পদ্মার লৌহজং চ্যানেলে লঞ্চ ডুবিতে এ পর্যন্ত ১৭ লাশ উদ্ধারের খবর পাওয়া গেছে। দুর্ঘটনার দিন সোমবার থেকে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ভোলা, চাঁদপুর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও বরিশালের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে এসব লাশ উদ্ধার করা হয়।
মাওয়ায় লাশ সনাক্তের কন্ট্রোল রুম এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
ভেসে উঠা ১৭টি লাশের মধ্যে ২টি লাশ মাওয়া এলাকায় উদ্ধার হয়েছে। উদ্ধারকৃত লাশের মধ্যে দুর্ঘটনার দিন ২ জন ও মঙ্গলবার ২ জনের লাশ রয়েছে। বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পদ্মা ও মেঘনা নদীর মাওয়ার ভাটি শরীয়তপুরের সুরেশ্বর, চাঁদপুরের হাইমচর, ভোলা সদর এবং বরিশাল থেকে ১৩ লাশ উদ্ধার হয়। ভোলায় ৪, চাঁদপুরের হাইমচরে ৩, বরিশালের তেতুলিয়ায় ১, শরীয়তপুরের নড়িয়ায় ১, সুরেশ্বরে ২ এবং বিকালে মাওয়ায় ২টি লাশ উদ্ধার হয়।
ভোলা থেকে উদ্ধার হয় তেজগাঁও কলেজের বিবিএ’র ছাত্র ফাহাদ আকন্দ (২৪)। ফাহাদ আকন্দের বাড়ি ঝালকাঠির কাঁঠালিয়ায়। মাওয়ার ভাটি অঞ্চল থেকে মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে নৌবাহিনীর উদ্ধারকারী জাহাজ অজ্ঞাত নারী (৩৫) লাশ উদ্ধার করে কাওড়াকান্দি ঘাটে হস্তান্তর করে।
শরীয়তপুরের নড়িয়ার সুরেশ্বর থেকে উদ্ধার হয় মাদারীপুরের শিবচরের মিজানুর রহমান (৩৫), ফরিদপুরের নগরকান্দার রিতা আক্তার (২৫), ফরিদপুরের নগরকান্দার জামাল উদ্দিন (২৭) ও অজ্ঞাত নারী (২৫)। এ আজ্ঞাত নারীর লাশ নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের ভাগ্নি জান্নাতুল নাঈম লাকির লাশ বলে স্বজনরা নিয়ে যায়। পরে লাকির লাশ নয় বলে ফেরত দেয়।
মাওয়াঘাটে স্থাপিত ক্যাম্প থেকে এ পর্যন্ত উদ্ধারকৃত লাশের মধ্যে ৬ জনের নাম-পরিচয় নিশ্চিত করেছে। এরা হলেন- ফাহাদ (২৪), মিজানুর রহমান (৩৫), রিতা আক্তার (২৫), জামাল উদ্দিন (২৭)। এর আগে লঞ্চডুবির প্রথম দিন হাসি ও হিরার লাশ উদ্ধার করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মাওয়া নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই খন্দকার খালিদ হোসেন।
কখন লঞ্চ শনাক্ত হবে- নিখোঁজ স্বজনদের এ অপেক্ষার যেন শেষ নেই। মাওয়ার পদ্মা পাড়ে জীবিত পাওয়ার আশা ছেড়ে এখন লাশ পাওয়ার আশায় স্বজনরা উদ্ভ্রান্ত হয়ে ছুটে চলেছেন এদিক-ওদিক।
গত তিনদিনেও নিমজ্জিত লঞ্চ পিনাক-৬ উদ্ধার না হওয়ায় ক্ষোভে ফুঁসছেন স্বজনরা। তারা প্রতিদিনই মাওয়ায় পুলিশের কন্ট্রোল রুমের সামনে বিক্ষোভ করছেন। বুধবার বিকালেও বিক্ষুদ্ধ স্বজনরা বিক্ষোভ করে পুলিশের উপর ইটপাকটেল নিক্ষেপ করেন।
মঙ্গলবার সকাল ৭টা থেকে ৮টা পর্যন্ত মাওয়াস্থ ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে বিক্ষোভ মিছিল করে এক ঘন্টা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন তারা।
