ডেস্ক রিপোর্টঃ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রগতিশীল এবং উদার চরিত্রকে নস্যাৎ করতে সদা তৎপর রয়েছে। তারা সুযোগ পেলেই ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং সহিংসতা ছড়িয়ে দেয় বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৯তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী একথা বলেন। অধিবেশনে বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বোমা ও গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে অসংখ্য উদার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছে। এসব নৃশংস হামলা আমাকে দেশ থেকে সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করতে আরও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেছে।‘ তবে বাংলাদেশে আদর্শিকভাবে সন্ত্রাসবাদ এবং চরমপন্থা নির্মূলের জন্য তার সরকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং সকল ধর্মের মানুষের ধর্ম পালনের স্বাধীনতার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছে বলে উল্লেখ্য করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘শান্তি ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল, ধর্ষণ এবং গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। অত্যন্ত স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে গঠিত স্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর বিচারকাজ সম্পন্ন করেছে।‘ এসময় যুদ্ধপরাধীদের বিচারে আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা আবারও বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আমি আবারও আহ্বান জানাচ্ছি।
সন্ত্রাসবাদ এবং চরমপন্থা বিশ্বশান্তি ও উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, তার সরকার সব ধরনের সন্ত্রাসবাদ, সহিংস চরমপন্থা, উগ্রবাদ এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি ‘জিরো টলারেন্স‘ নীতিতে বিশ্বাসী। প্রতিবেশী বা অন্যদের বিরুদ্ধে যে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে না দেওয়ার ক্ষেত্রে তার সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ বলে জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘স্থায়ী শান্তি এবং নিরাপত্তা ব্যতিত আমরা টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে পারব না। আন্তর্জাতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অস্থিতিশীল বৈশ্বিক নিরাপত্তা অবস্থা এখনও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। “বাংলাদেশ বিশ্বাস করে, বিশ্বের যে কোনো স্থানে শান্তি বিঘ্নিত হলে তা গোটা মানবজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ।‘
বাংলাদেশে নারী উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিশ্বে বাংলাদেশই সম্ভবত একমাত্র দেশ যেখানে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, সংসদের স্পিকার ও সংসদীয় উপনেতা একজন নারী।‘ ভাষণের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করেন, চার দশক আগে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে নিজের প্রথম ভাষণে বঙ্গবন্ধু একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বাঙালি জাতি শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান, সামাজিক ন্যায়বিচার, এবং দারিদ্র্য-ক্ষুধা-আগ্রাসনমুক্ত এবং বৈষম্যহীন একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।‘ বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নই বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়ন অভিযাত্রা এবং বৈশ্বিক কর্মকাণ্ডের মূলভিত্তি বলে বিশ্বনেতাদের জানান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা এমন এক সময়ে এখানে সমবেত হয়েছি যখন বৈশ্বিক উন্নয়ন আলোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়েছে। যেহেতু সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) বাস্তবায়নের সময়সীমা শেষ হতে চলেছে, বিশ্বসম্প্রদায় ২০১৬-২০৩০ মেয়াদের জন্য একটি সংস্কারমূলক উন্নয়ন এজেন্ডা প্রণয়নের কাজে ব্যস্ত রয়েছে, সে প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের এবারের প্রতিপাদ্য অত্যন্ত সময়োচিত।‘ পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য নতুন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করার ক্ষেত্রে ভারসাম্যমূলক একটি প্যাকেজ গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি। তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালের পর ১৫ বছরের জন্য নতুন কর্মসূচি ঠিক করতে বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করে দারিদ্র্য বিমোচনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হোক। এ নতুন কাঠামোয় টেকসই উন্নয়নের তিনটি স্তম্ভের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হবে। আমরা মনে করি, নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাগুলো হতে হবে সযত্নে নির্বাচিত ভারসাম্যমূলক একটি প্যাকেজ।‘
ভবিষ্যৎ উন্নয়ন এজেন্ডায় স্বল্পআয়ের উন্নয়নশীল দেশগুলোর সম্পদ এবং সক্ষমতা সংশ্লিষ্ট দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা সমাধানের উপায় সংক্রান্ত বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতের আহ্বান জানান হাসিনা। জলবায়ু পরিবর্তন-জনিত জটিল ও ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে পর্যাপ্ত এবং অতিরিক্ত অর্থায়ন দেওয়ার গুরুত্বও বিশ্বনেতাদের কাছে তুলে ধরেন হাসিনা। উন্নত কয়েকটি দেশ প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের সামষ্টিক জাতীয় আয়ের শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ এবং ওডিএ হিসেবে জাতীয় আয়ের শূন্য দশমিক ২ শতাংশ স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে দিলেও অধিকাংশ দেশই সেই প্রতিশ্রুতি না রাখায় হতাশা প্রকাশ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। উন্নত দেশগুলোর বাজারে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সব ধরনের পণ্যের শুল্কমুক্ত এবং কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার দাবিও জানান তিনি।
বাংলাদেশকে একটি জ্ঞানভিত্তিক প্রযুক্তিনির্ভর মধ্যম-আয়ের দেশ হিসেবে পরিণত করতে সরকারের প্রচেষ্টার কথাও তুলে ধরেন তিনি। বিশ্বমন্দার মধ্যে গত পাঁচ বছরে জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে রাখা, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, রিজার্ভ বৃদ্ধির কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের উন্নয়নের সম্ভাবনার দাঁড় উন্মোচনে পদ্মা সেতু নির্মাণ, সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপনসহ কয়েকটি বড় প্রকল্প গ্রহণের কথাও উল্লেখ্য করেন শেখ হাসিনা। বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশে ১৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কথাও বিশ্বনেতাদের জানান প্রধানমন্ত্রী।
গাজায় ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুসহ শত শত সাধারণ নাগরিক হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ১৯৬৭-পূর্ব সীমানার ভিত্তিতে একটি স্বাধীন এবং স্থায়ী ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে এই দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের টেকসই সমাধান দাবি করেন শেখ হাসিনা।