হেদায়েৎ হোসেন, খুলনা॥ সুন্দরবন ভ্রমণে পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে রাজস্ব আয়। গত অর্থবছরে সুন্দরবনের পর্যটন খাত থেকে রাজস্ব এসেছে ১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। সুন্দরবন ভ্রমণে দিন দিন মানুষের আগ্রহ বাড়লেও পর্যটন নীতিমালা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে সম্ভাবনাময় এ খাতের প্রসার ঘটছে না। চরম অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতির ফলে ক্রমেই হুমকির মুখে পড়েছে সুন্দরবন।
১৮৭৮ সালে সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর এক বছর পর বন বিভাগকে সুন্দরবনের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এর পর কেটে গেছে ১৩৫ বছর। কিন্তু আজও সুন্দরবন ভ্রমণে পর্যটন নীতিমালা হয়নি। নীতিমালা না থাকার কারণে থেমে থাকছে না সুন্দরবন ভ্রমণ। প্রতিবছর দেশি-বিদেশি পর্যটকরা সুন্দরবন ভ্রমণ করছেন। তবে আইন বা নীতিমালা না থাকায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে সুন্দরবনের ওপর।
জুলাই থেকে সুন্দরবনে পর্যটকদের আনাগোনা শুরু হয়। তবে সুন্দরবন ভ্রমণের উপযুক্ত সময় হচ্ছে অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত। প্রতি বছর এ সময় দেশি-বিদেশি পর্যটকরা সুন্দরবন ভ্রমণে আসেন। পর্যটকদের অধিকাংশই বনের অভয়ারণ্য এলাকা ভ্রমণ করে। পর্যটকদের ভ্রমণের সুবিধার জন্য চালু রয়েছে ট্যুর অপারেটর ব্যবসা। খুলনায় ছোট-বড় প্রায় ৪৫টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের অনেকেই জাহাজ ও বড় লঞ্চ ভাড়া করে এই ব্যবসা পরিচালনা করছেন।
সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য বন বিভাগের দেওয়া নিয়মের মধ্যে রয়েছে ব্যবসায়ী বা ট্যুর অপারেটররা ভ্রমণের ক্ষেত্রে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর কর্তৃক ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়া কোনও জাহাজ পর্যটনের কাজে ব্যবহার করতে পারবে না। পর্যটকবাহী জাহাজ বা লঞ্চে বর্জ্য রাখার ব্যবস্থা রাখা, সুন্দরবনে প্রবেশের পর জলে-স্থলে কোথাও বর্জ্য না ফেলা, কোনও জাহাজ বা লঞ্চে ৭০ জনের অধিক পর্যটক বহন না করা, নির্ধারিত রুট ব্যবহার করা। নীতিমালা বা আইন না থাকায় এ সব নিয়ম মানা হয় না।
অভিযোগ রয়েছে, নীতিমালা না থাকায় বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তারা অনিয়ম ও দুর্নীতি করছেন। বনে যাওয়া লঞ্চ বা জাহাজে ১৫০ জন থেকে ৩০০ জন পর্যটক বহন করা হয়। আর সরকারি কোষাগারে যাচ্ছে ৭০ জনের রাজস্ব। যা বছরের পর বছর ধরে চলছে। আবার বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে নির্ধারিত রাজস্ব আদায় হলেও দেশি পর্যটক হিসেবে দেখানোর মাধ্যমে দুর্নীতি করা হয়।
সুন্দরবন ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিদেশি পর্যটককে রাজস্ব দিতে হয় ৭৫০ টাকার সঙ্গে শতকরা ১৫ টাকা ভ্যাট। আর দেশি পর্যটককে ভ্যাটসহ দিতে হয় ১৫০ টাকা। শিক্ষার্থী ও গবেষকদের ক্ষেত্রে ভ্যাটসহ ধার্য রয়েছে ৩০ টাকা। তবে, সুন্দরবনের ভেতরের স্থানের ওপর নির্ভর করে রাজস্বের এ হারের কম-বেশি হয়। দেশীয় পর্যটকদের জন্য নীলকমলে ১৫০ টাকা, কলাগাছিয়া, মুন্সীগঞ্জ ও দোবেকীতে ২০ টাকা। এসব স্থানে বিদেশিদের জন্য ৭০০ টাকা, করমজলে দেশীয় পর্যটকদের জন্য ২০ টাকা ও বিদেশিদের জন্য ৩০০ টাকা, হারবাড়িয়ায় দেশিদের জন্য ৭০ টাকা ও বিদেশিদের জন্য ৭০০ টাকা, কটকা ও কচিখালী এলাকায় দেশিদের জন্য ১৫০ টাকা ও বিদেশিদের ১০৫০ টাকা হারে রাজস্ব নির্ধারিত রয়েছে। পর্যটকদের ক্যামেরা বহন, ভিডিও ধারণ ও নিরাপত্তা প্রহরীর জন্য নির্ধারিত হারে ফি জমা দিতে হয়। এছাড়া জাহাজ প্রবেশ ও অবস্থানের জন্য নির্ধারিত হারে ফি জমা দিতে হয়।
