লৌহজংয়ের মাওয়ার পদ্মা পাড়ে চলছে স্বজনহারাদের মাতম। জীবিত অথবা মৃত পাওয়ার আশায় মাওয়া প্রান্তে স্বজনদের ভিড় ক্রমেই বাড়ছে। নিহতদের অধিকাংশের বাড়ি মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জ জেলায়। ঈদ শেষে তারা কর্মস্থলে ফিরছিলেন।
লঞ্চে থাকা যাত্রীদের স্বজনেরা আপনজনের খুঁজে নদীপাড়ে অপেক্ষা করছেন। অনেকেই স্বজনদের পাগল হয়ে খুঁজে ফিরছেন। সেখানে ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি শোকার্ত মানুষের কষ্ট আরো বাড়িয়ে তুলে। প্রশাসনের উদ্ধার তৎপরতাও বাধাগ্রস্থ হয়। সবমিলে মাওয়া পাড়ে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম সন্ধ্যা ৬টায় দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছলেও এ রিপোর্ট লেখার সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় পর্যন্ত পদ্মায় তলিয়ে যাওয়া লঞ্চটিকে সনাক্ত করতে পারেনি।
সূত্র মতে, অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই করে কাওড়াকান্দি থেকে লৌহজংয়ের মাওয়ায় আসার পথে গতকাল সোমবার বেলা ১১ টার দিকে এমভি পিনাক-৬ নামে একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে মাওয়া প্রান্তের পদ্মা নদীতে তীব্র স্্েরাতে লঞ্চের তলা ফুটে ডুবে গেছে। এতে লঞ্চের ১১০ জন যাত্রীকে স্থানীয়রা ২০টি সিবোটে ও ট্রলারের মাধ্যমে জীবিত উদ্ধার করে। এখনও নিখোঁজ রয়েছে প্রায় শতাধিক যাত্রী। এ সংবাদ লেখার সময় পর্যন্ত সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় লঞ্চের ২ নারী ও শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয় বলে মাওয়ার নৌ-পুলিশের ইনচার্জ এসআই খন্দকার খালিদ হোসেন জানিয়েছেন। এদিকে, জীবিত উদ্ধার অন্তত ৫০ জনকে স্থানীয় হাসপাতালসহ ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।
এদিকে দুপুর পৌনে ১টার দিকে নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ও সন্ধ্যা ৬টায় যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দুর্ঘটনাস্থলে এসেছেন। এছাড়াও ঘটনাস্থলে মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান বাদল, বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান ড. খন্দকার শামসুদ্দোহা, ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি শফিকুল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মো. জাকির হোসেন মজুমদারসহ বিআইডব্লিউটিএ ও বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তারা রয়েছেন। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিদল ছাড়াও স্থানীয়রা উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সরকারি হিসেবে নিখোঁজ ৮৩ :
বিকভলে নিখোঁজ যাত্রীদের তালিকা তৈরি করতে স্থানীয় প্রশাসন মাওয়া ঘাটে পদ্মার তীরে তাবু টাঙিয়ে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
সূত্র মতে, বিআইডব্লিউটিএ, বিআইডব্লিউটিসি, লৌহজং ও শ্রীনগর থানা পুলিশ এবং উপজেলা প্রশাসন পৃকভাবে মৃতর তালিকা, নিখোঁজের তালিকা ও উদ্ধারের তালিকা তৈরী করছেন।
