জনস্বার্থে বিদ্রোহ, নৈরাজ্য, হিংসাত্মক ঘটনা সম্প্রচার না করার বিধান রেখে ‘জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা, ২০১৪’ এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে নীতিমালা অনুযায়ী একটি স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন গঠন করা হবে।
সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সভাকক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে সোমবার এ অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা প্রেস ব্রিফিংয়ে এ অনুমোদনের কথা জানান।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, সম্প্রচার মাধ্যমের জন্য এটি প্রথম পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা। সংশ্লিষ্ট সকলের মতামত নিয়ে এ নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে সাতটি অধ্যায় রয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে পটভূমি, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও নীতিমালা বাস্তবায়নের কৌশল উল্লেখ করা হয়েছে।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে সম্প্রচার লাইসেন্সের বিষয়ে বলা হয়েছে। এখানে লাইসেন্স প্রদান ও পদ্ধতি এবং এ ক্ষেত্রে সম্প্রচার কমিশনের ভূমিকা। নীতিমালায় একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। আইনের মাধ্যমে এ কমিশন গঠিত হবে। শিগগিরই এটি করা হবে। লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে কমিশনের একটি বড় ভূমিকা থাকবে।
সংবাদ ও অনুষ্ঠান সম্প্রচারের বিষয়ে বলা হয়েছে তৃতীয় অধ্যায়ে। বিশেষ করে অনুসরনীয় মানদণ্ড কি হবে সে বিষয়টি এখানে আছে। এখানে বলা হয়েছে সংবাদ ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সম্প্রচার মাধ্যমকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখা, আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ লালন, উন্নয়নমূলক বিষয় জনগণের কাছে তুলে ধরতে হবে।
চতুর্থ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, কি কি বিষয় অনুসরণ করে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হবে। বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে পণ্যের মান ও ভোক্তা অধিকার সমুন্নত রাখতে হবে। বিজ্ঞাপনও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আমাদের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ সহায়ক হতে হবে। একই সঙ্গে শিশু ও নারী অধিকার সুরক্ষা করতে হবে।
পঞ্চম অধ্যায়ে সম্প্রচারের ক্ষেত্রে আরও কিছু বিবেচ্য বিষয়ের কথা বলা হয়েছে। কোন কোন বিষয় সম্প্রচার করা যাবে না, করা সমীচিন হবে না তা উল্লেখ রয়েছে এখানে।
ষষ্ঠ অধ্যায়ে সম্প্রচার কমিশনের বিষয়ে বলা হয়েছে। কমিশন গঠন, আইনী কাঠামো, দায়িত্ব, কাজের পদ্ধতি, কি কি অভিযোগ গ্রহণ ও নিস্পত্তি করবে এ বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী সব সম্প্রচার মাধ্যমকে লাইসেন্স নিতে হবে। এ জন্য লাইসেন্স ফি পরিশোধ করতে হবে। এ কাজগুলো সম্প্রচার কমিশনের মাধ্যমে করা হবে। কমিশন সম্প্রচার মাধ্যমগুলোর মনিটরিংয়ের কাজও করবে।
মন্ত্রিপরিষ সচিব বলেন, ‘কোনো কোনো বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা সরকারকে সুপারিশ করবে।’
সপ্তম অধ্যায়ে বিবিধ বিষয় রয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘কমিশন গঠন না হওয়া পর্যন্ত কীভাবে কার্যক্রম পরিচালিত হবে সে বিষয়সহ বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে এ অধ্যায়ে। কমিশন ও আইন না হওয়া পর্যন্ত সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রচার-সম্পর্কিত সব সিদ্ধান্ত নেবে।’
কোন বিষয় সম্প্রচার করা যাবে না বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘জাতীয় আদর্শ ও উদ্দেশের প্রতি ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করা, জনগণের প্রতি অবমাননা, স্বাধীন অখন্ড বাংলাদেশের সংহতি ক্ষুণ্ন হতে পারে এমন দৃশ্য ও বক্তব্য প্রচার করা যাবে না।’
