ইসলামের বহু বিধিবিধান চান্দ্র মাস ও চান্দ্র তারিখের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই চান্দ্র মাসের তারিখ জানা এবং এর হিসাব রাখা ফরজে কেফায়া। এ সম্পর্কে কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, 'আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা বারোই নির্ধারিত।' (সূরা বাকারা : ১৮৫)। রমজান মাসের ব্যাপারে কোরআনের ঘোষণা- 'যারা রমজান মাসের সাক্ষাৎ লাভ করবে তারা যেন রোজা পালন করে।' (সূরা বাকারা : ১৮৫ )। হাদিস শরিফে এসেছে, 'তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোজা ছাড় তথা ঈদ কর।'
প্রশ্ন হলো, সব মুসলমানের স্বচক্ষে চাঁদ দেখতে হবে নাকি কেউ কেউ দেখলেই হবে? উত্তর হলো- যদি বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য একজন ব্যক্তিও চাঁদ দেখেন তাহলে তার সাক্ষ্য দ্বারা অন্যরা তা মেনে নিয়ে রোজা, ঈদ ও অন্যান্য ইবাদাত পালন করবেন। কোনো এলাকায় চাঁদ দেখা বিশ্বস্ত সূত্রে প্রমাণিত হলে কতদূর এলাকার লোকের জন্য তা পালনীয় হবে? পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে চাঁদ দেখা বিশ্বস্ত সূত্রে প্রমাণিত হলে, এই সংবাদ সঠিকভাবে পৃথিবীর অন্য যে কোনো প্রান্তে পেঁৗছলে তাদের সবাইকে এর ওপর আমল করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সীমানা দ্বারা চাঁদের তারিখ আলাদা করা যাবে না বা আলাদা হবে না। যেহেতু সারা পৃথিবীতে সময়ের ব্যবধান থাকলেও তারিখের ও বারের কোনো বিভিন্নতা নেই। যেমন- একই দিনে জুমা হয়; যদিও সময় আগে-পরে হয়।
চান্দ্র তারিখের পঞ্জিকা ও বর্তমান অবস্থা
চান্দ্র তারিখের হিসাবের ৪টি পঞ্জিকা রয়েছে। ১. স্থানীয়ভাবে নতুন চাঁদ দেখার ভিত্তিতে। ২. সৌদি আরবে নতুন চাঁদ দেখার ভিত্তিতে। ৩. পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় নতুন চাঁদ দেখার ভিত্তিতে। ৪. বৈজ্ঞানিক উপায়ে হিসাবের ভিত্তিতে। এ বছর ১৪৩৫ হিজরিতে (২০১৪ সালে) বিভিন্ন মুসলিম দেশে যথাক্রমে ২৮ জুন শনিবার, ২৯ জুন রোববার ও ৩০ জুন সোমবার রোজা শুরু করা হয়েছে। প্রথম দিন তুরস্কসহ ১৭টি দেশ হিসাবের ভিত্তিতে রোজার সূচনা করে। দ্বিতীয় দিন সৌদি আরবে চাঁদ দেখার ভিত্তিতে ৬০টি দেশ রোজা শুরু করে। তৃতীয় দিন নিজ নিজ অঞ্চলে চাঁদ দেখার ভিত্তিতে মাত্র ৩টি দেশ তথা ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ রোজা আরম্ভ করে। এটি মুসলমানদের ঐক্যের বিরাট অন্তরায়। আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.) বলেছেন, 'মুসলিম দেশগুলো সীমান্ত দিয়ে আলাদা করা জঘন্য ক্ষতিকর বেদাত। তাই আন্তর্জাতিক একক হিজরি ক্যালেন্ডার এখন সময়ের অপরিহার্য দাবি।'
বর্তমান অবস্থায় আমাদের করণীয়
আমাদের মতে, ইবাদতের জন্য উপরোক্ত ৪টির যে কোনোটি আমলযোগ্য; কারণ মানুষের হিসাব হবে তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা, নিষ্ঠা ও নিয়তের অনুপাতে। তবে সাধারণভাবে প-িতরা নীতিগত কারণে হিসাবের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক একক চান্দ্র তারিখের সমর্থন করেন। এটি বাস্তবায়ন করার জন্য ওলামায়ে কেরামের ঐকমত্য সমর্থন ও সরকারি সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। ইসলামী খেলাফত বিদ্যমান থাকলে এটি করা সহজ হতো। সমস্যা হলো যখন খেলাফত বিদ্যমান ছিল তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। আর বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে; কিন্তু আমাদের খেলাফত বা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ নেই; তাই সমস্যাটির সমাধান কিছুটা দুরূহ। সামাজিক ইবাদতগুলো ঐক্যতার ভিত্তিতে পালন করা বাঞ্ছনীয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন এ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে পারে। যেহেতু মানুষ এখন আর সূর্যাস্ত দেখে ইফতার করে না, ঘড়ির সময় দেখে করে; সুবহে সাদিক সময় হিসাবে মানে; সূর্যোদয়ও হিসাবের ভিত্তিতে; নামাজ ও সেহরির সময়সহ সবকিছুতে বৈজ্ঞানিক হিসাবের সহায়তা নেয়া হচ্ছে; তাই দিন, তারিখ ও চান্দ্র ক্যালেন্ডারের ক্ষেত্রেও এটি ঐকমত্যের ভিত্তিতে বিবেচনায় আনা উচিত।
