ডেস্ক রিপোর্টঃ ইংরেজ লেখক এবং ঔপন্যাসিক মার্ক টোয়েনের ভাষায়, ‘যদি তুমি রাস্তা থেকে কোনো ক্ষুধার্ত কুকুরকে বাড়িতে নিয়ে যাও এবং লালন-পালন কর, তবে কুকুরটি কখনো তোমাকে কামড়াবে না। এটাই হলো মানুষ এবং কুকুরের মধ্যে পার্থক্য। নিজ সংগঠন, নিজ দল বা গোত্র সর্বোপরি দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার লজ্জাজনক কিংবা ভয়াবহ উদাহরণ মানুষই সৃষ্টি করেছে। আর ইতিহাসের পাতায় তাদের পরিচিতি ঘটেছে বিশ্বাসঘাতক বা বেইমান রূপে। এমনই ধরনের কিছু বিশ্বাসঘাতকের আদিঅন্ত.
ভিদকুন কুইজলিং (নরওয়ে):
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন মানুষ হয়তো খুব বেশি নেই যার নাম অভিধান বা ডিকশনারিতে স্থান পেয়েছে বিশ্বাসঘাতকদের প্রতিশব্দ হিসেবে। তেমনি একজন মানুষ নরওয়ের ভিদকুন কুইজলিং। আর ইংরেজি ছঁবংষরহম শব্দের অর্থ দালাল, দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক ইত্যাদি। বাংলা ভাষায় মীরজাফর নাম বা শব্দটি যেভাবে ব্যবহৃত হয়, ইংরেজি ও নরওয়ের ভাষায়ও কুইজলিং নাম বা শব্দটি সেভাবে ব্যবহৃত হয়। যাকে নিয়ে এই বিতর্কিত শব্দ, তার পুরো নাম ভিদকুন আব্রাহাম লাউরিটজ জনসন কুইজলিং। তবে কুইজলিং নামেই তার ব্যাপক পরিচিতি। ১৮৮৭ সালের ১৮ জুলাই তার জন্ম। লেখাপড়া শেষে যোগ দেন নরওয়ের সেনাবাহিনীতে। কর্মসূত্রে দীর্ঘদিন ছিলেন রাশিয়া এবং আশপাশের বেশ কটি দেশে। দীর্ঘ নয় বছরের প্রবাস জীবন শেষে কুইজলিং নিজ দেশে ফেরেন ১৯২৯ সালে। এরপর সোভেয়েট কমিউনিস্ট পার্টির আদলে নরওয়েতে নতুনভাবে দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে তিনি নরওয়ের প্রতিরক্ষমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন এবং একজন জনপ্রিয় রাজনীতিবিদে পরিণত হন। কালের বিবর্তনে তার নিজ দলের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকলে কুইজলিং গোপনে ইতালি ও জার্মানির ফ্যাসিবাদী শক্তির সঙ্গে হাত মেলান। জার্মানির কুখ্যাত শাসক এডলফ হিটলারের ৫০তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়ে তার দৃষ্টি কাড়েন কুইজলিং। পরবর্তীতে হিটলারের সঙ্গে দেখা করে মিত্রবাহিনী তথা ব্রিটিশদের দ্বারা নরওয়ে আক্রমণের শিকার হলে হিটলারের সাহায্য পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ১৯৪০ সালের ৮ এপ্রিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশরূপে ব্রিটিশ অপারেশন উইলফ্রেড শুরু হলে নরওয়েও তার নিরপেক্ষ ভূমিকা পরিত্যগ করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পরদিন সকালেই জার্মান বাহিনী আকাশ ও সমুদ্রপথে নরওয়ে দখলের জন্য আক্রমণ চালায়। জার্মানির পরাক্রমশালী যুদ্ধ জাহাজ ‘ক্রইজার ব্লুচার’ নরওয়ের দিকে দ্রুতই এগুতে থাকে। এই যুদ্ধ জাহাজে সমরাস্ত্র ও দুর্ধর্ষ জার্মান সেনাদের সঙ্গে হিটলার একদল আমলাও পাঠিয়ে ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল নরওয়ে দখলের পর পরই নিজের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু নরওয়ের গোলন্দাজ বাহিনীর কামানের গোলা আর টর্পেডোর আঘাতে জাহাজটিতে আগুন ধরে যায়, গোলাবারুদের ম্যাগাজিনে এই আগুন ছড়িয়ে পড়লে জাহাজে বিস্ফোরণ ঘটে এবং ক্রমেই ডুবতে থাকে হিটলারের শক্তির প্রতীক ও জার্মানের অংহকার ‘ক্রইজার ব্লুচার’। এতে জার্মানিদের পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন ঘটলেও নরওয়ে দখলের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। এদিকে কুইজলিং সমমনা কয়েকজন মন্ত্রীকে নিয়ে নরওয়ের ক্ষমতাসীনদের সরিয়ে নিজেই ক্ষমতা গ্রহণের পরিকল্পনা করেন। কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর হিটলার কুইজলিং সমর্থন দেন। হিটলারের সমর্থন পেয়ে কুইজলিং রাজধানী ওসলোর ৫০ কিলোমিটার দূরে নিজের ঘাঁটি গড়েন এবং প্রচার করতে থাকেন যে, নরওয়ের ক্ষমতাসীনরা পালিয়েছে। পরবর্তীতে জার্মানিরা নরওয়ে দখল করে নিলে কুইজলিং তার নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠনের ঘোষণা দেন এবং নরওয়ের সেনাবাহিনীকে জার্মানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা প্রতিরোধ বন্ধের নির্দেশ দেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হিটলার কুইজলিং এর নতুন সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করেন। এদিকে নরওয়ের দৃঢ়চেতা রাজা হ্যাবন সব রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে জীবন থাকতে কুইজলিংয়ের সরকারকে বৈধতা বা সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করেন। চতুর হিটলার এবার নতুন কৌশলের আশ্রয় নেন। এই কৌশলের অংশ হিসেবে জার্মানির জোশেফ টারভোবেনকে নরওয়ের ‘কমিশনার’ নিযুক্ত করেন আর কুইজলিংকে বানানো হয় পুতুল সরকারের প্রধান। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তীব্রতায় দ্রুতই বদলাতে থাকে নরওয়ের প্রেক্ষাপট। বিশ্বব্যাপী জার্মানিদের করুণ পরাজয় এবং ১৯৪৫ সালে ৩০ এপ্রিল হিটলারের আত্দহত্যার পর কুইজলিং বুঝতে পারেন দ্রুতই ঘনিয়ে আসছে তার দিন। যুদ্ধ শেষে নতুন সরকার কুইজলিং এবং তার মন্ত্রীদের বন্দী করে। বন্দী অবস্থায় কয়েকবার আত্দহত্যার চেষ্টা করেন কুইজলিং। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। বিচার চলাকালে দ্রুতই ওজন কমতে থাকে কুইজলিংয়ের। সেই সঙ্গে যোগ হয় আরও অনেক রোগ। তবুও বিচার এগিয়ে চলে। অভিযোগ আর অপরাধের পাহাড় জমে তার বিরুদ্ধে। ফলে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর বিচারের রায় অনুসারে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তাকে। এখানেই শেষ নয়। তার মৃতদেহ পুড়িয়ে ছাই করে চিরবিদায় জানানো হয় নরওয়ের কুলাঙ্গার ভিদকুন কুইজলিংকে।
মার্ডেচাই ভান্নু-(ইসরায়েল):
১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর মরক্কোতে জন্মগ্রহণ করেন মার্ডেচাই ভান্নু। জন ক্রসম্যান নামেও তার পরিচিতি রয়েছে। আশির দশকে ইসরাইলের পারমাণবিক কার্যক্রম প্রকল্পে একজন টেকনিশিয়ান হিসেবে যোগ দেন ভান্নু। যদিও বলা হতো যে, ইসরায়েল ব্যাপক বিধ্বংসী পারমাণবিক অস্ত্র নয় বরং শান্তিপূর্ণ কাজে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের ওপর গবেষণা করছে, বাস্তবে কিন্তু তা ছিল না। পশ্চিমা দেশের সহায়তায় ইসরায়েল বস্তুত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে অনেক