দীর্ঘ ৩০ ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের মাওয়ার পদ্মা নদীতে তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যাওয়া এমভি পিনাক-৬ লঞ্চটি শনাক্ত করা যায়নি। লঞ্চটি শনাক্ত করতে চট্টগ্রাম থেকে আনা হচ্ছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন জাহাজ ‘জরিপ-১১’।
উদ্ধারকারীরা লঞ্চটি শনাক্ত করতে নানা তৎপরতা চালিয়ে গেলেও কোনো অগ্রগতি নেই। ডুবে যাওয়া লঞ্চটির কখন খোঁজ মিলবে তাও জানাতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা। ফলে সময়ের সঙ্গে স্বজনহারাদের মাঝে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা। জীবন্ত না হলেও লাশ খুঁজে বেড়াচ্ছেন তারা। এমনকি সংশ্লিষ্টদের কাছে প্রিয় মানুষের লাশ ফিরে পেতে বারবার অনুরোধ জানাচ্ছেন নিহতের স্বজনরা।
এদিকে, ঘটনাস্থলে বসানো ক্যাম্প থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত নিখোঁজের তালিকায় ১২০ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক সাইফুল হাসান জানিয়েছেন।
দেড় শতাধিক যাত্রী নিখোঁজ থাকলেও সোমবার রাত পর্যন্ত দুই জনের লাশ উদ্ধার হওয়ায় ওই রাত থেকে বিক্ষোভ করছেন নিখোঁজের স্বজনরা। এছাড়া মঙ্গলবার সকাল ৮টার দিকে চাঁদপুর জেলার হাইমচর এলাকার মেঘনা নদী থেকে আরো ২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে লৌহজং থানার ওসি তোফাজ্জল হোসেন বলেছেন, উদ্ধারকৃত ৩৫ বছরের এক মহিলার লাশ লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিখোঁজদের একজন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উদ্ধারকৃত পুরুষের অপর লাশ পচে গলে যাওয়ায় সেটি লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিখোঁজদের মধ্যে কেউ নন বলেও তিনি ধারণা করছেন বলে জানান।
এদিকে, স্বজনদের খোঁজে মাওয়া পাড়ে চলছে আহাজারি আর আর্তনাদ। লঞ্চে থাকা যাত্রীদের স্বজনেরা আপনজনের খুঁজে নদীপাড়ে অপেক্ষা করছেন। অনেকেই স্বজনদের পাগল হয়ে খুঁজে ফিরছেন। অনেকেই ট্রলারে ও সিবোটে খুঁজছেন আপনজনদের।
লঞ্চ দুর্ঘটনায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে লাশ উদ্ধারের বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার হওয়ায় একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংবাদ কর্মীকে মারধর করেন তারা। এছাড়া উদ্ধার তৎপরতায় অবহেলার অভিযোগ তুলে ঢাকা-মাওয়া সড়ক অবরোধ করেন স্বজনরা। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত এক ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন তারা। পরে পুলিশ প্রশাসন তাদের দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিলে অবরোধ তুলে নেন নেয়া হয়।
এদিকে রাত ৯টায় উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম ঘটনাস্থলে পৌঁছলেও সোমবার মধ্যরাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান স্থগিত ছিল। সকাল ৮টা থেকে জাহাজটি উদ্ধার অভিযান ফের শুরু করে। সকাল পৌনে ১০টার দিকে নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা উদ্ধারকারী জাহাজ ‘নির্ভীক’ ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। এছাড়াও ঘটনাস্থলে প্রত্যয় ও সন্ধানী নামে আরো ২টি উদ্ধারকারী জাহাজ রয়েছে।
এতসব কিছুর পরও লঞ্চ উদ্ধারে এখন পর্যন্ত প্রশাসন ব্যর্থ হওয়ায় লঞ্চটি শনাক্ত করতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন জাহাজ ‘জরিপ-১১ চট্টগ্রাম থেকে রওনা হচ্ছে। ঘটনাস্থলে পৌঁছবে মধ্যরাতে।
নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান সকাল পৌনে ১০টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও তদন্ত কাজের খোঁজখবর করে সাংবাদিকদের জানান, এখনো ডুবে যাওয়া লঞ্চের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। উদ্ধারকারী জাহাজ জরিপ-১১ এলে নতুন প্রক্রিয়ায় উদ্ধার কাজ শুরু হবে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে চট্টগ্রাম থেকে উদ্ধারকারী জাহাজ জরিপ-১১ আনা হচ্ছে। ওই জাহাজটি ২৫০ মিটার পর্যন্ত সার্চ করতে পারে।
মন্ত্রী বলেন, পদ্মা নদীতে প্রবল ঘূর্ণিস্রোত থাকায়, নদীর পানি ঘোলা এবং নদীর তলদেশে পলি জমা হওয়ায় উদ্ধার কাজ ব্যাহত হচ্ছে। তবে প্রতিকূলতা সত্ত্বেও উদ্ধার অভিযান অব্যাহত থাকবে।
তবে এখনো লঞ্চটি শনাক্তের বিষয়ে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা উদ্ধারকাজে ধীরগতির অভিযোগ করেন।
এদিকে মঙ্গলবার সকাল থেকে দড়িতে ইট বেঁধে জাহাজটি শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন ডুবুরিরা। এতে বিআইডব্লিউটিএ, বিআইডব্লিউটিসি, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও কোস্টগার্ডের সদস্যরা যৌথভাবে উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত যাদের লাশ পাওয়া গেছে তাদের প্রত্যেককে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
উল্লেখ্য, ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ যাত্রীবোঝাই করে কাওড়াকান্দি থেকে লৌহজংয়ের মাওয়ায় আসার পথে সোমবার সকাল ১১টার দিকে এমভি পিনাক-৬ নামের লঞ্চটি মাওয়া প্রান্তের ১শ’ গজ অদূরে পদ্মা নদীতে তীব্র স্রোতে ডুবে যায়। এতে লঞ্চের ১১০ জন যাত্রীকে স্থানীয়রা ২০টি সিবোটে ও ট্রলারের মাধ্যমে জীবিত উদ্ধার করে। এখনো নিখোঁজ রয়েছে দেড় শতাধিক যাত্রী।
জীবিত উদ্ধার অন্তত ৫০ জনকে স্থানীয় হাসপাতালসহ ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরো ৪ যাত্রী মারা যায়।