ডেস্ক: লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়াননি'মাতা লাকা ওয়ালমুলক; লা শারিকা লাক' ধ্বনিতে মুখরিত আরাফাতের প্রান্তর। এ মুহূর্তে আরাফাতের ময়দানে সমবেত লাখো হাজির কণ্ঠে একই ফরিয়াদ- 'আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি হাজির। তোমার কোনো শরিক নেই। সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই। সব সাম্রাজ্যও তোমার। শুধু তোমার ক্ষমা ও অনুগ্রহ লাভের জন্য আমরা এখানে সমবেত হয়েছি।'
আজ পবিত্র হজ। শুক্রবার হজ অনুষ্ঠিত হলে শরিয়ত মোতাবেক তাকে 'হজে আকবর' হিসেবে অভিহিত করা হয়। হজে আকবরের রয়েছে বিশেষ মর্যাদা ও সওয়াব।
শুক্রবার সকাল থেকেই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর আত্মত্যাগের পুণ্য স্মৃতিবিজড়িত পবিত্রতম এই দিনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২০ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান নিজেদের পাপমুক্তি ও আত্মশুদ্ধির আকুল বাসনা নিয়ে এ হজ পালন করছেন।
বাংলাদেশ থেকে এবার ৯৮ হাজারের বেশি মানুষ হজ করছেন। হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে সৌদি আরবে চাঁদ দেখা অনুযায়ী গতকাল (৮ জিলহজ) থেকে।
বৃহস্পতিবার সারা দিন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হাজিরা মিনায় অবস্থান করেন। ফজরের নামাজের পর মক্কা থেকে মিনার প্রান্তরে পৌঁছে তারা আবেগে বিহ্বল হয়ে পড়েন। এই সেই মিনার প্রান্তর যেখানে আদি পিতা হজরত আদম (আ.) ও মাতা হজরত হাওয়া (আ.) আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে ক্ষমার পয়গাম লাভ করেছিলেন। এই সেই প্রান্তর বিহেশত থেকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেওয়ার পর যেখানে পুনরায় একত্রিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন তারা।
সেই মিনার বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে আজ সমবেত তাদের উত্তরসূরি ধর্মপ্রাণ মানব জাতির এক বিশাল অংশ, যারা আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মত (অনুসারী)। মিনার প্রান্তরে জোহর থেকে এশার নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করে সারা রাত মিনায় তাঁবুর মধ্যে ইবাদত-বন্দেগি ও রোনাজারি করে কাটান হাজিরা।
আজ ফজরের নামাজ আদায় শেষে মিনা থেকে হাজিরা সমবেত হয়েছেন আরাফাতের ময়দানে। হাজিদের (পুরুষ) পরনে শুধু সেলাইবিহীন সাদা দুই খণ্ড বস্ত্র (ইহরাম)। সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনেই ব্যাকুল। এখানে তারা সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করবেন। এই সেই ময়দান যেখানে দেড় হাজার বছর আগে দাঁড়িয়ে মুসলিম উম্মাহর উদ্দেশে খুতবা (ভাষণ) দিয়েছিলেন প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। বিদায় হজের খুতবায় তিনি ঘোষণা করেছিলেন, আজ থেকে ইসলামকে পরিপূর্ণ দীন ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালার কাছে একমাত্র মনোনীত দীন (জীবনব্যবস্থা) ইসলাম। আজ সব হাজির মনে প্রিয় নবীর সেই বিদায় হজের ভাষণের অনুরণন।
হজের অংশ হিসেবে আজ আরাফাতের ময়দানে হজের খুতবা দেওয়া হবে। আরাফাত ময়দানের মসজিদে নামিরাহ থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে দুপুরে সে খুতবা সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। খুতবা শেষে জোহর ও আসরের নামাজ পরপর একসঙ্গে আদায় করবেন হাজিরা। হজের তিনটি ফরজের মধ্যে আরাফাতে অবস্থান অন্যতম। আজ সূর্যাস্তের পর হাজিরা আরাফাত থেকে মুজদালিফায় যাবেন। সেখানে মাগরিব ও এশার নামাজ পরপর একসঙ্গে আদায় করবেন। এরপর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য সবাই খোলা আকাশের নিচে সারা রাত অবস্থান করবেন। এ সময় কোরআন তিলাওয়াত ও জিকির-আসকার করে আল্লাহর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করবেন।
সন্ধ্যায় (সূর্যাস্তের পর) তারা মুজদালিফার উদ্দেশে আরাফাতের ময়দান ত্যাগ করবেন।
মুজদালিফায় পৌঁছে আবারো এক আজানে আদায় করবেন মাগরিব ও এশার নামাজ। সেখান থেকে জামারায় (প্রতীকী শয়তান) নিক্ষেপের জন্য কঙ্কর (ছোট পাথর) সংগ্রহ করবেন।
মুজদালিফায় খোলা আকাশের নিচে রাতযাপনের পর ১০ জিলহজ (শনিবার) সকালে সূর্য উদয়ের পর জামারায় পাথর নিক্ষেপের জন্য রওনা দেবেন হাজীরা।
সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে যাওয়ার পূর্বে (দুপুরের আগে) জামারাতুল আকাবায় (বড় শয়তান) সাতটি পাথর নিক্ষেপ করবেন তারা। জামরাতুল আকাবায় পাথর নিক্ষেপের পর আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় হাজীরা পশু কোরবানি করবেন। এরপর মাথা মুণ্ডন করে ইহরাম খুলে পোশাক পরবেন হাজীরা। একে তাহাল্লুলে আসগর বলা হয়।
তারপর তাওয়াফে ইফাদা (কাবাঘর তাওয়াফ) এবং সায়ী (সাফা-মারওয়ায় সাত চক্কর) শেষ করে ফের মিনায় ফিরে যাবেন।
১১ ও ১২ জিলহজ অর্থাৎ রবি এবং সোমবার মিনায় অবস্থান করে সূর্য হেলে পড়ার পর প্রতিদিন ছোট, মাঝারি ও বড় জামারায় পাথর নিক্ষেপ করে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে মিনা ত্যাগ করবেন হাজীরা।
যারা ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে মিনা ত্যাগ করতে পারবেন না, তারা ১৩ তারিখ মঙ্গলবার সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত মিনায় অবস্থান করবেন এবং জামারায় ১১ ও ১২ তারিখের মতো পাথর নিক্ষেপ করবেন।
এরপর বুধবার মক্কায় অবস্থান করে বিদায়ী তাওয়াফ সম্পন্ন করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করবেন হাজিরা। আর যারা মদিনা জিয়ারত করবেন না তারা মদিনার উদ্দেশে মক্কা ত্যাগ করবেন।
এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৯৭ হাজার ৯৮৯ জন বাংলাদেশ থেকে হজ পালন করবেন।
এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লক্ষাধিক প্রবাসী বাংলাদেশি হজ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
অপরদিকে প্রতিবছর বাংলাদেশে সৌদি আরবের একদিন পরে ঈদ অনুষ্ঠিত হলেও এবছর তা হবে দুই দিন পরে, সৌদি আরবে এ বছর ঈদুল আজহা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ৪ তারিখ শনিবার আর বাংলাদেশে ৬ তারিখ সোমবার।