১৯৭১ সালের শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম মারা গেছেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে জাড়িত থাকার অপরাধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা মামলায় ৯০ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১২টার দিকে তার মৃত্যুর খবর ঘোষণা করা হয়। তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন তার ব্যক্তিগত সহকারি (পিএস) আবুল কালাম ও তার আইনজীবী এডভোকেট তাজুল ইসলাম।
বিএসএমএমইউর পরিচালক আবদুল মজিদ ভূঁইয়া রাত পৌনে ১২টার দিকে গোলাম আযমের মৃত্যুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, লাইফ সাপোর্টে নেয়ার আধা ঘণ্টা পর রাত ১০টা ২০ মিনিটে তার মৃত্যু হয়। একজন কয়েদির বেলায় আইন অনুযায়ী যা করা হয়, গোলাম আযমের ক্ষেত্রে তা অনুসরণ করা হবে। পক্ষান্তরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা গেছে, নিয়ম অনুযায়ী গোলাম আযমের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হবে। এরপর একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন ও ময়নাতদন্ত করা হবে। তারপর কারা কর্তৃপক্ষ স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করবে।
রাত পৌনে একটায় আবদুল মজিদ ভূঁইয়া জানান, হাসপাতালের কার্ডিয়াক আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) আরও অনেক রোগী আছেন। তারা আতঙ্কগ্রস্ত হতে পারেন। তাই আইজি প্রিজনকে রাতেই মরদেহ নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। তবে রাত দুইটার দিকে গোলাম আযমের আইনজীবী সাইফুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, পরিবারের পক্ষ থেকে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ চাওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে তারা সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন।
২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি গ্রেপ্তারের পর মাত্র কয়েক ঘণ্টা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন গোলাম আযম। ওই দিনই তাকে বিএসএমএমইউতে এনে কারা তত্ত্বাবধানে ভর্তি করা হয়। এর পর থেকে তিনি হাসপাতালেই ছিলেন। গতকাল বিকেলের পর তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। রাতে অবস্থার আরও অবনতি ঘটলে তাকে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস দিয়ে রাখা হয়। মূলত তখনই তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে। তার আত্মীয়স্বজন ও গণমাধ্যমকর্মীরা খবর সংগ্রহ করতে হাসপাতালে ভিড় করেন।
অন্যদিকে তার আইনজীবী তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, গোলাম আযম মারা যাওয়ার আগে দুটি ইচ্ছার কথা প্রকাশ করে গেছেন। তিনি চান জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী তার জানাজা পড়াবেন। এরপর মগবাজারে বাবার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হবে। পক্ষান্তরে গোলাম আযমের ৬ ছেলের মধ্যে ৫ জনই দেশের বাইরে। বড় ছেলে আবদুল্লাহহিল আমান আজমী সাংবাদিকদের বলেন, দেশের বাইরে থেকে সব ভাই আসা পর্যন্ত তারা দাফনের জন্য সময় চাইবেন।
গতকাল রাতে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী কারাগারে আছেন, তিনি ইতিমধ্যে একটি মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি। যদি নিজামীকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে গোলাম আযমের জানাজায় ইমামতি করার সুযোগ দেয়া হয়, তবে দেশের প্রচলিত কারাবিধি ও অন্যান্য আইন লঙ্ঘন করা হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, সরকার ইতিমধ্যে গোলাম আযমকে সর্বোচ্চ মানবতা দেখিয়েছে, তাকে ১১০০ দিন কারাগারের পরিবর্তে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দিয়েছে। এখন শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে দেশের জন্য সমূহ বিপর্যয়ের কোনো আশঙ্কা তৈরি করা ঠিক হবে না।
সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত
গোলাম আযম ১৯২২ সালের ৭ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার বীরগাঁও গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিরোধিতা করেন। পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির হিসেবে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠক করে গণহত্যার পরিকল্পনা করেন। দেশ স্বাধীন হলে তার নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। এর পর থেকে তিনি মূলত লন্ডনে বসবাস করে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা চালিয়ে গেছেন। ১৯৭৮ সালে তিনি পাকিস্তানি পাসপোর্ট ও ৩ মাসের ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসেন।
পাকিস্তানি পাসপোর্টধারী গোলাম আযম বাংলাদেশে এসে আর ফিরে যাননি। গোটা আশির দশক ছিলেন জামায়াতের অঘোষিত আমির। ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর প্রকাশ্য রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর গোলাম আযমকে প্রকাশ্যে আমির ঘোষণা করে জামায়াত। এর বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন শহীদজননী জাহানারা ইমাম। ১৯৯২ সালে নাগরিক সমাজকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করেন প্রতীকী গণ আদালত। সেই গণ আদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১০টি অভিযোগ আনা হয়েছিল। অভিযোগের প্রতিটিরই শাস্তি ঘোষণা হয়েছিল মৃত্যুদণ্ড।
বাংলাদেশের আলো-বাতাসে থাকলেও গোলাম আযম তার একাত্তরের ভূমিকার জন্য এ দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চাননি। একাত্তর সালের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চায়নি তার দল জামায়াতে ইসলামীও। যে দেশ তিনি চাননি, সে দেশেই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে তাকে। তবে তা একজন মানবতাবিরোধী অপরাধী হিসেবে, দণ্ডের বোঝা মাথায় নিয়ে।
প্রসঙ্গত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, মানবতাবিরোধী নান অপরাধে জড়িয় থাকায় গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। রায়ে বলা হয়েছিল, তার অপরাধের মাত্রা ছিল মৃত্যুদণ্ডযোগ্য। কিন্তু বয়স ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে তাকে এ সাজা দেয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরুধী অপরাধে নেতৃত্ব দেয়াসহ ৬৩টি অভিযোগে ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই গোলাম আযমকে নব্বই বছরের কারাদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এ রায়ের বিরুদ্ধে ও খালাস চেয়ে ওই বছরের ৫ আগস্ট আপিল করেন তিনি। আর সবোর্চ্চ শাস্তি চেয়ে গত বছরের ১২ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। সুপ্রিম কোর্টে গোলাম আযমের আপিলের শুনানি ২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।