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এ রিপোর্ট লেখার সময় নিখোঁজের তালিকায় ৮৩ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তালিকা অনুয়ায়ী নিখোঁজ যাত্রীরা হলেন, মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার বন্দরখোলার মিজানুর রহমান (৩৫), তার স্ত্রী রোখসানা (৩০), মেয়ে মিলি, ছেলে মাইনুল, মিম (১৫), গোপালগঞ্জের মোকসেদপুর উপজেলার পলি (২৮) ও তার মেয়ে মেঘলা (সাড়ে ৬ বছর), মিজানুর রহমান, আরমিন (১৬), আরফিন (১৭), ইমতিয়াজ রহমান, আয়শা আক্তার ও তার মেয়ে সারা, সাদিয়া (৯), ফালানি বেগম, দিপা আক্তার (১৩), রাবিব (১২), হানিফ (আড়াই বছর), মেরি, রবিউলসহ ৮৩ জন।
শ্রীনগর থানার ওসি শেখ মাহবুবুর রহমান জানান, নিখোঁজ যাত্রীদের তালিকা তৈরি হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত তালিকা বড় হচ্ছে। তবে, তালিকার নাম উঠানোর পর নিখোঁজ কাউকে কাউকে পাওয়া গেছে বলে স্বজনরা তাদের জানাচ্ছেন বলে তিনি জানান। এছাড়া সেখানে ৪৪ সদস্যের র্যাবের একটি দল সেখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন।
মাওয়া নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই খন্দকার খালিদ হোসেন জানান, পিনাক-৬ লঞ্চটি মাওয়ার ২ কিলোমিটার অদূরে প্রায় ৭০-৭৫ ফুট পানির গভীরে তলিয়ে গেছে। র্যাব হেলিকপ্টার দিয়ে দুর্ঘটনাস্থল মাঝ পদ্মায় টহল কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
পিনাক-৬ লঞ্চটি ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুন যাত্রী নিয়ে পদ্মা পাড়ি দেয়। ওভার লোডিং ও পদ্মায় তীব্র স্্েরাতের কারণে লঞ্চটি ডুবে গেছে।
উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম :
দুপুর পৌনে ১টার দিকে উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম নারায়নগঞ্জ থেকে মাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে সন্ধ্যা ৬টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌছে। লঞ্চটিতে আড়াই শতাধিক যাত্রী ছিলেন। নদীতে তলিয়ে যাওয়া লঞ্চটি সনাক্ত করা যায়নি।
মেডিকেল পড়ুয়া মেয়েকে হন্য হয়ে খুঁজছেন বাবা জাব্বার :
জান্নাতুল নাঈমা। চীনের একটি প্রদেশে চিকিৎসাবিদ্যায় পড়াশুনা করেন। বাড়ি শরীয়তপুরে। পিনাক-৬ লঞ্চে করে নাঈমা তার বাবা আব্দুল জব্বারের সঙ্গে ঢাকায় আসছিলেন খালাতো বোনের সঙ্গে দেখা করবেন বলে। লঞ্চ ডুবিতে বাবা বেঁচে গেলেও নাঈমার সন্ধান পাওয়া যায়নি। বাবা আব্দুল জব্বার নাঈমাকে পাগলের মতো খুঁজে ফিরছেন। কিন্তু কোথাও মেয়েকে খুঁজে না পেয়ে উদভ্রান্ত হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন বাবা জাব্বার।
মাওয়া ঘাটের সিবোট ব্যবসায়ী লাল মিয়া জানান, নদীর তীব্র স্্েরাতের কারণে সৃষ্ট ঘূর্ণাবর্তে পড়ে লঞ্চটি ডুবে গেছে।
মা বেঁচে গেলেও নিখোঁজ তিন ছেলে মেয়ে :
মাদারীপুরের শিবচরের কাওড়াকান্দির আব্দুর রহিম গুলশান-২ নম্বরে এক ব্যবসায়ীর গাড়ি চালান। তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকেন রাজধানীর ভাটারার সোলমাইদে। তার স্ত্রী হাসি বেগম ঈদের ছুটি শেষে বড় মেয়ে আদিবা সুলতানা, মেরাজ ও ছোট ছেলে মাহিকে নিয়ে ঢাকায় ফিরছিলেন। লঞ্চ ডুবিতে হাসি বেগম উদ্ধার হলেও তার ছেলে মেয়েদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হাসি বেগম উদ্ধার হওয়ার পর স্বামী রহিমকে ফোন করলে পাগলের মতো ছুটে আসেন রহিম।
রহিম ও তার স্ত্রী’র আহাজারি-আর্তনাদে ভারি মাওয়ার পরিবেশ ভারি হয়ে উঠছে। তিন ছেলে মেয়েকে হারিয়ে তারা এখন পাগল প্রায়।