দূর এগিয়ে যায়, যা ভান্নুর পছন্দ ছিল না। ব্যয় সংকোচন নীতির কারণে ১৯৮৫ সালে একবার চাকরি হারালেও লেবার ইউনিয়নের তদবিরে ভান্নু আবার চাকরি ফিরে পান। এই সময় তিনি বেশ কিছু গোপন তথ্য সংগ্রহ করেন এবং লুকিয়ে পারমাণবিক প্রকল্পের ৫৭টি ছবি গোপন ক্যামেরায় ধারণ করেন। এর পরপরই ফিলিস্তিনিদের প্রতি দুর্বল সন্দেহে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। চাকরি হারিয়ে ১৯৮৫ সালেই ভান্নু অস্ট্রেলিয়া চলে যান এবং ট্যাঙ্ িচালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। এ সময় ইহুদি ধর্ম ছেড়ে তিনি খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হন। ১৯৮৫ সালের জুন মাসে কলম্বিয়ার ফ্রি ল্যান্স সাংবাদিক ওসকার গুইরিরোর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। গুইরিরো তৎকালীন এক মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় প্রায় আট কোটি টাকা প্রাপ্তি সাপেক্ষ ভান্নুকে তার কাছে থাকা তথ্য ও ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশের প্রস্তাব করেন। এই ফাঁদে পা দেন মার্ডেচাই ভান্নু এবং সাংবাদিক গুইরিরোর সঙ্গে লন্ডন চলে যান।গুইরিরোর মধ্যস্থতায় লন্ডনের সানডে টাইম পত্রিকা ভান্নুর দেওয়া গোপন তথ্য ও ছবি প্রকাশ করে ১৯৮৬ সালের ৫ অক্টোবর। ফলশ্রুতিতে ইসরায়েল এবং ইসলায়েল বিরোধী শিবিরে সমালোচনা ও ঘৃণার ঝড় ওঠে। এতে নড়েচড়ে বসে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। কূটনৈতিক কারণে ভান্নুকে লন্ডন থেকে গ্রেফতার করা সম্ভব না হলেও মোসাদ তাকে বন্দী করার ব্যাপক পরিকল্পনা করে। মোসাদের মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বের করে যে, ভান্নু লন্ডনে কিছুটা একাকিত্বে ভুগছেন এবং মনে প্রাণে নারী সঙ্গ কামনা করছেন। মনোবিজ্ঞানীদের এ রিপোর্টের ভিত্তিতে মোসাদ কালবিলম্ব না করে তাদের মার্কিনি এজেন্ট সুন্দরী চেরিল বেনটভকে সিন্ডি নাম ধারণ করে ভান্নুর মন জয় করার অ্যাসাইনমেন্ট দেয়। সুন্দরী সিন্ডির আকর্ষণকে দূরে ঠেলে দিতে পারেননি ভান্নু, তাই তার বাহুলগ্ন হয়ে আনন্দ ভ্রমণে ইতালি চলে যান। ইতালির সমুদ্রসীমার খুব কাছেই তখন বাণিজ্যিক জাহাজের ছদ্মাবরণে অপেক্ষা করছিল রাডার ও অন্যান্য অত্যাধুনিক যোগাযোগযন্ত্র, গতিবিধি নজরদারির সরঞ্জাম এবং স্যাটেলাইটের মাধ্যমে জীবন্ত ছবি দেখার উপকরণ সংবলিত মোসাদের জাহাজ আইএনএস নোগা। ইতালির রাজধানী রোমে নেমে ভান্নু আর সিন্ডি পূর্ব থেকে ভাড়া করা এক অ্যাপার্টমেন্টের দিকে এগুতে থাকেন। অ্যাপার্টমেন্টে তখন ওঁৎপেতে ছিলেন মোসাদের তিন চৌকস গোয়েন্দা কর্মকর্তা। মুহূর্তের মধ্যেই তারা ভান্নুর শরীরে চেতনানাশক ইনজেকশন পুশ করে সারা শরীর অবশ করে ফেলে। ওই রাতেই গোপনে প্রথমে স্পিডবোট ও পরে গোয়েন্দাদের জাহাজ ‘নোগা’ অচেতন ভান্নুকে নিয়ে ইসরায়েলের উদ্দেশে পাড়ি জমায়। কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে অনুষ্ঠিত বিচারে ১৮ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় ভান্নুকে। এর মধ্যে ১১ বছর তাকে কারও সঙ্গে কথা বলতে বা দেখা করতে দেওয়া হয়নি। অবশেষে ২০০৪ সালের ২১ এপ্রিল কঠিন কিছু শর্ত সাপেক্ষে ভান্নুর মুক্তি মেলে। কঠিন এসব শর্ত মেনে ইসরায়েলে আজও বেঁচে আছেন ভান্নু।
মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস (রোম):
ইউরোপের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকা কাউকে যদি কোনো বিশ্বাসঘাতকের নাম বলতে বলা হয়, তবে তার মানসপটে যে নামটি সবার আগে ভেসে উঠবে তা হলো মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস। উইলিয়াম শেকসপিয়রসহ বহু নামিদামি কবি, সাহিত্যিক এবং গবেষকের লেখায় বারবার উঠে এসেছে এক বেইমানের নাম ব্রুটাস। ব্রুটাসের দেশ ইতালিতে কেউ কারও সঙ্গে বেইমানি করলে ক্ষোভ প্রকাশের জন্য ল্যাটিন ভাষায় বলা হয়, ‘এট টু ব্রুটি!’ অর্থাৎ ‘ও তুমিও ব্রুটাস!’ শেকসপিয়রের নাটক জুলিয়াস সিজারেও সংলাপ হিসেবে এসেছে এই প্রবাদ বাক্য। যে ব্রুটাসকে নিয়ে এত সমালোচনা, তিনি ছিলেন প্রাচীন রোমের জেনারেল এবং তৎকালীন নগর রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক জুলিয়াস সিজারের প্রথম জীবনের বন্ধু এবং অনুগ্রহ গ্রহণকারী। পরবর্তীতে অন্যদের সঙ্গে এই ব্রুটাসও রাষ্ট্রপ্রধান জুলিয়াস সিজারকে হত্যায় অংশ নেন, যা মৃত্যুর আগে সিজারকে হতবাক এবং ব্যথিত করেছিল। তাই বিখ্যাত ইংরেজি নাটক জুলিয়াস সিজারে নাট্যকার উইলিয়াম শেকসপিয়রের কলমে বেরিয়ে আসে সেই কালজয়ী সংলাপ ‘ও তুমিও ব্রুটাস।’
খ্রিস্টপূর্ব ৮৫ অব্দে তৎকালীন নগর রাষ্ট্র রোমে জন্মগ্রহণ করেন মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস, বেড়ে ওঠেন চাচার বাড়িতে। তাই অনেকের ধারণা ব্রুটাসের বাবা স্বয়ং জুলিয়াস সিজার, যদিও ব্রুটাসের জন্মের সময় জুলিয়াস সিজারের বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। অন্যদিকে জানা যায় তার বাবার নামও ছিল ব্রুটাস (এল্ডার) এবং মার নাম ছিল সার্ভিলিয়া কেওপিওনিস। ব্রুটাসের মা পরবর্তীতে জুলিয়াস সিজারের রক্ষিতা ছিলেন আর বাবা এক বিদ্রোহে অংশ নিয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
তরুণ বয়সে ব্রুটাস সাইপ্রাসে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। চাকরির পাশাপাশি উচ্চহারে সুদের ব্যবসা করে রাতারাতি ধনী বনে যান ব্রুটাস। একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে রোমে প্রত্যাবর্তন করে ব্রুটাস বিয়ে করেন। এরপর রোমের সরকার ব্যবস্থায় জুলিয়াস সিজারের পক্ষে সিনেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯ অব্দে রোমে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে ব্রুটাস জুলিয়াস সিজারের পক্ষ ত্যাগ করেন এবং মিজারের শত্রু পম্পের পক্ষে অস্ত্র ধরেন। জুলিয়াস সিজার এ জন্য তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিলেও কোনো ধরনের সন্ত্রাস বা যুদ্ধ না করার শর্তে বেঁচে যান। পরবর্তীতে গৃহযুদ্ধে জুলিয়াস সিজার জয়ী হলে ব্রুটাস তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে সিজারের কাছে পত্র লেখেন। উদার সিজার এবারও তাকে ক্ষমা করে দেন। শুধু তাই নয়, সিজার তাকে একান্ত আস্থাভাজনদের কাতারে ঠাঁই দেন এবং প্রথমে একটি গ্রাম এবং পরে একটি শহরের প্রশাসক নিযুক্ত করেন। আফ্রিকা জয়ের পর জুলিয়াস সিজারের