষণের অভিযোগ অস্বীকার করেন ঢাকা ডায়িং অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির উপমহাব্যবস্থাপক (অর্থ ও প্রশাসন) বিসি সাহা। তিনি বলেন, ‘আমাদের কারখানায় বর্জ্য পরিশোধনের জন্য ইটিপি রয়েছে। পরিশোধন করার পরই বর্জ্য নদীতে ফেলি আমরা।’
অন্যদিকে নগরীর মোট নয়টি পয়েন্ট দিয়ে শিল্প ও গৃহস্থালি বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলছে গাজীপুর সিটি করপোরেশন। মেডিকেল বর্জ্য ফেলছে আইচি হাসপাতাল লিমিটেড। টঙ্গী বিসিক থেকে বিষাক্ত বর্জ্য তুরাগে ফেলা হচ্ছে দুটি ড্রেনের মাধ্যমে।
জানতে চাইলে গাজীপুর জেলা প্রশাসক মো. নূরুল ইসলাম বলেন, শিল্প মালিকরা বর্জ্য পরিশোধন না করেই নদীতে ফেলছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানোও হয়েছে বিষয়টি। জেলা প্রশাসক সম্মেলনেও বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্স এ নিয়ে কাজ করছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গাজীপুরের বিভিন্ন পয়েন্টে সরাসরি পাইপ ও নালা দিয়ে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে নদীতে। সারফেস ড্রেনগুলো থেকে অনবরত নদীতে পড়ছে বর্জ্য। আবদুল্লাহপুর, টঙ্গী বাজার, ইজতেমা মাঠ, রেলওয়ে সেতুসংলগ্ন নদীর পানিতে ভাসমান বর্জ্যের স্তূপ পড়ে আছে। ফলে এর পানি হয়ে পড়ছে ব্যবহার অনুপযোগী। মাছের দেখাও সেভাবে মিলছে না। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তালিকার বাইরেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নদীর পাড়েই জিন্স কাপড় রঙ করে কেমিক্যাল মিশ্রিত বর্জ্য ফেলছে নদীতে।
পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মো. আলমগীর বলেন, অধিদফতরের পক্ষ থেকে নিয়মিত পরিদর্শনে দূষণকারীদের জরিমানা করা হচ্ছে। দোষী কারখানাও অনেক সময় বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। তার পরও অগোচরে অনেকে বর্জ্য ফেলছে নদীতে।
তিনি আরো বলেন, টঙ্গী বিসিকের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) স্থাপনে চার মাস সময় দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে তারা ইটিপি স্থাপন না করলে সেখানকার শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হবে।
টঙ্গী রেলওয়ে সেতুর নিচে জিন্স কাপড় রঙ করছিলেন সখিনা বেগম। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রতি প্যান্টে ১০ টাকা করে পাই। তাই কাজ করি। এখানে কাজ হলে বর্জ্য তো নদীতে যাবেই।’ সখিনার মতো আরো অনেককেই দেখা যায় একই কাজে।
এ প্রসঙ্গে নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, নদী দূষণমুক্ত করতে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। কিছু কিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হচ্ছে। বাকিগুলোও পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন হবে। নদী দূষণ রোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে। এজন্য বেশকিছু সচেতনতামূলক কর্মসূচিও হাতে নেয়া হয়েছে। দূষণ রোধে কাজ হচ্ছে, আস্তে আস্তে তুরাগও দূষণমুক্ত হবে।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ২০০৭ অনুযায়ী, মৎস্য ও জলজ প্রাণী বেঁচে থাকার জন্য প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকতে হয় ৫ মিলিগ্রামের বেশি। তবে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও ডব্লিউবিবি ট্রাস্টের পরীক্ষায় দেখা গেছে, সিদ্ধিরটেক ও আশুলিয়া বি আইডব্লিউটিএ টার্মিনালসংলগ্ন তুরাগের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন রয়েছে প্রতি লিটারে ১ দশমিক ১১ মিলিগ্রাম। তবে গাবতলী ও টঙ্গী টার্মিনাল, বিরুলিয়া, কাশিমপুর বাজার, টঙ্গী সেতু, টঙ্গী রেলওয়ে সেতু এলাকায় তা আরো কম ১ মিলিগ্রাম। আর পানিতে ক্ষারের গ্রহণযোগ্য মাত্রা প্রতি লিটারে ৭ মিলিলিটারের কম হলেও প্রতিটি পয়েন্টেই তা বেশি।
নদী দূষণ ও দখল রোধে জনস্বার্থে একাধিক রিটকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ঢাকার আশপাশের নদ-নদীগুলো দূষণমুক্ত রাখতে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। এ নির্দেশনা ভঙ্গ করে নদী দূষণের কোনো সুযোগ নেই। যারা বর্জ্য ফেলছে, তারা যেমন অপরাধী, একইভাবে দূষণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়াও অপরাধ।
হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকায় সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে বলে জানান মো. নূরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। ঈদের আগে দূষণকারীদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান চালানো হবে। রাতারাতি না হলেও ধীরে ধীরে তুরাগ দূষণমুক্ত করা হবে।