শোকার্ত রহিম জানান, তার বড় মেয়ে আদিবা সুলতানা সোলমাইদ উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর ছাত্রী, মেরাজ পড়ে কিন্ডার গার্ডেন স্কুলে। আর ছোট মেয়ে মাহির বয়স দেড় বছর।
হাসি বেগম বলেন, আমি ওদের বাঁচাতে পারিনি। আমার ছোট ছেলে মাহির হাত ধরে ছিলাম আমি। কিন্তু আমার ছেলে গেল কোথায়।
স্ত্রী ও ২ মেয়েকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ আলী জাব্বার :
শরীয়তপুরের কৃঞ্চনগরের আলী জব্বার। থাকেন নারায়নগঞ্জের কাশীপুর এলাকায়।
ঈদের পর পরিবার পরিজন নিয়ে আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে শরীয়তপুরের কৃষ্ণনগরে গিয়েছিলেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। অনুষ্ঠান শেষে স্ত্রী জাহানারা বেগম, মেয়ে হালিমা, তানিজমা আক্তার ও ভাই আনোয়ার হোসেন অপুকে নিয়ে কাওড়াকান্দি থেকে পিনাক-৬ লঞ্চে করে মাওয়া হয়ে নারায়নগঞ্জের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ভাগ্যক্রমে আলী জাব্বার ও তার ভাই অপু বেঁচে গেলেও তার স্ত্রী ও ২মেয়ে পদ্মায় তলিয়ে নিখোঁজ রয়েছে।
এদের মধ্যে বড় মেয়ে হালিমা আক্তার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। আগামী ১৩ ই আগস্ট পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়ার কথা। কিন্তু পরীক্ষার ফল জানা হলো আর হালিমার।
মাওয়ার পাড়ে বাকরুদ্ধ আলী জব্বার মিয়া জানান, মেয়ে হালিমার এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হবে। এরপর কলেজে ভর্তি হবে। কিন্তু তা আর হলো না। মেয়ের কারণেই তড়িঘড়ি করে শরীয়তপুর থেকে নারায়নগঞ্জ বাড়িতে যাচ্ছিলেন তারা।
মেয়ে, জামাই, নাতি-নাতনিকে হারিয়ে পাগল শাহানা :
মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার বন্দরখোলা গ্রামের শাহানা বেগম (৫৫)। থাকেন ঢাকার মহাখালীতে। ঈদের ছুটিতে মেয়ে, মেয়ের স্বামী, নাতি ও নাতনিকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন। পিনাক-৬ লঞ্চে করে ঢাকায় ফেরার পথে লঞ্চের ডেকে (নিচে) মেয়ে রোকসানা (২৫), মেয়ের স্বামী মিজানুর (৩৫), নাতিন মইন (২) ও নাতনি মিলি (১০)-কে নিয়ে বসে ছিলেন।
ভাগ্যক্রমে শাহানা বেঁচে গেলেও মেয়েসহ পরিবারের ওই ৪ সদস্য নিখোঁজ হয়ে রয়েছে। মেয়ে, জামাই, নাতি-নাতনির সন্ধানে শাহানা বেগম মাওয়ার পদ্মা তীরে পাগলের মতো হন্য হয়ে খুঁজে ফিরছেন।
তীরে উঠার আগেই ফসকে গেল ২ শিশু পুত্র :
ফরিদপুরের শালথা এলাকার সৈয়দ শফি (৩৫)। স্ত্রী শেফালী বেগম (২৫), ২ ছেলে আরাফ (২) ও এনাম (৪)-কে নিয়ে ছিলেন দুর্ঘটনা কবলিত পিনাক-৬ লঞ্চের ছাদে। লঞ্চটি ডুবে যাওয়ার সময় ২ ছেলেকে ২ হাতে ধরে মাওয়ার পদ্মা পাড়ে উঠার চেষ্ঠা করছিলেন।
পাড়ের কাছাকাছি এলে তীব্র স্রোতে ২ ছেলে ফঁসকে পদ্মায় তলিয়ে যায়। স্ত্রী-সন্তানদের সন্ধানে মাওয়া পাড়ে পাগল হয়ে ছুটছেন এদিক-সেদিক।
রাব্বি বেঁচে গেলেও মা ও ভাই-বোন নিখোঁজ
মাদারীপুরের শিবচরের রাব্বি (১০)। মা মাকসুদা বেগম (৩০), ভাই হানিফ (৪) ও বোন মেরি (৬)। কাওড়াকান্দি থেকে লঞ্চে করে তারা ঢাকার কামরাঙ্গীচরে যাচ্ছিলেন। লঞ্চটি ডুবে যাওয়ার সময় রাব্বি পদ্মায় ভাসতেছিল। এ সময় সিবোর্ট যাত্রীরা তাকে জীবিত উদ্ধার করে। কিন্তু মা ও ২ ভাই বোন নিখোঁজ হয়ে রয়েছে। রাব্বিসহ স্বজনরা নিখোঁজদের সন্ধানে ছুটে চলেছেন।