প্রভাব ও প্রতিপত্তি ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। এতে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে সিনেটরদের মাঝে, পরবর্তীতে এই সিনেটররাই জুলিয়াস সিজারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ব্রুটাস তার প্রতি সিজারের ক্ষমা প্রদর্শন এবং অনুগ্রহের কথা ভুলে সিনেটরদের পক্ষে যোগ দেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ অব্দের ১৫ মার্চ জুলিয়াস সিজারকে হত্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন সিনেটররা। এদিন প্রিয়তমা স্ত্রী কারপূর্ণিয়া পিসোনিজের মনে দোলা দিচ্ছিল অজানা আশঙ্কা। স্বামী জুলিয়াস সিজারকে বারবার নিষেধ করছিলেন বাইরে যেতে। এদিকে সভাকক্ষে জুলিয়াস সিজারের আসতে দেরি হওয়ায় ষড়যন্ত্রকারী সিনেটরদের অনেকেই মনে করে হয়তো বা ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেছে। কিন্তু বেইমান ব্রুটাস সবাইকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে বলে। নির্দিষ্ট সময়ের পর জুলিয়াস সিজার সভাকক্ষে এলে উপস্থিত প্রায় ৫০-৬০ জন সিনেটর অতর্কিত ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। অসম প্রতিপক্ষকে তবুও মোকাবিলা করে যাচ্ছিলেন জুলিয়াস সিজার। এমনি এক মুহূর্তে সিজার দেখতে পেলেন তারই অনুগ্রহে বেঁচে যাওয়া ব্রুটাসও তাকে আঘাত করছে। আর সহ্য করতে পারলেন না তিনি। রোমের ঐতিহ্যবাহী রাজকীয় লম্বা পোশাক ‘টোগা’র আড়ালে মুখ লুকিয়ে নিজেকে সঁপে দিলেন নিশ্চিত মৃত্যুর কোলে। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে শুধু একটি কথাই বললেন, ‘ও তুমিও ব্রুটাস’!
ইউরোপের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকা কাউকে যদি কোনো বিশ্বাসঘাতকের নাম বলতে বলা হয়, তবে তার মানসপটে যে নামটি সবার আগে ভেসে উঠবে তা হলো মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস। উইলিয়াম শেকসপিয়রসহ বহু নামিদামি কবি, সাহিত্যিক এবং গবেষকের লেখায় বারবার উঠে এসেছে এক বেইমানের নাম ব্রুটাস। ব্রুটাসের দেশ ইতালিতে কেউ কারও সঙ্গে বেইমানি করলে ক্ষোভ প্রকাশের জন্য ল্যাটিন ভাষায় বলা হয়, ‘এট টু ব্রুটি!’ অর্থাৎ ‘ও তুমিও ব্রুটাস!’ শেকসপিয়রের নাটক জুলিয়াস সিজারেও সংলাপ হিসেবে এসেছে এই প্রবাদ বাক্য। যে ব্রুটাসকে নিয়ে এত সমালোচনা, তিনি ছিলেন প্রাচীন রোমের জেনারেল এবং তৎকালীন নগর রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক জুলিয়াস সিজারের প্রথম জীবনের বন্ধু এবং অনুগ্রহ গ্রহণকারী। পরবর্তীতে অন্যদের সঙ্গে এই ব্রুটাসও রাষ্ট্রপ্রধান জুলিয়াস সিজারকে হত্যায় অংশ নেন, যা মৃত্যুর আগে সিজারকে হতবাক এবং ব্যথিত করেছিল। তাই বিখ্যাত ইংরেজি নাটক জুলিয়াস সিজারে নাট্যকার উইলিয়াম শেকসপিয়রের কলমে বেরিয়ে আসে সেই কালজয়ী সংলাপ ‘ও তুমিও ব্রুটাস।’
