বাসস: ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে গাজীপুরের লাল মাটি হতে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছিল। নয় মাস সশস্ত্র জনযুদ্ধের পর ১৪ ডিসেম্বর রাতভর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে সর্বশেষ প্রচন্ড সমুখ যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৫ গাজীপুর পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়।
গাজীপুরে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বাসসকে বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসেও জয়দেবপুরের সংস্কৃতি গাঁথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে এবং থাকবে চিরকাল।
মন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ তৎকালীন গাজীপুর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে জকী স্মৃতি প্রাইমারী স্কুলের সামনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক সভা আহবান করা হয়। এ সভায় শ্লোগান ওঠে ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর, ‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ এ শ্লোগান দিয়ে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
গাজীপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কাজী মোজাম্মেল হক বাসসকে বলেন, ১৯ মাচের্র আগে ৫ ও ৬ মার্চ, ১৭ ও ১৮ মার্চ ১৯৭১ সালে টঙ্গির বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনী শ্রমিক জনতার ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল নিষ্ঠুরভাবে। ৫ মার্চ ১৯৭১ সালে টংগীস্থ মেঘনা টেক্সটাইল মিলের শ্রমিক-জনতার সাথে পাক হানাদার বাহিনীর সম্মুখ সংঘর্ষে চারজন শাহাদাত বরণ করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মোতালেব, রইছ উদ্দিন, ইস্রাফিল।
তিনি জানান, ১৯ মার্চ, ১৯৭১ শুক্রবার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে এই ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করতে ঢাকা থেকে জয়দেবপুর যান। কিন্তু জয়দেবপুরবাসীর প্রবল প্রতিরোধে এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, যা ছিল পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম । ১৯ মার্চ মূলত: জয়দেবপুর মুক্তিসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সাহসী ভূমিকার কারণে জনতা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠে। পূর্বেই জানা গিয়েছিল ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব তার দলবল নিয়ে জয়দেবপুর রাজবাড়ী ক্যান্টনমেন্ট আসছে বাঙ্গালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করার উদ্দেশ্যে। খবর পেয়ে বীর জনতার সাথে জয়দেবপুরের শিমূলতলীস্থ মেশিনটুলস এবং সমরাস্ত্র কারখানা প্রভৃতি স্থান হতে শ্রমিকরা লাঠি মিছিল নিয়ে চলে আসে। ১৯ মার্চ শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর পাচঁটি চাইনীজ রাইফেলসহ পাকসেনারা রেশন নেয়ার জন্য রাজবাড়ী যাওয়ার পথে জয়দেবপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের নিকট পৌঁছলে জনতা অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়। এ সময় আ ক ম মোজাম্মেল হক, হাবিবল্লাহ, মনীন্দ্র গোম্বামী, এম এ মোতালেব প্রমুখের জ্বালাময়ী বক্তৃতায় জনগণ আরও পাক বাহিনী বিরোধী হয়ে উঠে এবং জয়দেবপুর রেল ক্রসিংয়ে কাঠের গুঁড়ি ও রেলওয়ের ওয়াগন (মালগাড়ী) ফেলে ব্যারিকেড স্থাপন করে । ঢাকা ফেরার পথে জাহানজেব ব্যারিকেড সরানোর জন্য জনতার উপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিলে বাঙ্গালী সৈন্যরা অপারগতা প্রকাশ করলেও পাক সৈন্যরা গুলি বর্ষণ করে। পাক বাহিনীর ছোড়া গুলিতে নেয়ামত ও মনু খলিফা শাহাদাতবরণ করে ও বহু লোক হতাহত হয়।