এদিকে, লঞ্চটি শনাক্ত কিংবা উদ্ধার না হলেও স্রোতের তোড়ে লাশ ভেসে উঠছে বিভিন্ন জেলার নদীতে। এ সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। অন্য জেলায় লাশ ভেসে উঠায় মাওয়ার লাশ শনাক্তে কন্ট্রোল রুমও পড়েছে বিপাকে।
অন্যদিকে, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ছেড়ে আসা আরো একটি অনুসন্ধানকারী জাহাজ কান্ডারী-২ মাওয়ার পথে থাকলেও রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মাওয়া ঘাটে আসতে সক্ষম হয়নি। নারায়ণগঞ্জ থেকে উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম ও নির্ভিক আনা হলেও তা কোন কাজে আসছে না। বিআইডব্লিউটিএর দুটি জাহাজ দিয়ে সাইড সোলার স্কেন করা হলেও ডুবে যাওয়া লঞ্চের কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।
উদ্ধারকাজে নিয়োজিত বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক জহিরুল ইসলাম জানান, মঙ্গলবার রাত ২টা পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান শেষে আবার বুধবার সকাল ১০টা থেকে শুরু করা হয়। লঞ্চ শনাক্ত কাজ অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু রাত ৮টা পর্যন্ত পর্যন্ত ঘটনাস্থল ও তার আশেপাশে নদীতে কিছুই পাচ্ছি না।
লঞ্চ ডুবিতে নিখোঁজ মিজানুরের চাচা টেইলার মাস্টার মোতালেব হাওলাদার অভিযোগ করে বলেন, আজ ৩দিন ধরে নদীর পাড়ে অপেক্ষা করছি। মনে হয়, ইচ্ছে করেই এরা লঞ্চ তোলে না। কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে, স্বজনদের আর ফিরে পাব না। আমাগো টাকার দরকার নাই। আমাগো স্বজনদের ফিরাই দেন।
তিনি আরো বলেন, এত বড় নদী আর এত যাত্রী এখানে পারাপার হয়, অথচ একটি উদ্ধারকারী জাহাজ থাকে না।
মা আর দুই বোনকে হারিয়ে দুর্ঘটনা কবলিত লঞ্চ থেকে বেঁচে যাওয়া যাত্রী আনোয়ার হোসেন অপু ক্ষোভের সাথে বলেন, আমরা আর কিছু চাই না। আমরা স্বজনের লাশ চায়। বড় বড় দুর্ঘটনার লঞ্চ উদ্ধার হয়, অথচ এ ছোট লঞ্চটি উদ্ধার করা যাচ্ছে না। তিন দিন ধরে ঘাটে বসে আছি।
নিখোঁজ পিতা মুসা মিয়ার (৬০) খোঁজে তার ছেলে লক্ষীপুর কমলনগর চর মার্টিন গ্রামের মো. জসিমউদ্দিন জানান, পদ্মার পাড়ে বাবার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছি। বাবার সন্ধান পাচ্ছি না। ঘাটে নির্মাণ করা তথ্যকেন্দ্রসহ বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করেও কোনো লাভ হচ্ছে না । কর্তৃপক্ষ কি করছে তাও বুঝে ওঠতে পারছি না।
উল্লেখ্য, সোমবার বেলা ১১টার দিকে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাওড়াকান্দি ঘাট থেকে প্রায় আড়াইশ’ জনের অধিক যাত্রী নিয়ে মাওয়াঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় এমএল পিনাক-৬ নামের লঞ্চটি। পথিমধ্যে মাওয়ার ১ কিলোমিটার দূরে পদ্মার ঘূর্ণায়ণ ওভারলোডিং ও স্রোতের কারণে লঞ্চটি ডুবে যায়।