খ্রিস্টপূর্ব ৮৫ অব্দে তৎকালীন নগর রাষ্ট্র রোমে জন্মগ্রহণ করেন মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস, বেড়ে ওঠেন চাচার বাড়িতে। তাই অনেকের ধারণা ব্রুটাসের বাবা স্বয়ং জুলিয়াস সিজার, যদিও ব্রুটাসের জন্মের সময় জুলিয়াস সিজারের বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। অন্যদিকে জানা যায় তার বাবার নামও ছিল ব্রুটাস (এল্ডার) এবং মার নাম ছিল সার্ভিলিয়া কেওপিওনিস। ব্রুটাসের মা পরবর্তীতে জুলিয়াস সিজারের রক্ষিতা ছিলেন আর বাবা এক বিদ্রোহে অংশ নিয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
তরুণ বয়সে ব্রুটাস সাইপ্রাসে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। চাকরির পাশাপাশি উচ্চহারে সুদের ব্যবসা করে রাতারাতি ধনী বনে যান ব্রুটাস। একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে রোমে প্রত্যাবর্তন করে ব্রুটাস বিয়ে করেন। এরপর রোমের সরকার ব্যবস্থায় জুলিয়াস সিজারের পক্ষে সিনেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯ অব্দে রোমে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে ব্রুটাস জুলিয়াস সিজারের পক্ষ ত্যাগ করেন এবং মিজারের শত্রু পম্পের পক্ষে অস্ত্র ধরেন। জুলিয়াস সিজার এ জন্য তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিলেও কোনো ধরনের সন্ত্রাস বা যুদ্ধ না করার শর্তে বেঁচে যান। পরবর্তীতে গৃহযুদ্ধে জুলিয়াস সিজার জয়ী হলে ব্রুটাস তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে সিজারের কাছে পত্র লেখেন। উদার সিজার এবারও তাকে ক্ষমা করে দেন। শুধু তাই নয়, সিজার তাকে একান্ত আস্থাভাজনদের কাতারে ঠাঁই দেন এবং প্রথমে একটি গ্রাম এবং পরে একটি শহরের প্রশাসক নিযুক্ত করেন। আফ্রিকা জয়ের পর জুলিয়াস সিজারের প্রভাব ও প্রতিপত্তি ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। এতে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে সিনেটরদের মাঝে, পরবর্তীতে এই সিনেটররাই জুলিয়াস সিজারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। ব্রুটাস তার প্রতি সিজারের ক্ষমা প্রদর্শন এবং অনুগ্রহের কথা ভুলে সিনেটরদের পক্ষে যোগ দেন। খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ অব্দের ১৫ মার্চ জুলিয়াস সিজারকে হত্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন সিনেটররা। এদিন প্রিয়তমা স্ত্রী কারপূর্ণিয়া পিসোনিজের মনে দোলা দিচ্ছিল অজানা আশঙ্কা। স্বামী জুলিয়াস সিজারকে বারবার নিষেধ করছিলেন বাইরে যেতে। এদিকে সভাকক্ষে জুলিয়াস সিজারের আসতে দেরি হওয়ায় ষড়যন্ত্রকারী সিনেটরদের অনেকেই মনে করে হয়তো বা ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেছে। কিন্তু বেইমান ব্রুটাস সবাইকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে বলে। নির্দিষ্ট সময়ের পর জুলিয়াস সিজার সভাকক্ষে এলে উপস্থিত প্রায় ৫০-৬০ জন সিনেটর অতর্কিত ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। অসম প্রতিপক্ষকে তবুও মোকাবিলা করে যাচ্ছিলেন জুলিয়াস সিজার। এমনি এক মুহূর্তে সিজার দেখতে পেলেন তারই অনুগ্রহে বেঁচে যাওয়া ব্রুটাসও তাকে আঘাত করছে। আর সহ্য করতে পারলেন না তিনি। রোমের ঐতিহ্যবাহী রাজকীয় লম্বা পোশাক ‘টোগা’র আড়ালে মুখ লুকিয়ে নিজেকে সঁপে দিলেন নিশ্চিত মৃত্যুর কোলে। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে শুধু একটি কথাই বললেন, ‘ও তুমিও ব্রুটাস’!
