এবার ঈদ ও ঈদপরবর্তী এ কয়েক দিনে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে আগত দর্শনার্থী কর্তৃক প্রচুর গাছপালা বিনষ্টের সংবাদ পাওয়া গেছে। বিষয়টি পরিবেশপ্রেমী হিসেবে হজম করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কথায় বলে না, সরকারি মাল, দরিয়া মে ঢাল। আসলে জনসচেতনতাই হতে পারে গাছ রক্ষার সর্বোত্তম পন্থা। তাই এ সম্পর্কে দু'চার কথা না বললেই নয়।
গাছ মানব সমাজের বন্ধু এবং সৃষ্টিকর্তার অনন্য নিয়ামত। সবুজ শ্যামল নৈসর্গিক পৃথিবী বিনির্মাণে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে, অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় ঝুঁকিহীন নিরাপদ বিনিয়োগে ও প্রাকৃতিক শোভাবর্ধন পূর্বক পর্যটন শিল্পের বিকাশে গাছ আজ আমাদের জীবনসঙ্গী। মানুষের জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে, মানুষের নান্দনিক চেতনাকে শাণিত করতে এবং আরণ্যকে প্রকৃতির মধ্যে মহান আল্লাহ তায়ালার শ্রেষ্ঠত্ব অনুধাবনের নিমিত্তে পৃথিবীতে গাছের জন্ম। গাছের মধ্যে স্রষ্টার সৃষ্টির অনন্য সৌন্দর্য লুকায়িত আছে। স্রষ্টার স্বরূপ সন্ধানের জন্য গাছের অস্তিত্বের গবেষণা ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যায়। আল্লাহ তায়ালা গাছ সর্ম্পকে বলেন, ‘তিনিই লতা ও বৃক্ষ উদ্যানসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং খেজুর বৃক্ষ, বিভিন্ন স্বাদ বিশিষ্ট খাদ্যশস্য, জলপাই ও দাড়িম্ব বাগিচা সৃষ্টি করেছেন। এরা একে অন্যের সদৃশ ও বৈসদৃশও বটে। যখন তা ফলবান হয় তখন তার ফল খাবে। আর ফসল তোলার দিনও তার হক প্রদান করবে এবং অপচয় করবে না’। (সুরা আনআম, আয়াত-১৪১)
একটি দেশের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য সে দেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগের মতো বনাঞ্চল থাকা জরুরি। তা না হলে প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্যহীন হতে বাধ্য। সেখানে আমাদের দেশে ১২ ভাগের বেশি বনাঞ্চল নেই। তাও আবার দিনে দিনে নির্বিচারে কেটে উজাড় করা হচ্ছে। যা কিনা শুধু পরিবেশ নয়- অর্থনীতির ভিতকেও নড়বড়ে করবে। আমাদের অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে শক্তিশালী করতে এবং আর্থিক সাশ্রয়পূর্বক আমাদের সম্পদ বাঁচাতে গাছের রয়েছে সুদূর প্রসারী অবিকল্প ভূমিকা। কেননা গাছ পরিবেশ, খাদ্য, ওষুধ, কাঁচামাল ও কাঠের যোগানসহ অর্থনৈতিক নিরাপত্তার সাপোর্ট দেয়। এসব কারণে ইসলাম বৃক্ষরোপণকে উৎসাহিত করে।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে কোনো মুসলমান একটি বৃক্ষরোপণ করবে অথবা শস্য বপন করবে উহা মানুষ অথবা পানি অথবা পশু খাবে নিশ্চয়ই উহা তার জন্য দান হিসেবে গণ্য হবে’ । (বুখারি ও মুসলিম)
বৃক্ষরোপণ একটি ইবাদত। সবিশেষ সওয়াবের কাজ সদকায়ে জারিয়াহ স্বরূপ। বৃক্ষরোপণ করে কেউ দান-সদকার সাওয়াব লাভ করতে পারে। এমনকি রোপণকৃত গাছ বা তার ফসল ও যদি কেউ চুরি করে তাও যে গাছ রোপণ করেছে তার আমলনামায় সাদকা-দান হিসেবে লেখা হবে। হাদিসে এসেছে, ‘যা চুরি যায় তাও তার জন্য দান হিসেবে গণ্য হয়’। এভাবে কোনো পতিত জমিকে আবাদি করা, এতে শস্য বপন করাও সাদকা বা দানতুল্য। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো পতিত জমি কৃষি উপযোগী করবে তার জন্য এতে সাওয়াব রয়েছে। উহা হতে কোনো খাদ্য অন্বেষণকারী যা কিছু খাবে উহা তার জন্য সাদকা স্বরূপ গণ্য হবে।’ (নাসাঈ ও দারেমী)
পক্ষান্তরে, অনর্থক গাছকাটা ও বন উজাড় করাকে ইসলামে গর্হিত কাজ হিসেবে দেখা হয়। রাস্তায় বা মাঠে যে গাছ ছায়া দেয়, যেখানে মানুষ বা পশু বিশ্রাম নেয়- এমন গাছকে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেটে ফেলা অত্যন্ত গর্হিত কাজ।মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে বরই গাছ কেটেছে তাকে আল্লাহ মাথা নিচু করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন’। (আবু দাউদ) ইমাম আবু দাউদ এ হাদিসের সংক্ষিপ্ত তাৎপর্যে বলেন ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে তার কোনো ফায়দা ছাড়া মাঠের বরই গাছ কেটেছে যার নিচে পথিক ও পশু আশ্রয় নেয় আল্লাহ তার মাথাকে নিচু করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন’। (মিশকাত) এ হাদিসে বরই গাছের কথা উদাহরণস্বরূপ বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে উপকারী যে কোনো গাছের ক্ষেত্রেই রাসুল (সা.)-এর সতর্কবাণী প্রযোজ্য। গাছ শান্তি ও কল্যাণের প্রতীক। রাসুল (সা.) যেমন বৃক্ষরোপণে মানুষকে উৎসাহ উদ্দীপনা দিতেন তেমনি সাহাবিগণও বৃক্ষরোপণে, বৃক্ষের যথার্থ পরিচর্যায় সকলকে উদ্বুদ্ধ করতেন। গাছের গুণাগুণ ও উপকারিতা বর্ণনা করে গাছের প্রতি যত্নশীল হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন।
আল কুরআনের বাণী ধ্বনিত হয়েছে এভাবে, ‘আমি বিস্তৃত করেছি ভূমিকে ও তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং তাতে উদগত করেছি নয়নাভিরাম সকল প্রকার উদ্ভিদ। এটি আল্লাহতে বিশ্বাসী প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য জ্ঞান ও উপদেশস্বরূপ। আসমান থেকে আমি বর্ষণ করি উপকারী বৃষ্টি এবং তদ্বারা আমি সৃষ্টি করি উদ্যান, শস্যরাজি ও সমুন্নত খর্জ্জুর। আমার বান্দাদের জীবিকাস্বরূপ আমি বৃষ্টি দ্বারা সঞ্জীবিত করি মৃত ভূমিকে।’ (সুরা কাফ, আয়াত-৭-১১)
গাছ পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় ও আর্থিক সাশ্রয়ে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ও পরিবেশগত বিরূপতা রক্ষায় গাছ উপকারী বন্ধুর ন্যায় সাহায্য করে। পৃথিবীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা বন্যা, খরা, সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, সিডর ও ভূমিকম্পসহ নানা ধরনের ভয়াবহতাও বাড়ছে প্রতিনিয়ত। বাড়ছে বিষাক্ত ধোঁয়া ও বাতাসে সীসার পরিমাণও। পক্ষান্তরে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, পুষ্টি চাহিদা ও চিকিৎসার জন্য ওষুধ তৈরিতে গাছের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি ও উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্পকে ত্বরান্বিত করতে বাস্তবভিত্তিক প্রচেষ্টা কার্যকর করতে হবে।
বৃক্ষ রোপণ একটি মহৎ উদ্যোগ, মানুষের সামগ্রিক কল্যাণের গ্যারান্টি নাগরিকদের মাঝে এ সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। রাসুল (সা.) কবরের পাশে বৃক্ষ রোপণের জন্য যে উপদেশ, উৎসাহ দিতেন তা আজ মূল্যায়ন করে বাস্তবানুগ উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা গাছ ছাড়া আমাদের বেঁচে থাকার বিকল্প নেই। গাছ থেকে পাওয়া অক্সিজেন আমাদের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য। অতএব, ইসলামে গাছের ভূমিকা রহমত হিসেবে বিবেচ্য এবং গাছের রোপণ, পরিচর্যায় জাগতিক ও পরলৌকিক কল্যাণ নিহিত আছে।