অভিযোগ রয়েছে, নীতিমালা না থাকায় বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তারা অনিয়ম ও দুর্নীতি করছেন। বনে যাওয়া লঞ্চ বা জাহাজে ১৫০ জন থেকে ৩০০ জন পর্যটক বহন করা হয়। আর সরকারি কোষাগারে যাচ্ছে ৭০ জনের রাজস্ব। যা বছরের পর বছর ধরে চলছে। আবার বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে নির্ধারিত রাজস্ব আদায় হলেও দেশি পর্যটক হিসেবে দেখানোর মাধ্যমে দুর্নীতি করা হয়।
কর্মকর্তাদের অব্যস্থাপনার কারণে বনের অভ্যন্তরে হট্টগোলসহ শব্দ যন্ত্রের ব্যবহার চলে। এতে বনের পরিবেশ নষ্ট হয়। বনের পর্যটন স্থানগুলোতে ওঠা-নামার ভালো ব্যবস্থা নেই। তৈরি হয়নি ভালো কোনও অবকাঠামো। পর্যটন মৌসুমে স্পটগুলো থাকে অপরিচ্ছন্ন। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনার স্তূপ দেখা যায়।
বনের আকর্ষণীয় আটটি স্থানের অধিকাংশ স্থানেই নেই যাত্রীদের লঞ্চ থেকে নামার কোনও সু ব্যবস্থা। মাঝ নদীতে লঞ্চ থামিয়ে দর্শনার্থীদের ট্রলারে করে তীরে যেতে হয়। ফলে সুন্দরবন ভ্রমণে যাওয়া দেশি ও বিদেশি পর্যটকদের নানামুখী সমস্যায় পড়তে হয়। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করার মত যথেষ্ট উপাদান থাকা সত্বেও কেবল প্রচার-প্রচারনা, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে সুন্দরবন ঘিরে পর্যটনের বিকাশ হচ্ছে না। সুন্দরবনের নির্ধারিত স্থানগুলোতে কোন বয়াবাতি না থাকায় লঞ্চ বা জাহাজ চালাতে সমস্যা হয়। কটকার মুখে বয়া থাকলেও বাতির ব্যবস্থা নেই।
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কার্তিক চন্দ্র সরকার বলছেন, ‘সুন্দরবন ভ্রমণের ক্ষেত্রে সরকার একটি নীতিমালার খসড়া তৈরি করেছে। যা অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। নীতিমালা পাশ হলে বন বিভাগ, পর্যটন ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের দায়-দায়িত্ব ও করণীয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট আইন থাকছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নীতিমালায় সুন্দরবন ব্যবস্থাপনার মূল উদ্দেশ্য থাকছে জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণে কোনোরূপ ব্যত্যয় না ঘটিয়ে সীমিত পর্যায়ে পর্যটন ও অবস্থান অনুমোদন করা। বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ, নিরাপত্তা ও স্বাভাবিক আচরণ যাতে ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করা। সুন্দরবন সংরক্ষণের স্বার্থে যে কোনও সময় সাময়িকভাবে পর্যটন স্থগিত বা নিয়ন্ত্রণ করা। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ব্যাপক প্রচারাভিযান চালানো হবে। যাতে অজ্ঞতার কারণে নীতিমালার অপপ্রয়োগ না হয়।’
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০১-০২ অর্থবছর দেশি-বিদেশি মিলে ৫৯ হাজার ১৬৯ জন পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেছেন। এ থেকে ১১ লাখ ৩৭ হাজার ৮৩৯ টাকা রাজস্ব আদায় হয়। এছাড়া ২০০৬-০৭ অর্থবছরে প্রায় ৩০ লাখ টাকা, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ২৭ লাখ টাকা, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে প্রায় ৪৪ লাখ টাকা, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৬৪ লাখ টাকা, ২০১০-১১ অর্থবছরে ৮৬ লাখ টাকা, ২০১১-১২ অর্থ বছরে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১ কোটি ৩ লাখ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। চলতি ২০১৪-১৫ অর্থ বছরের জন্য সোয়া ১ কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে।