রুকনুজ্জামান অঞ্জন॥ বিনিয়োগের জন্য জাপানের চোখ এখন বাংলাদেশে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এখন চীন থেকে কারখানা স্থানান্তর করতে চাইছে শিল্পোন্নত এই দেশটি। এ ক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। সরকারের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।
সূত্রগুলো বলছে, দুই দশক আগে চীনে শ্রম মূল্য কম থাকায় জাপানের বিনিয়োগকারীরা তাদের ম্যানুফ্যাকচারিং খাত সেখানে স্থানান্তর করে। তবে পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থাপনা এবং উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ায় এখন তারা চীনের ওপর বিনিয়োগ নির্ভরশীলতা কাটাতে ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ কৌশল গ্রহণ করেছে। আর চীনের সঙ্গে এই ‘ওয়ান’ কান্ট্রি হওয়ার ক্ষেত্রে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকেই অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখেছে জাপান। দেশটির বৈদেশিক বাণিজ্য সংস্থা জেট্রো এক জরিপে বলেছে, তাদের প্রায় ৮০ শতাংশ কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যাদের মধ্যে বিশ্বখ্যাত অটোমোবাইল কোম্পানি ইয়ামাহা মোটর করপোরেশন, টয়োটা মোটর করপোরেশনসহ ডেনসো, ওয়াইকেকে এবং প্যানাসনিকের মতো ইলেকট্রনিক্স কোম্পানি রয়েছে। এমন কি ভোক্তারাও বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে জানতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। অনেকে আবার ভিয়েতনামের সঙ্গে বাংলাদেশের বিনিয়োগ সুবিধা তুলনা করেও দেখছে।
সরকারি সূত্রগুলো জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরের পর থেকেই মূলত বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে জাপানি কোম্পানিগুলোর দৌঁড়ঝাপ শুরু হয়েছে। ওই সফরে বাংলাদেশকে কৌশলগত অংশীদার রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে দেশটির প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জাপানি বিনিয়োগকারীদের জন্য পৃথক অর্থনৈতিক জোন স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে বেপজার সঙ্গে জেট্রোর সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এসব কিছুই হচ্ছে ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ কৌশল বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরকালে এসব বিষয়ে আরও আলোচনা হবে বলে জানিয়েছে সূত্রগুলো।
সূত্রগুলো আরও জানায়, ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ কৌশল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে একাধিক বৈঠক ও সেমিনার করেছেন জাপানের সরকারি প্রতিনিধি এবং সংস্থাগুলো। গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকা সফররত দেশটির অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্পবিষয়ক উপমন্ত্রী নোরিহিকো ইশিগুরো। এ ছাড়া ঢাকা এবং টোকিওতে দুই দেশের সরকারি সংস্থাগুলো বৃহত্তম বিনিয়োগ কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে সেমিনার ও প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করে। এসব বৈঠক ও অনুষ্ঠানে তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্ভাবনা এবং প্রতিবন্ধকতাসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছে।জানা গেছে, বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে সম্প্রতি টোকিওতে অনুষ্ঠিত প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করে জাইকা। চলতি বছরের ২১ জুন থেকে ২ জুলাইব্যাপী এই প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে দেশটির ব্যাংক অব টোকিও মিটশুবিশি জানিয়েছে, জাপানি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের অবকাঠামো, পরিবহন, বিমানবন্দও, রেলপথ এবং জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ করতে চায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে জাপানি ব্র্যান্ড বাংলাদেশের উৎপাদন সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে যৌথভাবে উইন-উইন সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্পর্কে ইয়ামাহা মোটর করপোরেশন যেসব বিষয় জানতে চেয়েছে তার মধ্যে রয়েছে রেমিট্যান্স আয়, মোটরসাইকেল নির্মাণে প্রণোদনা সংজ্ঞা, ঋণ নীতি এবং পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি কতটা বাধ্যতামূলক। প্যানাসনিক, ওয়াইকেকে মোটোর মতো কোম্পানিগুলোও বাংলাদেশে বিনিয়োগ সম্প্রসারণের কথা জানিয়েছে।