মীর জাফর আলী খান (ভারত):
এক ব্যক্তির বিশ্বাসঘাতকতার পরিণতিতে একটি উপমহাদেশ তথা একটি স্বাধীন জাতিকে দীর্ঘ ১৯০ বছর বিদেশিদের নাগপাশে পরাধীন জীবন কাটাতে হয়। তাই ইতিহাসের পাতায় সর্বকালের কুখ্যাত বিশ্বাসঘাতক হিসেবে কেবল একটি নামই নয়, বিশ্বাসঘাতকের প্রতিশব্দ হিসেবে ঘৃণাভরে উচ্চারিত হয় তার নাম। তিনি হলেন পলাশী যুদ্ধের সেই বেইমান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান। নবাব সিরাজউদদৌলার নানা নবাব আলীবর্দী খাঁর মতো মীর জাফরও ছিলেন আরব থেকে আসা এক নিঃস্ব বেদুইন। নবাব আলীবর্দী খাঁর সঙ্গে আত্দীয়তার সূত্রে নবাবের পরের পদেই অধিষ্ঠিত করেন মীর জাফরকে। যার পদমর্যাদা ছিল ‘বকশী’।আলীবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর তার নাতি সিরাজউদদৌলা নবাবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তা মেনে নিতে পারেননি মীরজাফর। নবাবের খালাতো ভাই শওকত জংকে নবাবের মসনদে বসানোর চক্রান্ত ফাঁস হয়ে গেলে নবাব সিরাজউদদৌলা মীর জাফরকে ‘বকশী’ পদ থেকে সরিয়ে দেন। নতুন বকশী করা হয় মীর মদনকে। কিন্তু মীর জাফর সেনাপতির দায়িত্বে থেকে যান। ইংরেজরা যখন নবাব সিরাজউদদৌলাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করতে থাকেন, তখন গোপনে মীর জাফর ইংরেজদের পক্ষ নেন এবং নিজে নবাবের সিংহাসনে বসার আয়োজন করতে থাকেন। এই চক্রান্তের কারণেই পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজ আক্রমণের মুখে মীর জাফরের অনুগত সেনাবাহিনীর একটি অংশ নবাবের বদলে ইংরেজদের পক্ষ নেয়। ফলে সহজেই পরাজিত হয় বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীন নবাব সিরাজউদদৌলা। সেই সঙ্গে অস্তমিত হয় স্বাধীনতার সূর্য। কেননা পরবর্তীতে ১৭৫৭ সালে মীর জাফরকে নবাব করা হলেও বাস্তবে তিনি ছিলেন ইংরেজদের আজ্ঞাবহ হাতের পুতুল। ইংরেজদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ১৭৬০ সালে তাকে ছুড়ে ফেলে তারই জামাতা মীর কাশেমকে নবাব করা হয়। অন্যদিকে জামাতা মীর কাশেমের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় পুনরায় মীর জাফরকে নবাব করা হয়। দন্ত-নখরহীন বাঘের মতো মীর জাফর ইংরেজদের হাতের পুতুল রূপেই বাকি জীবন পাড়ি দেন। লোকমুখে যদিও প্রচলিত আছে যে কুষ্ঠ রোগে মীর জাফরের মৃত্যু ঘটেছিল। কিন্তু ইতিহাসে তার সাক্ষ্য নেই। ইতিহাস মতে, ১৭৬৫ সালের ১৭ জানুয়ারি মীর জাফরের মৃত্যু ঘটে বার্ধক্যজনিত কারণে। ভারতের মুর্শিদাবাদে মীর জাফরের প্রাসাদের মূল তোরণের নামকরণ করা হয়েছে ‘নেমক হারাম দেউল’ বা বিশ্বাসঘাতক গেট হিসেবে। আর এভাবেই গালি বা বিশ্বাসঘাতকের প্রতিশব্দ হিসেবে বেঁচে থাকবে সর্বকালের কুখ্যাত বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের নাম।