এ ছাড়া এমন কিছু প্রচার না করা যা অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে, বিভিন্ন শ্রেণী ও ধর্মের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে পারে। ব্যক্তির প্রাইভেসির জন্য ক্ষতিকর কিছু প্রচার করা যাবে না, জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এমন কিছুও প্রচার করা যাবে না বলেও জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আঘাত হানতে পারে, এমন ক্ষতিকর কিছু প্রচার করা যাবে না। কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের অনুকূলে এমন কিছু প্রচার করা যাবে না, যা অন্য কোনো বিদেশি রাষ্ট্রকে আঘাতের কারণ হয়। জনস্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারে এমন কোনো বিদ্রোহ, নৈরাজ্য ও হিংসাত্মক ঘটনা প্রচার পরিহার করতে হবে। এমন কিছু প্রচার করা যাবে না যা দুর্নীতিকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করে। বিভিন্ন মতাবলম্বীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে এমন কিছু প্রচার করা যাবে না বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।’
সশস্ত্র বাহিনী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কোনো বাহিনীর প্রতি কটাক্ষ বা বিদ্রুপ করে কোনো কিছু প্রচার করাও যাবে না বলেও জানান মোশাররাফ হোসাইন।
টকশোর বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘আলোচনামূলক অনুষ্ঠানে কোনো ধরনের বিভ্রান্তমূলক ও অসত্য তথ্য ও উপাত্ত দেওয়া পরিহার করতে হবে। এ ধরণের অনুষ্ঠানে সকল পক্ষের যুক্তিসমূহ যথাযথভাবে উপস্থাপনের সুযোগ থাকতে হবে বলে নীতিমালায় বলা হয়েছে।
নীতিমালা কার্যকরের সময় সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘নীতিমালার গেজেট জারির সময় থেকেই এটি কার্যকর হবে। তবে নীতিমালা পুরোপুরি বাস্তবায়নের জন্য আইন ও বিধিমালা করতে হবে। এ নীতিমালা শুধু বেসরকারি সম্প্রচার মাধ্যমের জন্য নয়, সরকারি সম্প্রচার মাধ্যমকেও এ নীতিমালা মানতে হবে।’
অপরদিকে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু মন্ত্রিসভায় নীতিমালা অনুমোদনের পর সচিবালয়ে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নীতিমালার গেজেট জারি করা হবে।’
সম্প্রচার কমিশন গঠন না হওয়া পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে নীতিমালা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়, এ জন্য আমাদের কিছুটা সময় লাগবে বলেও মন্তব্য করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
মোশাররাফ হোসাইন আরও বলেন, ‘আইন হওয়ার পর এই কমিশনের চেয়ারম্যান ও আইনের দ্বারা নির্ধারিত সদস্য নিয়োগ করা হবে এবং সার্চ কমিটির মাধ্যমে কমিশন গঠন করতে হবে, সদস্যদের মধ্যে সিনিয়র সাংবাদিক, সম্প্রচার মাধ্যমে ব্যক্তিত্ব ও বিশেষজ্ঞসহ অন্যান্যরা থাকবেন।’
কেউ নীতিমালা ভঙ্গ করলে কি শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এই কমিশন গঠন হওয়ার পর এই কমিশন কোড অব গাইডেন্স তৈরি করবে, সেখানে বিস্তারিত থাকবে।’
এই নীতিমালার মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা হবে কিনা-সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘মোটেও না, বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য আছে। বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। সম্প্রচার মাধ্যমগুলোর আরও উন্নয়নের জন্যই এ নীতিমালা।’
জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা বিকাশমান গণমাধ্যমকে সংকুচিত করবে না দাবি করে তথ্যমন্ত্রী তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘সংবিধানের ৩৯ ধারা অনুযায়ী জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা করা হয়েছে।’