চায়না প্লাস ওয়ান স্ট্রাটেজি কী এবং কেন : চায়না প্লাস ওয়ান হচ্ছে বিশেষজ্ঞদের একটি বিনিয়োগ ধারণা। চীনের ওপর বিনিয়োগ নির্ভরশীলতা কাটিয়ে অন্য একটি দেশে বিনিয়োগ স্থানান্তর করার কৌশলকেই চায়না প্লাস ওয়ান স্ট্রাটেজি বলা হচ্ছে। গত ২০ বছরে জাপানসহ শিল্পোন্নত পশ্চিমা দেশগুলোর অনেক কোম্পানি চীনে তাদের কারখানা স্থাপন করেছে। চীনের বৃহত্তম বাজার, ভোক্তার চাহিদার পাশাপাশি শ্রম খরচ কম থাকায় ওই সময়ে বিনিয়োগের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে পশ্চিমা কোম্পানিগুলো। তবে সাম্প্রতিককালে পরিস্থিতি বদলে গেছে। অন্যান্য সমস্যার পাশাপাশি চীনে শ্রমের খরচ বেড়ে গেছে। এই অবস্থায় শিল্পের উৎপাদন ব্যয় কমানোর পাশাপাশি চীনের ওপর অত্যধিক বিনিয়োগ নির্ভরতা কমানোর কৌশল নিয়েছে অনেক দেশ। জাপান এর মধ্যে অন্যতম। এরই মধ্যে পশ্চিমা অনেক কোম্পানি চায়না প্লাস ওয়ান স্ট্রাটেজিতে তাদের বিনিয়োগ ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মিয়ানমারসহ কয়েকটি দেশে স্থানান্তর করেছে। এই তালিকায় এখন বাংলাদেশের নাম সম্ভাবনার সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে।
যে কারণে বাংলাদেশ : ২০ থেকে ৩০ বছর আগে চীনের যে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা দেখে পশ্চিমা বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে গিয়েছিল ঠিক সেই সম্ভাবনা এখন তারা বাংলাদেশে দেখছেন। এর অন্যতম কয়েকটি কারণ হচ্ছে, সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থান, প্রায় ১৬ কোটি ভোক্তার অভ্যন্তরীণ বাজার, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং কম মূল্যে সহজলভ্য শ্রমবাজার। ভৌগোলিক দিক দিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগসূত্র হচ্ছে বাংলাদেশ। এর একদিকে বিশাল ভারত অন্যদিকে মিয়ানমার। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশের এই সম্ভাবনার বিষয়ে জাইকার প্রতিবেদনে এসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। সংস্থাটি আরও বলছে, সস্তা শ্রমের পাশাপাশি এখানে শ্রমিকও সহজলভ্য। ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ার তুলনায় এখানে জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় অভ্যন্তরীণ চাহিদাও বেশি। ইংরেজিতে সহজে যোগাযোগ করা যায়। এ ছাড়া স্থিতিশীল জিডিপি প্রবৃদ্ধি, গার্মেন্ট এবং চামড়া শিল্পে অগ্রগতি, মধ্যম আয়ের ভোক্তার সংখ্যা বৃদ্ধি, আকর্ষণীয় বাজার, সহনীয় ট্যারিফ রেট এবং পানির সহজলভ্যতা, কম রেটে মোবাইল যোগাযোগ, জাপানিদের প্রতি স্থানীয়দের ইতিবাচক মানসিকতা বাংলাদেশকে জাপানি বিনিয়োগের জন্য অন্যতম পছন্দের তালিকার রেখেছে। তবে তারা বেশকিছু প্রতিবন্ধকতাও তুলে ধরেছে। এর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক ও শ্রম খাতে অস্থিরতা, অনুন্নত অবকাঠামো, বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন এবং নীতিতে অস্পষ্টতা, অদক্ষ জনশক্তি, ভূমির স্বল্পতা, বিদ্যুৎ স্বল্পতা এবং ভিসা প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার বিষয়গুলো।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শওকত আলী ওয়ারেছি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, গত সপ্তাহে জাপানের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্প বিষয়ক উপমন্ত্রী নোরিহিকো ইশিগুরো বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে বৈঠকে ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ স্ট্রাটেজি বাস্তবায়নের কথা বলেছেন। তারা জানিয়েছেন, চীন থেকে বিনিয়োগ নির্ভরশীলতা কাটাতে এশিয়ার অন্য কোনো দেশে বিনিয়োগ স্থানান্তর করতে চায় জাপানি বিনিয়োগকারীরা। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তারা পছন্দের তালিকায় রেখেছে। দেশটির অটোমোবাইল, ইলেকট্রনিক্স থেকে শুরু করে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অনেক কোম্পানিই এখানে খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য কারখানা স্থাপনে আগ্রহী বলেও জাপানের উপমন্ত্রী জানিয়েছেন।
সুত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন
সুত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন