
স্টাফ রিপোর্টারঃ ভারতের
পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের একটি বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় বাংলাদেশ
সীমান্ত সিল করে দিয়েছে ভারত সরকার। ওই বিস্ফোরণে বাংলাদেশের জঙ্গিদের
সম্পৃক্ততার খবর ভারতের গণমাধ্যমে প্রকাশের পর এ উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু
বিস্ফোরণের সঙ্গে বাংলাদেশীদের সম্পৃক্ত থাকার কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
বিস্ফোরণে নিহতদের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে তাতে অভিযুক্তদের বাংলাদেশী
হওয়ার আশঙ্কাও নেই। এরপরও সীমান্ত সিল এবং গণমাধ্যমে প্রচারণার মাধ্যমে
বাংলাদেশ সম্পর্কে বহির্বিশ্বে ভুল বার্তা পৌঁছে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
দুর্গাপূজার
অষ্টমীর দিন গত ২ অক্টোবর দুপুর ১২টার দিকে বর্ধমানের খাগড়াগড়ের একটি
বাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই শাকিল নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। পরে
হাসপাতালে মৃত্যু হয় স্বপন ওরফে শোভান ম-ল নামে আরেকজনের। বিস্ফোরণে আবদুল
হাকিম নামে আরেক ব্যক্তি আহত হন। তাদের তিনজনের শরীরেই গভীর ক্ষতচিহ্ন দেখা
গেছে। বিস্ফোরণের পরই বাড়িতে থাকা দুই নারী সিমকার্ড ভোটারকার্ডসহ
অন্যান্য নথি পুড়িয়ে ফেলেন। বিস্ফোরণের পরই ঘটনাস্থলে পৌঁছায় পুলিশ এবং
সিআইডি। বিস্ফেরণের পর ঘটনাস্থল থেকে ২৫টি গ্রেনেড, ১০টি হাতবোমা,
অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, আইরন অক্সাইড, হাইড্রোজেন পার অক্সাইডসহ প্রচুর
পরিমাণ বিস্ফোরক তৈরির উপাদান উদ্ধার করে পুলিশ।
ভারতের গোয়েন্দাদের ধারণা বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত শামীম ওরফে শাকিল আহমেদ এবং স্বপন ওরফে সুবহান ম-ল বাংলাদেশের জেএমবির একটি শাখার সদস্য। তবে আনন্দবাজারের এক প্রতিবেদনে বলা হয় নিহত শাকিলের বাড়ি নদিয়ার করিমপুরের বারবাজপুরে, সুবহানের বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরে ও আব্দুলের বীরভূমের মহম্মদবাজারে। আনন্দবাজার আরো লিখেছে নিহত শাকিলের বাড়ি বাংলাদেশে। তিনি বিয়ে করে এবং শ্বশুরকে ‘বাবা’ সাজিয়ে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলা থেকে ভারতীয় ভোটার পরিচয়পত্র নিয়েছেন।
নিহত শাকিলের স্ত্রী গুলশনা বিবি ওরফে রাজিয়া বিবি এবং হাকিমের স্ত্রী আমিনা বিবিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বিস্ফোরণে নিহত স্বপন ম-লের স্ত্রী আকিনাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে ভারতীয় কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয় বিস্ফোরণের পর গ্রেফতার হওয়া দুই নারীর একজন নিরাপত্তা বাহিনীকে জানিয়েছেন, তারা গত তিন মাসে চার দফায় ‘কাউসার’ ও ‘রাসিক’ নামে দুই বাহকের মাধ্যমে বাংলাদেশে বোমা পাঠিয়েছেন। ওই দিনও বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য বোমা বানানো হচ্ছিল। সে সময় বিস্ফোরণ ঘটে। নিহত শাকিল আহমেদের মোবাইল ফোনের কল লিস্ট দেখে পুলিশ জানতে পেরেছে, শাকিল আহমেদ বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেটের বেশ কিছু লোকজনের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলতেন। ওই কলগুলো খতিয়ে দেখছে পুলিশ। টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়Ñ গত ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের খয়রাগড়ায় বোমা বানাতে গিয়ে দুই বাংলাদেশী জঙ্গি নিহত হয়েছে। এদিকে আটক দুই নারীকে ১৪ দিনের পুলিশি রিমান্ডে নিয়েছে ভারতের পুলিশ।
