ইন্টারনেটনীতিমালা ছাড়াই চলছে তরঙ্গ ব্যবসা। আর এর সুযোগ নিচ্ছে মোবাইল অপারেটররা। এতে দেশ বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পাশাপাশি টেলিযোগাযোগ খাতে বড় বিনিয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। দৈনিক যায়যায়দিনে সাজেদুর রহমান বিশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছেন।
পত্রিকাটি বলছে, টেলিযোগাযোগ খাত, বিশেষ করে মোবাইল ফোন খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম মূল চালিকাশক্তি। এ খাত দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। খাতটি কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) বৃহত্তম সংস্থানকারী এবং সরকারের কর রাজস্বের সবচেয়ে বড় উৎস। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত গত ২০ বছর ধরে দেশে মোবাইল টেলিফোন কোম্পানিগুলো নীতিমালা ছাড়াই তরঙ্গের ব্যবসা করছে। বিনিয়োগ করছে ৮৩ হাজার ৩০৮ কোটি টাকা। তারা কত লাভ করেছে, তার সঠিক হিসাব না থাকলেও বিভিন্ন অপরাধে সরকারকে জরিমানা দিয়েছে ১১ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা। আর দেশ রাজস্ব হারিয়েছে শত শত কোটি টাকা।
মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটবের মতে, গ্রামীণফোন ও রবি ছাড়া অন্য সব অপারেটর লোকসানে আছে। এরপরও সংগঠনটির চেয়ারম্যান মনে করেন তরঙ্গ বরাদ্দ নীতিমালা হলে এই খাতে বিনিয়োগ বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ হবে।
বিটিআরসি ১৯৯৮ সালে প্রণীত জাতীয় টেলিযোগাযোগ নীতিমালার (এনটিপি) আলোকে মোবাইল অপারেটরদের ১৭ বছরের পুরনো পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করছে। সে সময়, একবিংশ শতাব্দীর টেলিঘনত্ব ধরা হয়েছিল শতকরা ১০ জন । কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমানে টেলিঘনত্ব ৭১ শতাংশ। এই ৭ গুণ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে মোবাইল অপারেটরদের আয় ৭ গুণ বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কিন্তু অপারেটররা পুরনো আইনের আওতায় কম টাকায় বেশি তরঙ্গ বরাদ্দ পাচ্ছে। এতে দেশ গত ২০ বছরে বিপুল পরিমাণ আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
অপরদিকে, মোবাইল অপারেটররাও বড় ধরনের প্রতারণা করে পার পেয়ে যাচ্ছে। দেশের বাইরে অবৈধভাবে ফোনকল করাসহ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অনুমোদন না নিয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালানোর বিষয়টি ধরা পড়লে জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। মোবাইল সেক্টরে এমন মচ্ছবের পরিবেশ বিরাজ করলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। বাংলাদেশের খুব অল্প কিছু আইনের মধ্যে টেলিযোগাযোগ আইন একটি, যার অধীনে কোনো বিধিমালা নেই। বর্তমানে টেলিযোগাযোগ আইনটি ২০০১ সালে টেলিযোগাযোগ নীতিমালার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রণয়ন করা হয়। ২০১০ সালে আইনটিতে সংশোধনী আনা হয়। কিন্তু এরপরও এটি সেই পুরনো লক্ষ্যকেই (টেলিঘনত্ব শতকরা ১০ জন) ধরে রেখেছে। বর্তমান নীতিমালায় বলা হয়েছে, সরকার একটি টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন গঠন করবে। কিন্তু ইতোমধ্যে একটি কমিশন ১২ বছর ধরে কাজ চলছে।
দেশে মোবাইলের নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে ৩২ হাজার টাওয়ারের মাধ্যমে। যা স্থাপন করতে ব্যয় হয়েছে ৪৭ হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও বৃহদাকার ৩৫টি টাওয়ার আছে যার স্থাপন ব্যয় ১০০ কোটি থেকে হাজার কোটি টাকা। এমনটাই জানিয়েছেন মোবাইল অপারেটর কোম্পানির সংশ্লিষ্টরা। অনুসন্ধানে জানা যায়, সাধারণত একটি টাওয়ার স্থাপনে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা খরচ হয়ে থাকে। বৃহদাকার টাওয়ার বসাতে শত কোটি টাকা থেকে হাজার কোটি টাকা খরচ পড়ে। গুলশানের উদয় টাওয়ার সরেজমিনে দেখা যায় সেখানে দুটি ফ্লোরজুড়ে টাওয়ারের কার্যক্রম চলছে। এমন একটি টাওয়ার স্থাপনে হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে বলে জানা যায়। এসব টাওয়ার স্থাপনে বিদেশি দক্ষ জনশক্তির চেয়ে দেশিও জনশক্তি অর্থাৎ প্রকৌশলীরা প্রাধান্য পাচ্ছেন। অথচ গত ৫ বছর আগেও এর চিত্র ছিল ভিন্ন। এমনটাই জানালেন দেশের টাওয়ার স্থাপনে শীর্ষ প্রতিষ্ঠান 'ই' ডট কমের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ কর্মকর্তা।
যায়যায়দিন টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির তথ্যমতে বলছে, দেশে মোবাইল গ্রাহক ১২ কোটি ছাড়িয়েছে। দেশে মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩ কোটি ৯০ লাখ ৫২ হাজার। গত এক বছরে মোবাইল গ্রাহক সংখ্যা ৭৫ লাখ ২১ হাজার এবং ইন্টারনেট গ্রাহক প্রায় ৩১ লাখ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া গত নভেম্বরে থ্রিজি সেবা চালু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত থ্রিজি গ্রাহক সংখ্যা ৪৮ লাখ ৪৫ হাজার। এর মধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৯২ লাখ ৩৩ হাজার। দেশের অপর অপারেটর বাংলালিংকের গ্রাহক সংখ্যা ২ কোটি ৯৭ লাখ ৫১ হাজার। ভারতীয় মোবাইল ফোন অপারেটর এয়ারটেলের গ্রাহক সংখ্যা ৮৫ লাখ ৪০ হাজার। টেলিটকের গ্রাহক সংখ্যা ৩৫ লাখ ৯৬ হাজার। তবে গত ছয় মাসে গ্রাহক কমেছে রবি ও সিটিসেলের। রবির গ্রাহক কমেছে ১৫ লাখ ৯৩ হাজার। রবির গ্রাহক ২ কোটি ৪০ লাখ ১৮ হাজার। সিটিসেলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ১৬ হাজার।
এ প্রসঙ্গে অ্যামটবের চেয়ারম্যান ও বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশন্স লিমিটেডের সিইও জিয়াদ শাতারা বলেন, একটি যথাযথ তরঙ্গ বরাদ্দ নীতিমালা ছাড়া নেটওয়ার্কে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করলে ঝুঁকির মধ্যে পড়বে মোবাইল খাত। এ ব্যাপারে বিটিআরসির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সংস্থাটির চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোস বলেন, এটির প্রক্রিয়া চলমান। দ্রুত প্রসারমান এই সেক্টরের জন্য রোডম্যাপ করাটা দুরূহ।