ওআইসির সিদ্ধান্ত
১. পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় প্রথম নতুন চাঁদ দেখার ভিত্তিতে সারা পৃথিবীতে রোজা ও ঈদ পালনসহ ইসলামী পর্বগুলো উদযাপন করা যাবে। ২. আধুনিক প্রযুক্তি ও অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভৌগোলিক হিসাবের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক একক চান্দ্র তারিখের ক্যালেন্ডার প্রণয়ন ও তার ব্যবহারের প্রচলন করা যেতে পারে।
এ প্রসঙ্গে প্রাতঃস্মরণীয় মুজতাহিদ-আলেমদের সিদ্ধান্ত হলো- 'যে ব্যক্তি রমজানের চাঁদ দেখবেন বা নির্ভরযোগ্য সূত্রে রমজানের চাঁদ উদিত হওয়ার সংবাদ পাবেন, তার জন্য রোজা পালন করা, অনুরূপভাবে ঈদ করা ওয়াজিব হবে; উদয়স্থলের বিভিন্নতা গ্রহণযোগ্য নয়। পৃথিবীর এক প্রান্তে চাঁদ দেখা প্রমাণিত হলে তা অপর প্রান্তের লোকদের জন্য প্রমাণ সাপেক্ষে পালনীয় হবে; এর ওপরই ফতোয়া, এটাই জাহের রিওয়াত।' (আনওয়ারুত তানজিল-আছরারুত তাবিল : ১/১২৯; আইনি : ১/২৮১; ফাতাওয়ায়ে শামি : ২/৯৬; আল ফিকহ আলা মাজাহিবিল আরবায়াহ : ১/৫৫০; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া : ১/৩৬৯)।
মুফতি মুহাম্মাদ শফী (রহ.) বলেন, 'এবং এটাও স্বীকৃত যে, সহিহ ও মুখতার (গ্রহণযোগ্য) মাজহাব অনুযায়ী ঈদ এবং রোজার ব্যাপারে চাঁদের উদয়স্থলের বিভিন্নতা ধর্তব্য নয়। পশ্চিমা দেশবাসীর দেখা অনুযায়ী পূর্ব দেশবাসীর ওপর হুকুম বর্তাবে। যেহেতু মুতাবার, রাজেহ, মুফতাবিহি ও জাহের রেওয়ায়েত অনুযায়ী চাঁদের উদয়স্থলের বিভিন্নতা গ্রহণযোগ্য নয়, সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের মাজহাবের অনুসারীদের বিতর্কের কোনো সুযোগ নেই।' (ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম দেওবন্দ : ৩/৪৯)।
দারুল উলুম দেওবন্দের সাবেক প্রধান মুফতি আল্লামা আজিজুর রহমান (রহ.) বলেন, 'চাঁদ দেখেছে এমন ব্যক্তির সাক্ষ্য যদি বিশ্বাসযোগ্য হয় অথবা অন্য শহরের শরয়ি কাজী (বিচারক) ও আলেমের এবিষয়ক নির্দেশ যদি সাক্ষী দ্বারা প্রমাণিত হয়ে পেঁৗছে, তাহলে এ সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য। এর ভিত্তিতে রোজা রাখা ফরজ। চাঁদ উদয়ের বিভিন্নতা হানাফিদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। যদি পাশ্চাত্যে কেউ চাঁদ দেখে এবং শরিয়তসম্মত পন্থায় প্রাচ্যে এ সংবাদ পেঁৗছে, তাহলে প্রাচ্যবাসীরও ঈদ করা ওয়াজিব। পাশ্চাত্যে চাঁদ দেখা প্রাচ্যের জন্য যথেষ্ট। এটাই ফতোয়া।' (ফাতাওয়ায়ে আজিজিয়া : ১/৪২২)।
মাওলানা আশরাফ আলী থানভি (রহ.) বলেন, 'এক শহরবাসীর চাঁদ দেখা অন্য শহরের লোকদের জন্যও দলিল হবে। ওই দুই শহরের মধ্যে যত দূরত্বই হোক না কেন। এমনকি পৃথিবীর পশ্চিম প্রান্তে চাঁদ দেখা গেলে গ্রহণযোগ্য পন্থায় যদি পূর্ব প্রান্তের লোকদের কাছে সে সংবাদ পেঁৗছে, তাহলে তাদের ওপর সে দিনের রোজা ফরজ হবে।' (বেহেশতি জেওর, ১১খ-, মূল-উর্দু, পৃষ্ঠা. ১০৩-১০৪)।
এখানে প্রশ্ন হতে পারে, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন ও ছালফে ছালেহিনের সময় তো এমনটি ছিল না। তাহলে আমাদের এটা করা কি ঠিক হবে? এর উত্তর হলো, তখন চাঁদ দেখার সংবাদ তাৎক্ষণিকভাবে দূর-দূরান্তে পেঁৗছানো সম্ভবপর ছিল না। তাই যারা যখন যেখানে চাঁদ দেখতেন তারা ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকা যেখানে সংবাদ পেঁৗছত তারা সামর্থ্য অনুযায়ী আমল করেছেন। এখন যেহেতু মুহূর্তেই সারা পৃথিবীতে সংবাদ পেঁৗছানো সম্ভব, তাই এতে আর কোনো সমস্যা নেই।
লেখক :
মুফতি শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
সহকারী অধ্যাপক
আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম, ঢাকা