তিনি বলেন, জয়দেবপুর চৌরাস্তায় পাক বাহিনীর ঢাকা যাবার পথ রুদ্ধ করার জন্য শত শত জনতা ব্যারিকেড স্থাপন করে। এক পর্যায়ে জয়দেবপুর হতে ঢাকা অগ্রসরমান পাক বাহিনী চৌরাস্তায় পৌঁছলে মানুষ শ্লোগান ও প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ সময় জনতার মধ্যে হতে ফুটবল খেলোয়াড় হুরমত এক পাকসেনাকে ঝাঁপটে ধরে তাকে পরাস্ত করে হাতের রাইফেল ছিনিয়ে নেয়। তখন অপর পাশ থেকে পাক বাহিনীর ছোঁড়া গুলিতে ঘটনাস্থলেই শাহাদাতবরণ করে ফুটবলার বীর হুরমত। গুলিতে আহত কানু মিয়া হাসপাতালে মারা যায়। একই সময়ে ১৯শে মার্চ টঙ্গীতে গড়ে উঠে তীব্র গণ আন্দোলন।
তারা জানান, ২১ মার্চ কার্ফু উঠিয়ে নেয়ার পর ২৩ মার্চ বিকেলে জয়দেবপুরে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকাবাসীদের উপর পাকহানাদার বাহিনীর হামলার পর ২৮ ও ২৯ মার্চ চলে রাজবাড়ী ক্যান্টনমেন্ট সিপাহী বিদ্রোহ। লুন্ঠণ করা হয় গাজীপুর অস্ত্রাগার। নিহত হয় ৩০ জন পাকিস্তানি সৈন্য। ৩১ মার্চ শ্রীপুরে শুরু হয় সশস্ত্র যুদ্ধ। শ্রীপুরে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর মাজুখান পুলে পাঞ্জাবী সৈন্য ও রাজাকারদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের এক ভয়াবহ বন্দুক ও মাইন বিষ্ফোরণও ঘটানো হয়। ১৪ অক্টোবর রাতে ধীরাশ্রমে মুক্তিযোদ্ধারা রেললাইন উপড়ে ফেলে এবং ভোররাতে জয়দেবপুর দক্ষিণ সিগন্যাল সংলগ্ন সেতু মাইন বিষ্ফোরণে উড়িয়ে দিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। একই সময়ে আহসান উল্লাহ মাস্টারের গ্রাম হায়দরাবাদে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে প্রচন্ড যুদ্ধ হয় মিত্রবাহিনীর সাথে। এসময় পাক বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন কয়েকজন।
এর আগে ১০-১১ ডিসেম্বর গ্রুপ কমান্ডার মোঃ আব্দুল গণি মোল্লার নেতৃত্বে পূবাইলে পাকহানাদারদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এতে ১০ জন পাকসেনা নিহত ও ৩ জন বীর মুক্তি যোদ্ধা শহীদ হন। ১৩ ডিসেম্বর ব্রাহ্মনবাড়িয়া, কুমিল্লা এবং নরসিংদী হতে মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট পরাজিত পাকবাহিনী ট্রেনে পূবাইল পৌঁছলে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের শিকার হয় ।
১৪ ডিসেম্বর জয়দেবপুর রাজবাড়ীতে অবস্থানরত পাক হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে জয়দেবপুরকে মুক্ত করার লক্ষ্যে মোঃ শহীদুল্লাহ বাচ্চু, প্রয়াত শহীদুল ইসলাম পাঠান, ভুলু ও কাজী আলিম উদ্দিন বুদ্দিন এর নেতৃত্বে অভিযান পরিচালিত হয়। ভুলুর গ্রুপে খোকনও অংশ নেয়। এক পর্যায়ে খোকন বর্তমান কেবির মার্কেটের পিছনে অবস্থানরত অবস্থায় তার গ্রুপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১৬ই ডিসেম্বর জয়দেবপুর ফুড গোডাউনের একটি কবরে বদিউজ্জামান ভূইঁয়া ওরফে খোকনের লাশ পাওয়া যায়। ১৪-১৫ ডিসেম্বর জয়দেবপুর রেল ষ্টেশনের নিকট গোলাগুলির সময় কানাইয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা বদরুজ্জামান খোকন শহীদ হন। ১৫ ডিসেম্বর সকালে জয়দেবপুরসহ আশেপাশের এলাকা দখলদার মুক্ত হয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গাজীপুরে বেশ কয়েকটি গণহত্যা সংঘটিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কালিগঞ্জ কটনমিল, জয়দেবপুর গণহত্যা, ইছরকান্দি গণহত্যা, শ্রীপুর গণহত্যা, শ্রীপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ক্যাম্পাস গণহত্যা, সমরাস্ত্র কারখানায় নির্যাতন ও গণহত্যা এবং বাড়িয়া গণহত্যা। মুক্তিযুদ্ধে গাজীপুরে শহীদ হন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন আবদুল বাতেন আকন্দ, আব্দুস সামাদ, মোঃ বাচ্ছু মিয়া, সুনীল, বাদশা, মাজেদ মিয়া, আবুল হোসেন প্রমুখ।