যে ভবনে ওই বিস্ফোরণ ঘটেছে তার মালিক হাসান চৌধুরী এবং আমিনাকেও পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আমিনার বাবা মুর্শিদাবাদের একটি গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে লড়েছেন। তা ছাড়া ওই ভবনে তৃণমূল কংগ্রেসের একটি অফিসও রয়েছে। মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে সহিংসতা সৃষ্টিকারী জামায়াতের নেতাদের আশ্রয় প্রশয় দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এমনকি তৃণমূল থেকে নির্বাচিত এমপিদের বিরুদ্ধেও জামায়াত ও উগ্র ইসলামপন্থী নেতাদের সহযোগিতার অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছেÑ মুর্শিদাবাদ থেকে মাসতিনেক আগে শাকিল ও আবদুল হাকিম পরিবার নিয়ে বর্ধমানে আসেন। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেন শোভান ম-ল। স্থানীয় এক মুয়াজ্জিনের মাধ্যমে তারা এখানে ঘাঁটি গাড়ে। এরপরই বাড়ির মালিক হাসান চৌধুরীকে মুয়াজ্জিন ও স্থানীয় এক তৃণমূল নেতা এসে বলেন, তাদের পরিচিতদের বাড়িটি ভাড়া দিতে হবে। এখানে তারা বোরকা তৈরির কারখানা করবে। মাসিক চার হাজার টাকায় বাড়িটি ভাড়া নেন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা। অগ্রিম দেয়া হয় ২০ হাজার টাকা। তবে ভাড়ার অঙ্ক আরো বেশি বলে পুলিশ তাদের তদন্তে জানতে পেরেছে। এই জঙ্গিরা প্রথমে মুর্শিদাবাদের লালবাগে ছিলেন।
বিস্ফোরণের পর গত সোমবার কলকাতায় পুলিশের মহাপরিচালক জিএমপি রেড্ডি ও বিশেষ মহাপরিদর্শক (সিআইডি) দময়ন্তী সেনের উপস্থিতিতে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশী জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে ভারত সরকার সীমান্তে সতর্কতা জারি করে। বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাগুলোতে নজরদারি আরো কঠোর করা হয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল ও ভুটানের সীমান্ত রয়েছে। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তঘেঁষে রয়েছে আসাম, সিকিম, বিহার, ঝাড়খ- ও উড়িষ্যা রাজ্য। এদিকে ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত সিলগালা করার পর সীমান্তে বসবাসরত বাংলাদেশীদের সন্ধ্যার পর সাবধানে চলাচল করতে বলেছে বিজিবি। সাতক্ষীরা সীমান্তের বিপরীতে ভারতের সরুপনগর থানার তেঁতুল বাড়িয়া, গরজালা, গড়েরকান্দা, হাকিমপুর, তারালি, আমুদিয়া, বশিরহাটা থানার খলিসা, দুবলি, সোলপুর, পাখিমারা, কৈজুড়ি, ঘোজাডাঙ্গা, পানিতর, টাকি, হাসনাবাদসহ বিভিন্ন সীমান্তে বিএসএফ এর পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থা জারি করা হয়েছে। সাতক্ষীরাস্থ বিজিবি ৩৮ ব্যাটালিয়নের অপারেশন অফিসার মেজর আহসান হাবিব জানান, তারা জেনেছেন সাতক্ষীরা সীমান্তের বিপরীতে বিএসএফ জনবল বৃদ্ধি করে টহল ব্যবস্থা জোরদার করেছে। সীমান্ত বরাবর নজরদারি বাড়িয়েছে তারা। একই সাথে বিজিবির পক্ষ থেকেও সীমান্তে জনবল বৃদ্ধি করা হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় বসবাসরতদের সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। অবৈধ অনুপ্রবেশ, চোরাচালান, মাদক, নারী ও শিশু পাচার এবং পশুর চামড়া পাচার রোধে এলাকায় মাইকিং করা হয়েছে। এসব ব্যাপারে বিজিবির পক্ষ থেকে সীমান্তের মানুষের কাছে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির (এনআইএ) বরাদ দিয়ে গত সোমবার পশ্চিমবঙ্গের বাংলা দৈনিক বর্তমান লিখেছে বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণে ঘটনায় বাংলাদেশের জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক রিপোর্টে বলা হয়েছে জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদার শাখা আল জিহাদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা জামা’আতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) এর সদস্যরাই এ জঙ্গি হামলায় জড়িত। পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের এক স্থানীয় নেতা এ জঙ্গিদের থাকার জন্য বাড়িভাড়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।
ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে বিস্ফোরণের সঙ্গে বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাত-ই-ইসলামি’র জড়িত থাকার বিষয়টি ভারত সরকারের তরফে শেখ হাসিনা সরকারকে সতর্ক করে দেয়া হয়। নয়াদিল্লির তরফে এই সতর্ক বার্তা আসার পরে নড়েচড়ে বসে ঢাকা। সারা দেশে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গে নিহত ঐ দুই জঙ্গির ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি৷ গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশের জঙ্গিদের ব্যাপারে আমাদের কাছে যেসব তথ্য এবং তালিকা আছে, তাতে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের দাবি সঠিক বলে প্রতীয়মান হয় না৷
গতকাল
বৃহস্পতিবার ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত ‘জাল গড়াল আরব দেশেও-
দুবাই থেকে বাংলাদেশ ঘুরে টাকা বর্ধমানে’ শীর্ষক প্রতিবেদন সম্পর্কে
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ে
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আমরা সব খবর গুরুত্বের
সঙ্গে দেখছি। সারদা কেলেঙ্কারি জামায়াতে ইসলামীর সম্পৃক্ততা এবং বর্ধমানে
দুই বাংলাদেশীর সম্পৃক্ততা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সারদা কেলেঙ্কারির কাগজপত্র
ভারতের কাছে চেয়েছি। ভারত এখনো কোন তথ্য দেয়নি। তথ্য হাতে পাওয়ার পর
ব্যবস্থা নেয়া হবে। এরআগে গত বুধবার তিনি বলেন, বাংলাদেশের মাটি জঙ্গিদের
জন্য হারাম করে দেয়া হবে। বোমা বিস্ফোরণে দুইজন নিহত হয়েছে। গণমাধ্যম ও
লোকমুখে শুনেছি তারা দুজনই বাংলাদেশী। নিহত দুজনের ব্যাপারে ভারত সরকার
অফিসিয়ালি এখনো কিছু জানায়নি। অফিসিয়ালি জানানোর পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা
নেয়া হবে। ভারতের একটি পত্রিকার সম্পাদকও এ বিষয়ে আমাকে জানালে আমি তাকে
বলেছি নিহত ওই দুই জঙ্গি বাংলাদেশি কিনা তা যাছাই করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ভারতীয় গণমাধ্যমে নিহতদের বাংলাদেশী নাগরিক বলে প্রচারণার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছে তথ্য চেয়েছে। গত বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি নোট ভারবাল পাঠিয়ে নিহত দুই ব্যক্তির ব্যাপারে ব্যাখ্যা চেয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, ভারত সরকারের কাছে আমরা বিস্তারিত তথ্য চেয়েছি। বিস্ফোরণের ঘটনায় কোন বাংলাদেশির সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা কিংবা বাংলাদেশ কিভাবে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস নির্মূলে চলমান কার্যক্রম আরো জোরদার করা যায় সে ব্যাপারে নোট ভারবাল দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের কথিত ইসলামী জঙ্গি সংগঠন ও সেগুলোর কর্মকান্ড নিয়ে সরকারসহ ভারতপন্থী কিছু বিশেষ মহলের মাথাব্যথার শেষ নেই। অন্যদিকে প্রমাণিত হচ্ছে বাংলাদেশে নয়, জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের ব্যাপক বিস্তার ঘটছে আসলে ভারতে। বাবরী মসজিদ ধ্বংস করা, গোধরায় ট্রেনে অগ্নিসংযোগ, গুজরাট গণহত্যা, খ্রিস্টানদের হত্যাকাণ্ড, মালেগাঁওয়ের বোমা বিস্ফোরণ, সমঝোতা এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নিসংযোগ এবং সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর সব অপরাধেই হিন্দুত্ববাদী জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ‘র’তে চাকরিরত কর্নেল শিংকর পুরোহিতকে গ্রেফতার করার পর তিনি মালেগাঁও বোমা বিস্ফোরণ ও সমঝোতা এক্সপ্রেসে আরডিএক্স দিয়ে অগ্নিসংযোগের কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় খোদ ভারতীয়দের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডর এতো ঘটনার পরও বাংলাদেশকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের পীঠস্থান হিসেবে চিহ্নিত করার ব্যাপারে একটি মহল উঠেপড়ে লেগেছে। বাংলাদেশের কারণে প্রতিবেশী কোন দেশ নিরাপত্তা ঝুঁকিতে নেই। সরকার জঙ্গিদের বিষয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। বরং আন্তঃদেশীয় জঙ্গি তৎপরতায় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ।